কাপতাই

হেসপেরিডি পরিবারের প্রজাপতি

কাপতাই[১] (বৈজ্ঞানিক নাম: Udaspes folus (Cramer)) এক প্রজাতির ছোট আকারের প্রজাপতি। এরা ‘হেসপেরায়িডি’ গোত্রের এবং 'হেসপেরায়িনি' উপগোত্রের সদস্য।[২][৩] এদের দেহ কালচে বাদামী বর্ণের এবং পিছনের ডানার নিচের অংশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে সাদা অঞ্চল দেখা যায়। এই অঞ্চলটির সীমারেখা এবড়ো-খেবড়ো ধরনের। এই অঞ্চলটি অন্য সব সদৃশ গড়ন স্কিপারদের থেকে কাপতাইকে আলাদা করেছে। সামনের ডানায় সাদা ছোপ থাকে। ওপর পিঠে পিছনের ডানায় একটা বড় সাদা ছোপ ডানার মাঝামাঝি অবস্থিত। সাদা বর্ণের ছোপ সামনের ডানাতেও দেখা যায়।[৪]

কাপতাই
Grass Demon
ডানা বন্ধ অবস্থায়
ডানা খোলা অবস্থায়
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণীজগৎ
পর্ব: সন্ধিপদী
শ্রেণী: পতঙ্গ
বর্গ: লেপিডোপ্টেরা
পরিবার: Hesperiidae
গণ: Udaspes
প্রজাতি: U. folus
দ্বিপদী নাম
Udaspes folus
(Cramer, 1775)

আকার সম্পাদনা

কাপতাই এর প্রসারিত অবস্থায় ডানার আকার ৪০-৪৮ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের হয়।[৪][৫]

বিস্তার সম্পাদনা

ভারত (দক্ষিণ ভারত থেকে দক্ষিণ গুজরাত [সৌরাষ্ট্র], মুম্বাই, আমেদাবাদ, মধ্যপ্রদেশ[৫], উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচল প্রদেশ [কাংড়া] থেকে সিকিম, অসম ও উত্তর-পূর্ব ভারত) নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ[৫], মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা এর বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা যায়।[৬][৭]

বর্ণনা সম্পাদনা

প্রজাপতির দেহাংশের পরিচয় বিশদ জানার জন্য প্রজাপতির দেহ এবং ডানার অংশের নির্দেশিকা দেখুন:-

ডানার উপরিতল কালো বা কালচে খয়েরী ও বিভিন্ন আকৃতির ছোট-বড় সাদা অর্দ্ধ-স্বচ্ছ ছোপযুক্ত। উভয় ডানার বেসাল (গোড়ার) অর্ধ সুক্ষ হলদেটে আঁশে ছাওয়া। সামনের ডানায় সেল-এর বহিঃপ্রান্ত জুড়ে একটি বড় সাদা ছোপ বর্তমান। উক্ত ছোপটির নিচে সামান্য বাইরের দিকে দুটি অনুরূপ সংযুক্ত ডিসকাল ছোপ দেখা যায় ১বি ও ২ নং শিরামধ্য (interspace) জুড়ে। সংযুক্ত ডিসকাল ছোপদুটিকে ২ নং শিরা সম্পূর্ণ বিভাজিত করতে পারেনি। এছাড়াও কতকগুলি ছোট সাদা ডিসকাল ও পোস্ট-ডিসকাল ছোপ অসংলগ্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৩ থেকে ৮ নং শিরামধ্যের ভিতরে। উভয় ডানায় সিলিয়া বা প্রান্ত-রোঁয়া পর্যায়ক্রমে সাদা ও কালচে খয়েরী। পিছনের ডানায় মধ্যভাগে (১সি থেকে ৬ নং শিরামধ্য পর্যন্ত বিস্তৃত) একটি বৃহদাকার সাদা অর্দ্ধ-স্বচ্ছ পটি (patch) চোখে পড়ে। বেসাল, ডর্সাল ও টর্নাল অংশ সাদা রোঁয়া দ্বারা আবৃত।[৮]

ডানার নিম্নতল উপরিতলের তুলনায় খানিক ফ্যাকাশে। সামনের ডানার দাগ-ছোপ স্বচ্ছতার কারণে উপরিতলেরই অনুরূপ। পিছনের ডানার অধিকাংশ ভাগই সাদা। ডানার মধ্যবর্তী সাদা পটিটি উপরিতল অপেক্ষা বৃহত্তর ও নিচের দিকে সরুভাবে ডরসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। ডানার বেসাল(গোড়ার) ও ডর্সাল অংশ প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ঘনভাবে সাদা রোঁয়ায় আচ্ছাদিত। পোস্ট-ডিসকাল ও টর্নাল অঞ্চল সাদা আঁশে ছাওয়া। কিছু নমুনাতে সেল ও ডিসকাল অংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে (disco-cellular) সামান্য উপরে ৬ নং শিরামধ্যে একটি মাঝারি আকৃতির সাদা ছোপ বিদ্যমান। স্ত্রী ও পুরুষ প্রকার অনুরূপ; তবে স্ত্রী প্রকারে সাদা ছোপগুলি বৃহত্তর।

