আল আকরা ইবনে হাবিস (মৃত্যু: ৬৫১) মুহাম্মাদের একজন প্রখ্যাত সাহাবা ছিলেন।[১][২] তিনি বিভিন্ন মুহাম্মাদ থেকে উসমান পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ইসলামী দায়িত্ব পালন করেছেন।[৩][৪]

নাম ও বংশ পরিচয় সম্পাদনা

আল আকরা ইবনে হারিসের বংশাক্রমানুক নাম হল আল আকরা ইবনে হাবিস ইবনে ইকাল ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সুফয়ান আল-মুজাশিঈ আদ-দারিমী।[৫][৬] তার পিতার নাম হাবিস ইবনে ইকাল। আকরা জাহেলি যুগে ও ইসলামী যুগে উভয় যুগেই তার গােত্রের একজন বিশিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তার প্রকৃত নাম ছিল ফিরাস। মাথায় টাক থাকায় তিনি আল আকরা নামে পরিচিত ছিলেন এবং পায়ে সমস্যা থাকার কারণে তাকে আল আরাজ বলা হতো।[৭][৮][৯]

তার ভাইয়ের নাম ছিল মুরশিদ ইবনে হাবিস এবং বোনের নাম ছিল লায়লা বিনতে হাবিস, তার বোন দেখতে অনেকটা কবি ফারাজদাকের মত ছিল। আল আকরার চাচাত ভাই ইয়াদ ইবনে হিমার জাহিলী যুগ হতে মুহাম্মাদের একজন বন্ধু ছিলেন।[১০][১১]

ইসলাম পূর্ব যুগে সম্পাদনা

আল-আকরার বংশ অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ছিল। তিনি জাহিলী যুগের অন্যতম গোত্রীয় বিচারক ছিলেন।[১২] তৎকালে উকাজের মেলায় বিচার ও সালিসের দায়িত্ব বনু তামীম গােত্রের উপর ন্যস্ত ছিল। বংশানুক্রমে ইসলামের আবির্ভাবের সময় বিচার কার্যের এই দায়িত্ব আকরা ইবনে হাবিসের উপর অর্পিত ছিল।[১৩] ইবনে কুতায়বা ও ইবনে কালবীর মতে তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে অগ্নিপূজক ছিলেন।[১৪][১৫][১৬]

ইসলাম গ্রহণ সম্পাদনা

তিনি মক্কা বিজয়ের পূর্বে মতান্তরে পরে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কা বিজয়, হুনায়ন ও তায়েফের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুহাম্মাদ হাওয়াযিনের অভিযান থেকে প্রাপ্ত গনীমতের মাল হতে আল আকরা ইবনে হাবিসকে ১০০ উট প্রদান করেন।[১৭] তাঁহার এই উপহার পাইবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আব্বাস ইবনে মিরদাস আস সুলামী একটি কবিতা রচনা করেছেন।

একবার ইয়ামান হইতে কিছু স্বর্ণ উপটৌকন আসলে মুহাম্মাদ চারজন সাহাবীর মধ্যে সেইগুলি বিতরণ করে দেন, তাদের মধ্যে আল আকরাও ছিলেন।[১৮][১৯]

গোত্রীয় দায়িত্ব পালন সম্পাদনা

মুহাম্মাদ আকরা ইবনে হাবিসকে বনু দারিম ইবনে মালিক ইবনে হানজালা গােত্রের রাজস্ব আদায়কারী নিযুক্ত করেছিলেন।[২০][২১]

৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে নবম হিজরীর মুহাররম মাসে মুহাম্মাদ উয়ায়না ইবনে হিসন আল ফাযারীর নেতৃত্বে পঞ্চাশজন অশ্বারােহীর একটি বাহিনীকে আকরার গোত্র তামীম গোত্রের একটি শাখার বিরুদ্ধে প্রেরণ করলে ঐ গােত্রের ১১ জন পুরুষ, ২১ জন মহিলা ও ৩০টি শিশু বন্ধী করা হয়। ফলে আকরা ইবনে হাবিসসহ ঐ গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল মুহাম্মাদের নিকট আসেন তাদের মুক্তির জন্য প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বন্দীদের মধ্যে তাদের নিজেদের পরিবার-পরিজনকে দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে চিৎকার করে মুহাম্মাদকে ডাকতে থাকে। এতে আল্লাহ্‌ অসন্তুষ্ট হয়ে সূরা আল-হুজুরাতের প্রথম কয়েক আয়াত নাযিল করেন।[২২][২৩][২৪]

হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না – সূরা আল-হুজুরাত; আয়াত: ২।

এক বর্ণনা অনুযায়ী আল আকরা নিজেই মুহাম্মাদকে চিৎকার করে ডাকছিল। আল আকরা নিজেই বলেছেন, ঐ সময় আমার মধ্যে জাহিলী ও বেদুঈনী স্বভাব বিদ্যমান ছিল এবং আমি অভদ্রভাবে চিৎকার করিতে শুরু করিলাম।[২৫][২৬]

আল আকরা ইবনে হাবিস মুহাম্মাদের নিকট বন্দীদের মুক্তির আবেদন করেন। বন্ধীদের মুক্তির পর তামীম গােত্র ইসলাম গ্রহণ করে। আল আকরা অবশ্য পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবু বকরের সুপারিশক্রমে আল আকরাকে তামীম গােত্রের নেতা নিযুক্ত করা হয়। নাজরানের প্রতিনিধি দলের সহিত মুহাম্মাদের যে চুক্তি সম্পাদনা হয় সেটাতে আল আকরা ইবনে হাবিস অন্যতম সাক্ষী ছিলেন।[২৭][২৮][২৯]

যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পাদনা

আল-আকরা ইবনে হাবিস খালিদ বিন ওয়ালিদের সাথে ইয়ামামাসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শুরাহবীল ইবন হাসানার সহিত দুমাতুল জান্দালের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। তিনি খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে ইরাকের যুদ্ধে শরীক হন এবং অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তিনি আনবার বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন।[৩০][৩১]

ইয়ারমুকের যুদ্ধে আল আকরা তার দশ পুত্রসহ শাহাদাত লাভ করেন, কিন্তু হাফিজ যাহাবী ও বালাযুরীর মতে “উসমান খিলাফাত আমলে আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল আকরা ইবনে হাবিসকে সেনাপতি করিয়া খুরাসান অভিযানে প্রেরণ করেন। সেইখানে তিনি ও তার সৈন্যবাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন।[৩২][৩৩]

