ইলা ঘোষ

প্রথম বাঙালি নারী প্রকৌশলী

ইলা ঘোষ (বিবাহের পূর্বে ইলা মজুমদার) (২৪ জুলাই ১৯৩০ – ১১ ডিসেম্বর ২০১৯) ছিলেন প্রথম ভারতীয় বাঙালি মহিলা প্রকৌশলী এবং পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের প্রথম মহিলা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম ছাত্রী ছিলেন তিনি।। []

ইলা ঘোষ
জন্ম২৪ জুলাই ১৯৩০
মৃত্যু১১ ডিসেম্বর ২০১৯
পেশাপ্রকৌশলী
পরিচিতির কারণপ্রথম বাঙালি নারী প্রকৌশলী
ইলা ঘোষ (মজুমদার) ১৯৪৭/৪৮ খ্রিস্টাব্দে

জন্ম, শিক্ষা ও প্রারম্ভিক জীবন

সম্পাদনা

ইলা মজুমদার ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা যতীন্দ্র কুমার মজুমদার ছিলেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ইলারা ছিলেন  ছয় বোন ও দুই ভাই। [] পিতার বিভিন্ন স্থানে বদলির কারণে বিদ্যালয়ের পাঠ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। খুলনার এক স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। কিন্তু তিনি মুক্ত পরিবেশেই ছেলেবেলা অতিবাহিত করেছেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয় উত্তেজনার কারণে তারা কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন, কিন্তু পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয়নি। তিনি দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট (আই.এস.সি-তে) পাশ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার কারিগরি বিদ্যায় আকর্ষণ ছিল। [] সংযোগবশত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, নিকুঞ্জ বিহারী মাইতির উদ্যোগে মহিলাদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং–সহ শিক্ষার সব ক্ষেত্রের পড়ার দরজা খুলে দেওয়া হলে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারির দুটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই ভর্তি হন। সহপাঠিনী হিসাবে ছিলেন অজন্তা গুহ, কিন্তু তিনি একবছর পরে বাদ পড়ে যান।তখন কলেজে ভারতীয় এবং ইউরোপীয়ান মিলিয়ে আট শতাধিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে, ভারতবর্ষের প্রথম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একমাত্র ছাত্রী ছিলেন ইলা মজুমদার। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজী দৈনিক টেলিগ্রাফের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন -

"পুরো ব্যাচের মধ্যে একটি মাত্র মেয়ে ছিল। প্রথমদিকে ছেলেরা হতবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শীঘ্রই আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, খোশগল্প করতাম, ঠাট্টা করতাম। ক্রিকেট খেলার সময় বন্ধুদের উৎসাহ দিতাম, ছেলে সহপাঠীদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মিশতাম, একজন মেয়ে হয়ে কখনই অস্বস্তি বোধ করিনি।"

[]

কর্মজীবন

সম্পাদনা

স্নাতক হওয়ার পর শিক্ষানবিসির ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনার জন্য স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো যান এবং সেখানকার ‘বার অ্যান্ড স্টাইড’- সংস্থা থেকে স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা নেন। ভারতে ফিরে  ইলা মজুমদার দেরাদুনের ‘অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি’ -এর ভারী যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাতে প্রথম  কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে ছয় মাস চাকরি করার পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি পলিটেকনিক কলেজে প্রভাষক হন। এখানে কর্মরত অবস্থায় অতি অল্প সময়ে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উপর দুটি বই - “অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স থ্রু ওয়ার্কড একজাম্পেল্স” এবং “হাইড্রলিক্স থ্রু ওয়ার্কড একজাম্পেল্স” প্রকাশ করেন। [] ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিবাহের পর তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন এবং ইন্সটিটিউট অব জুট টেকনোলজি-তে লেকচারার পদে যোগ দেন। এখানে কর্মরত অবস্থায় তিনি  কলকাতার প্রথম মহিলা পলিটেকনিক কলেজ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। ১৯৬৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, তার উদ্যোগে কলকাতার গড়িয়াহাট রোডে বাংলার প্রথম মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (Women’s Polytechnic College, Kolkata) প্রতিষ্ঠা হলে তিনি প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। প্রথমদিকে মেয়েদের উপযুক্ত আর্কিটেকচার এবং ইলেকট্রনিক্স নিয়েই পঠন পাঠন শুরু হয়। তাঁর বিস্তৃত এই কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে তাদের প্রকল্পে বাংলাদেশের ঢাকাতেও একটি মহিলা পলিটেকনিক কলেজ খোলার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে অধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি দিতে রাজি না হলেও পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশে যান এবং তাঁরই তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পলিটেকনিক কলেজ ঢাকায় স্থাপিত হয় এবং এক বিরল কীর্তির অধিকারিণী হন। []

১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অনুষ্ঠিত মহিলা প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞানীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। []

বেঙ্গল  ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, শিবপুরের গ্লোবাল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে এক সাক্ষাৎকারে, তিনি তার কর্মজীবনে যে লিঙ্গ বৈষম্যের বা পক্ষপাতের মুখোমুখি হয়েছেন, সে প্রসঙ্গে বলেছেন-

“আমি অবশ্যই আমার পেশাগত জীবনে সব সময় লিঙ্গ বৈষম্য ও পক্ষপাতের মুখোমুখি হয়েছি। আমার মনে হয়েছে সমাজের মানসিকতা বদলাতে অনেক সময় লাগবে এবং তা সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু যখন নির্বাচন/পদোন্নতির সময় আসে তখন কষ্ট হয়, কর্তৃপক্ষ কীভাবে একজন নারীকে তার উপযুক্ত জায়গা না দেওয়ার জন্য তুচ্ছ অজুহাত খাড়া করেন, কারণ তারা মনে করে পুরুষের ওপর তার কর্মকর্তা হওয়ার কথা নয়। এটি সহ্য করতে হয়েছিল।

ব্যক্তিগত জীবন

সম্পাদনা

ইলা মজুমদার ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিবাহের পর ঘোষ পদবি নেন। ঘোষ দম্পতির দুই পুত্র (১৯৬০, ১৯৬৭) ও এক কন্যার জন্ম হয়েছিল, কিন্ত কন্যা ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যায়। তাদের দুই পুত্রই আইআইটি ,খড়গপুরের প্রাক্তনী। []

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "First Female Engineer Alumnus of BEC Passes Away."www.gaabesu.in (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-১০ 
  2. "Lone woman in the classroom"www.telegraphindia.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-১০ 
  3. Koerner, Emily Rees (২০২০-১২-০৪)। "Who went to the International Conference of Women Engineers and Scientists (ICWES) in 1964 and 1967?"Electrifying Women (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-১০ 
  4. Chakraborty, Tanusree। ""Ila Ghose ('51ME), the first woman engineer from Bengal Engineering College." Alumni Link – a publication of the Global Alumni Associations of Bengal Engineering and Science University, Shibpur." (পিডিএফ)