শুঙ্গ কালো ও শীর্ষভাগের নিচে সাদা ছাপযুক্ত। মাথা, বক্ষদেশ ও উদর উপরিতলে কালচে খয়েরী ও সাদা রোঁয়ায় ছাওয়া এবং নিম্নতলে ফ্যাকাশে সাদা।[৮][৯][১০]

আচরণ সম্পাদনা

মোটামুটি সুলভ-দর্শন এই প্রজাতির উড়ান দ্রুত ও এলোমেলো; তীরের বেগে ধেয়ে উড়ে যায়। মাঝেমধ্যেই এরা দ্রুতবেগে উড়ে আচমকা বাঁক নিয়ে আবার পূর্বের অবস্থানেই ফিরে আসে। জঙ্গল ও ঝোপঝাড়ের আলোছায়া পরিবেশে ও জঙ্গলস্থ নদী বা ঝর্ণার কিনারে এদের উড়ে বেড়াতে দেখা যায় ।এদের দেহের সাদা-কালো (কালচে খয়েরি) বর্ণ সম্ভবতঃ আলোছায়া পরিবেশের সাথে মানানসই হয়ে আত্মগোপনে (camouflage) সহায়তা করে।[১১] এরা মাটির কাছাকাছি নিচ দিয়ে ওড়ে। এই স্কিপার প্রজাতি পাতার অগ্রভাগে, গাছের ডালে, মাটি ও পাথরে ডানা বন্ধ ও আধমেলা অবস্থায় রোদ পোহায়; পিছনের ডানা আড়াআড়ি ছড়িয়ে এবং সামনের ডানা কৌণিক অবস্থানে উঁচু করে রেখে বসে। ফুলে বসে মধুপান এবং পাখির বিষ্ঠা, গোবর, ভিজে মাটি, নদী কিনারের ভিজে বালি ও পাথরের ভিজে ছোপে বসে খ্যাদরস পান করতে এদের মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। এমনিতে এদের স্বভাব সুস্থির ও যথেষ্ট কাছে গেলেও সহজে বিরক্ত হয় না বা উড়ে যায় না।[১২] এই স্কিপার প্রজাতি ফুলের মধু আহরণের উদ্দেশ্যে বাগানেও হাজির হয় এবং আহার্য উদ্ভিদের পাতায় ডিম পাড়ে। পাহাড়ি জঙ্গল এবং সমতলের জঙ্গল ও ঝোপঝাড় বিশিষ্ট অঞ্চলে বর্ষাকালে এদের সংখ্যাধিক্য লক্ষ্য করা যায় যা বর্ষার ঠিক পড়ে আরো বাড়ে। কাপতাই মূলত পর্ণমোচী ও প্রায়-চিরহরিৎ বনাঞ্চলে বসবাসকারী প্রজাতি। হিমালয়ের পার্বত্য জঙ্গলে ১৫০০ মি,(৫০০০ ফুট) এবং দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি জঙ্গলে ২৪০০ মি,(৮০০০ ফুট) উচ্চতা পর্যন্ত এদের বিচরণ চোখে পড়ে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ ও মে থেকে অক্টোবর মাসে। উইন্টার ব্লাইথ লিখেছেন, এই প্রজাতিকে আদা ও হলুদ গাছে মাঝেমধ্যে দেখা যায়। পাহাড়ী জঙ্গলের বেশি ফাঁকা অংশে এদের দর্শন অধিক মেলে।[৬]

মধু সংগ্রহকারী উদ্ভিদ সম্পাদনা

কাপতাই প্রজাতি ফুলের মধু পান করতে খুব ভালোবাসে এবং এদের চোষক নলটি দেহের আকৃতির তুলনায় বেশ লম্বা হয়। এর ফলে লম্বা নালিযুক্ত ফুলের মধু পান করতে এদের অসুবিধা হয় না। নয়নতারা এবং Lantana এদের ভীষন পছন্দের ফুল এবং এই ফুলগুলির টানেই এরা প্রায়শই বাগানে হাজির হয়। এছাড়া এদের Hymenocallis littoralis, Tabernaemontana coronaria, কেও ইত্যাদি উদ্ভিদের ফুলের মধু পান করতে দেখা যায়।

বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

ডিম সম্পাদনা

সদ্য পাড়া ডিম লাল, পরবর্তীকালে ডিমের উপরের অংশটুকু লাল থাকে ও বাকিটা সাদা হয়ে যায়।[৪]