মৃত্যু সম্পাদনা

কিছু ইতিহাসবিদ বলেন আকরা তিনি ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ইয়ারমুকের যুদ্ধে মারা যান। তবে অধিকাংশ ও হাফিয যাহাবী ও বালাযুরীর মতে, উসমান খিলাফত আমলে ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে (৩১ হিজরিতে) মারা যান।[৩৪][৩৫]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. ইসলামী বিশ্বকোষ (১ম খণ্ড)। পৃষ্ঠা ১৪৪। 
  2. উসদুল গাবা, ইবনুল আছীর, তেহরান ১২৮৬ হি.. ১খণ্ড। পৃষ্ঠা ১০৭। 
  3. ইবনে হাযম, জাওয়ামিউস সীরা, দারুল মা'আরিফ, মিসর তা, বি পৃষ্ঠা- ২৬, ২৪০ 
  4. ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়্যা, যাদুল মা'আদ, মিসর ১৯২৮ খৃ., ২খন্ড- ১৫০, ১৮৯ 
  5. ইবনে হাযম, জাওয়ামিউস সীরা, দারুল মা'আরিফ, মিসর তা, বি- ২৪৬, ২৫৯ 
  6. ইবনে কুতায়বা , কিতাবুল মা'আরিফ, কায়রাে ১৯৩৫ খৃ. ১৯৪/৩০৫ পৃষ্ঠা 
  7. ইবনে হাযম, জাওয়ামিউস সীরা, দারুল মা'আরিফ, মিসর তা, বি ২৪৬, ২৫৯ 
  8. ইবন সা'দ, আত -তাবাকাত, বৈরূত ১৩৮৮/১৯৬৮, ১খন্ড- ২৮৮, ২৯৪ 
  9. ইবনে কুতায়বা, কিতাবুশ শি'র ওয়াশ-শুআরা (সম্পা. আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির), কায়রাে ১৩৬৪-১৩৬৬ হি., নির্ঘণ্ট 
  10. ইবন সা'দ, আত -তাবাকাত, বৈরূত ১৩৮৮/১৯৬৮, ১খন্ড- ৪৪৭, ১৫৩, ১৬১ 
  11. ইবন সা'দ, আত -তাবাকাত, বৈরূত ১৩৮৮/১৯৬৮, ৪ খন্ড- ২৪৬, ২৭৩, ২৮২ 
  12. (ইসাবা, ১খণ্ড- ৫৮, নং ২৩১) 
  13. (আসওয়াকুল আরাব- ২৯১) 
  14. (আল-মা'আরিফ- ১৯৪) 
  15. ইবন আবদিল বার, আল-ইসতীআব, হায়দরাবাদ ১৩১৮ হি., ১খণ্ড- ৪৫ 
  16. ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়্যা, যাদুল মা'আদ, মিসর ১৯২৮ খৃ., ২খন্ড- ২০১, ২০৩ 
  17. (জাওয়ামিউস সীরা, আল-মুহাববার দ্রঃ) 
  18. আল-ইসাবা , ইবন হাজার আসকালানি, ১২ পৃষ্ঠা [ ১৩২৮ হি ] 
  19. ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়্যা, যাদুল মা'আদ, মিসর ১৯২৮ খৃ, ৩খন্ড., ৪০ 
  20. ইনুল কালবী, জামহাৱাতুল আনসাব, বৃটিশ মিউজিয়াম, পাণ্ডুলিপি নং ৩০২, পত্র ৬৫ 
  21. ইবন হিশাম, সীরা, নির্ঘণ্ট 
  22. ইবন হিশাম, আত্তারীখুস-সাগীর, এলাহাবাদ ১৩২৫ হি., ৩১ পৃষ্ঠা 
  23. আল-বালাযুরী, ফুতুহল বুলদান, কায়রাে ১৩১৯/ ১৯০১ পৃষ্ঠা নং- ৭২, ৪১৩ 
  24. আল-জাহিজ, আল-বায়ান, ১খন্ড- ২৩৬ 
  25. হাসসান ইবন ছাবিত, দীওয়ান, মিসর ১৯২৯ খৃ., পৃষ্ঠা নং- ৪৩, ২৫২, ৩৮৩ 
  26. আল-খানি, লুবাবুত তাবীল, মিসর ১৩২০ হি., ৬খণ্ড- ৪৩ 
  27. আয-যাহাবী, তাজরীদ আসুমাইস্ সাহা, হায়দরাবাদ ১১৫ হি., ১খন্ড- ২৭ 
  28. আয-যামাখশারী, আল-কাশশাফ, মিসর ১৩৫৪ হি., ৪খণ্ড- ৭ 
  29. সাঈদ আহমাদ আকবারাবাদী, সিদ্দিক আকবার, দিল্লী ১৯৫৭ খৃ., পৃষ্ঠা- ২৫৮, ২৬৩ 
  30. (তাজরীদ আসমাইস সাহাবা, ১খণ্ড- ২৬) 
  31. আস-সুয়ুতী, লুবাবুন-নুকুল ফী আসবাবিন নুযুল, মিসর ১৯৩৫ খৃ পৃষ্ঠা- ২০১ 
  32. আত-তাবারী, তারীখ, নির্ঘণ্ট 
  33. মুহাম্মাদ ইবনে হাবিব, কিতাবুল মুহাব্বার, হায়দরাবাদ ১৩৬১ হি., নির্ঘণ্ট 
  34. মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল, আবু বাকর আস-সিদ্দীক, মিসর ১খণ্ড- ৩৬১, পৃষ্ঠা- ২৩৭, ২৪১, ২৪৩ 
  35. আন-নওয়াবী তাহযীবুল আসমা, মিসর, ১খণ্ড- ১২৪