আব্দুল মান্নান চৌধুরী (শিক্ষাবিদ)

বাংলাদেশী একাডেমিক

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী (জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৪৮) বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা। সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ উপাচার্য ছিলেন [১]ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রাক্তন অধ্যাপক .[২] । তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সান্ধ্যকালীন এমবিএ প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
উপাচার্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ 
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম (1948-01-01) ১ জানুয়ারি ১৯৪৮ (বয়স ৭৬)
কুমিল্লা
জাতীয়তাবাংলাদেশী
দাম্পত্য সঙ্গীমোর্শেদা চৌধুরী
শিক্ষাপি এইচ ডি (লন্ডন), এমবিএ (ম্যানচেস্টার ), বি কম অনার্স. & এম কম, ঢাকা.
জীবিকাশিক্ষাবিদ, লেখক, দক্ষ সংগঠক, কলামলিস্ট, উপাচার্য

শিক্ষা সম্পাদনা

জনাব চৌধুরী কুমিল্লা শহরের থিরাপুকুর পাড় ফ্রি প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পরবর্তীতে কুমিল্লাজেলা স্কুল থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি; কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এইচএসসি; এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন [৩] । উল্লেখ্য যে তিনি ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী বা বিভাগে উত্তীর্ণ হোন। তিনি লন্ডন থেকে পিএইচডি, ম্যানচেস্টার বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ [২]

কর্মজীবন সম্পাদনা

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সিলেকশান গ্রেড প্রফেসর ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে ওয়ার্ল্ড ইউনিভাসিটি অব বাংলাদেশ এর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ছাড়াও তিনি অপরাপর তিনটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও প্রবৃদ্ধির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তদুপরি নাইজেরিয়ার বায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ডীন, বিভাগীয় প্রধান, সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট, ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান এম.আই.এস. বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা বিভাগের সান্ধ্যকালীন এম.বি.এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগেও অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন অনন্য মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তি সংগ্রামী। তিনি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অন্যতম উপদেষ্টা।  

প্রশাসনিক সম্পাদনা

চৌধুরির কিছু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের প্রাক্তন পরিচালক ছিলেন [৪] । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৯-১৯৯৯), ফিনান্স কমিটির সদস্য, জাতীয় মাদক ও মাদকদ্রব্য বোর্ড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয়, বাংলাদেশ সরকার (১৯৯৮) এবং জেল সংস্কার কমিটি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রানায় সদস্য [২] । তিনি ম্যানচেস্টার বিজনেস স্কুল অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলারস অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ এবং ন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং অন্যান্য অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের আজীবন সদস্য।

ছাত্রজীবনে স্বাধীকার আন্দোলন সম্পাদনা

ছাত্রজীবনে পড়াশুনার পাশাপাশি রাজনীতির প্রতি তার ছিল প্রচন্ড ঝোঁক। সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই তিনি পাকিস্তানী গোয়েন্দার কোপানলে পড়েন। স্কুল জীবনেই তিনি তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাথে জড়িত হন। তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ১৯৬৩ সালে কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হন ও ১৯৬৫ সালের আয়ূব বিরোধী নির্বাচনে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়ে তিনি তদানিন্তন আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবের সংস্পর্শে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তিনি আরও সক্রিয় ভাবে আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত হোন। এই সময়ে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে দু’দুবার সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

ছাত্র রাজনীতির সম্পূরক হিসাবে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট শিল্প ও সাহিত্য সংঘ এর সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে তিনি শিল্প ও সাহিত্য সংঘ এর সাহিত্য সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত সময়ে তিনি ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি, সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স এসোসিয়েশনে ক্রীড়া সম্পাদক, ম্যাগাজিন সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সময়টার গুরুত্ব অপরিসীম। জনাব চৌধুরী ভালো ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসের স্বপ্ন দেখেননি। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করলে তিনি নিজকে এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে ফেলেন। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুনের হরতালে যারা সাড়া বাংলাদেশকে অচল করে দিয়েছিল, তিনি তাদের একজন। সেদিন কার্জন হলের সামনে হরতালের সমর্থনে পিকেটিং করতে গেলে পুলিশ তার মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। সৌভাগ্যক্রমে গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলে তিনি বেঁচে যান। সেদিন তিনি পুলিশের হাতে নির্যাতিত হন, বন্দী হয়েও কৌশলে মুক্তি লাভ করেন। তবে সেদিন থেকেই তিনি বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট) এর সাথে সরাসরি যুক্ত হোন যা মুক্তিযুদ্ধ কালে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। জনাব চৌধুরী ১৯৬৯ এর ১১ দফা আন্দোলন সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রার্থী না হয়েও সক্রিয় নির্বাচনী প্রচারনায় নামেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে বাণিজ্য অনুষদে রূপান্তরের দাবী তিনিই ১১ দফা আন্দোলনে অন্তর্ভূক্ত করেন এবং তা বাস্তবায়নে তিনি পথিকৃত ব্যক্তিত্ব।