শূককীট সম্পাদনা

শুককীট হালকা সবুজ ও পিঠের উপর দৈর্ঘ্য বরাবর একটি গাঢ় সবুজ রেখা দেখা যায়। শরীরের মাঝের অংশ বেশি চওড়া বা স্ফীত এবং দুপাশে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। মাথা কালচে বর্ণের। পাতার একটা তিনকোনা অংশ কেটে ভাঁজ করে তার মধ্যে শুককীট অবস্থান করে। কৃষ্ণমেঘ কুন্তের মতানুসারে, কাপতাই এর শুককীট এই পত্র-নিবাস ছেড়ে একপাও নড়তে চায় না, এমনকি প্রবল বৃষ্টিতে বাসায় জল ঢুকে গিয়ে মৃত্যু হলেও সে বাসা ত্যাগ করে না।[৪][১৩]

আহার্য উদ্ভিদ সম্পাদনা

এই শূককীট Curcuma aromatica, Curcuma decipiens, Curcuma pseudomontana, Zingiber spp.[১] গাছের কচি পাতার রসালো অংশ আহার করে।[১৪]

মূককীট সম্পাদনা

মুককীটের বর্ণ শুককীটের মতোই হালকা সবুজ ও দেহে কোনো দাগ-ছোপ চোখে পড়ে না। শরীরের শেষভাগ ক্রমশ সরু হয়ে খুব তীক্ষ্ণ বা সুঁচালোভাবে শেষ হয়েছে। এর মুখের নলটি বেশ বড় এবং সেটি ডানার আবরণী অংশ ছাড়িয়ে মূল শরীর থেকে আলাদাভাবে বাইরে বেরিয়ে আসে।[৪]

জীবনচক্রের চিত্রশালা সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. A Pictorial Guide Butterflies of Gorumara National Park (2013 সংস্করণ)। Department of Forests Government of West Bengal। পৃষ্ঠা ৩১১। 
  2. Cramer, Pieter (১৭৭৫)। De uitlandsche kapellen, voorkomende in de drie waereld-deelen Asia, Africa en America। Amsteldam: Chez S.J. Baalde; A Utrecht: Chez Barthelmy Wild। পৃষ্ঠা 118, 74। 
  3. Watson, E. Y. (১৮৯১)। Hesperiidae Indicae: being a reprint of descriptions of the Hesperiidae of India, Burma, and Ceylon। Madras: Vest and Company। পৃষ্ঠা 125। 
  4. দাশগুপ্ত, যুধাজিৎ (২০০৬)। পশ্চিমবঙ্গের প্রজাপ্রতি (১ম সংস্করণ সংস্করণ)। কলকাতা: আনন্দ। পৃষ্ঠা ১৬১। আইএসবিএন 81-7756-558-3 
  5. Isaac, Kehimkar (২০০৮)। The book of Indian Butterflies (ইংরেজি ভাষায়) (1st সংস্করণ)। নতুন দিল্লি: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ৯৬। আইএসবিএন 978 019569620 2 
  6. Wynter-Blyth, M.A. (১৯৫৭)। Butterflies of the Indian region (First Edition সংস্করণ)। Bombay: The Bombay Natural History Society। পৃষ্ঠা ৪৯০। 
  7. Swinhoe, Charles (১৯১২–১৯১৩)। Lepidoptera Indica. Vol. X। London: Lovell Reeve and Co.। পৃষ্ঠা 205। |}}
  8. Varshney, R.; Smetacek, P.। A Synoptic Catalogue of the Butterflies of India. (2015 সংস্করণ)। New Delhi: Butterfly Research Centre, Bhimtal and Indinov Publishing। পৃষ্ঠা 49। 
  9. Moore, Frederic (১৮৮০)। The Lepidoptera of Ceylon। London: L. Reeve & co.। পৃষ্ঠা 177। 
  10. Inayoshi, Yutaka। "Udaspes folus (Cramer,[1775])"Butterflies in Indo-China। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৩-৩১ 
  11. Evans, W. H. (১৯৪৯)। A Catalogue of the Hesperiidae from Europe, Asia, and Australia in the British Museum। London: British Museum (Natural History). Department of Entomology। পৃষ্ঠা 292। 
  12. বসু রায়, অর্জন; বৈদ্য, সারিকা; রায়, লিপিকা। সুন্দরবনের কিছু পরিচিত প্রজাপতি (মার্চ ২০১৪ সংস্করণ)। সুন্দরবন জীবপরিমণ্ডল,Department of Forest Government of West Bengal। পৃষ্ঠা 120। 
  13. Savela, Markku। "Udaspes folus (Cramer, [1775])"Lepidoptera and Some Other Life Forms। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ৩, ২০১৮ 
  14. Pratap Singh, Arun (২০১১)। Butterflies of India (1st সংস্করণ)। Utter Pradesh: Om Books International। পৃষ্ঠা 174। আইএসবিএন 978-93-80069-60-9