মুক্তিযুদ্ধা সম্পাদনা

চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন [৫] । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জনাব চৌধুরী প্রকাশ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারপর ভারতে গমনের পর মনস্তাত্বিক যুদ্ধের হাতিয়ার হিসাবে ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা, প্রকাশনা ও উপ-সম্পাদকীয় লেখার জন্য যথাক্রমে আবুল হাসান চৌধুরী, আবদুল মমিন চৌধুরী ও মোজাম্মেল হক চৌধুরী ছদ্ম নাম ব্যবহার করেন। তিনি অনেক সময় বাংকারে বসেও সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন। ১৯৭১ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আরেফিন রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তির অবস্থান’, এবং হাসিনা খান ও মুনতাসির মামুন সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ এবং হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থের একাধিক পৃষ্ঠায় তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভারতের দেরাদুনের মিলিটারী একাডেমীতে গেরিলা যুদ্ধের পুনঃপ্রশিক্ষন গ্রহন করেন এবং পরবর্তীতে মুুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কোষাধ্যক্ষ, উপ-অধিনায়ক ও স্বল্প কালীন অধিনায়কের দায়িত্ব পালন ছাড়াও মুজিব বাহিনীর হয়ে মিত্র বাহিনীতে পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কুমিল্লার প্রশাসনিক পূর্নগঠনের কাজে সহায়তা করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদে সামিল হোন এবং ইনডেমনিটি বিল বাতিলের আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তিনি জনতার মঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা-জনতার মঞ্চের অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনে তিনি এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৯২ সালে গণ-আদালত অনুষ্ঠানের অভিযোগে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় জড়ানো হয়। অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে স্পর্শকাতর। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ১৬ একর জমির উপর তিনি প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আবাসিক প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। প্রথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের আহবায়ক হিসাবে দুঃস্থ শিক্ষকদের মঙ্গলার্থেই প্রায় ১৬ কাঠা জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্টের তিনি ভাইস চেয়ারম্যান এবং শ্যামলীর মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপদেষ্টা ছিলেন। [৬]

গ্রন্থ সম্পাদনা

  • মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিক কথা[৭]
  • শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা[৭]
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও রটনা[৭]
  • বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মারক গ্রন্থ[৭]
  • মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঘাতক দালাল প্রসঙ্গে[৭]
  • Leaders, Leadership & Politics in Bangladesh[৭]
  • অরাজনীতিকের রাজনীতি[৭]
  • নেতা, নেত্রী ও নেতৃত্ব[৭]
  • মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঘাতক দালাল প্রসঙ্গ[৭]
  • ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনে স্মৃতিবাহী ১৯৯৩ সাল[৭]
  • মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী[৭]
  • বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে নিয়ে মিথ্ ও মিথ্যাচার[৭]
  • আমার মা ও অমরাবতীর কতিপয় সন্তান[৭]
  • দুই দেহ এক প্রাণ[৭]
  • সুচিত্রা সেন স্মারক গ্রন্থ[৭]
  • নির্বাচন নিয়ে যত কথা[৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "উপাচার্য তথ্য"World University of Bangladesh। ১২ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  2. Shemul, Hasanuzzaman (৮ মে ২০০৯)। "আব্দুল মান্নান চৌধুরী"Modern Ghana। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ 
  3. "Education references"। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  4. "কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের প্রাক্তন পরিচালক" 
  5. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড স্মৃতি : অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী। ২৯ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  6. "উপদেস্টা" 
  7. "Professor Dr. Abdul Mannan Chowdhury Books: অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী এর বই সমূহ | Rokomari.com"www.rokomari.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০২