আইনসভা

আইন পাস, বাতিল ও সংশোধনের ক্ষমতা সম্পন্ন সেচ্ছাকৃত সমাবেশ

আইনসভা হলো একটি দেশ বা শহরের মতো রাজনৈতিক সত্তার জন্য আইন তৈরি করার কর্তৃত্ব সহ একটি সুচিন্তিত পরিষদ। আইনসভা বেশিরভাগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করে; ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ মডেলে তারা প্রায়শই সরকারের নির্বাহী বিভাগবিচার বিভাগের বিপরীত হয়ে থাকে।

আইনসভা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। চিত্রে ফিনল্যান্ডের সংসদ।

আইনসভা দ্বারা প্রণীত আইনগুলি প্রাথমিক আইন হিসাবে পরিচিত। আইনসভা প্রশাসনিক ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা করে এবং সাধারণত বাজেট বা বাজেট সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সংশোধন করার একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকে।

কোন আইনসভার সদস্যদের আইন-প্রণেতা বলা হয়। গণতান্ত্রিক দেশে আইন-প্রণেতারা সাধারণত জনপ্রিয় ভোটে নির্বাচিত হন, যদিও নির্বাহী কর্তৃক পরোক্ষ নির্বাচন এবং মনোনয়ন দ্বারাও এটি গঠিত হয়, বিশেষত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাগুলির উচ্চকক্ষে এটি ঘটে থাকে।

পরিভাষা

সম্পাদনা
 
মানচিত্রে প্রতিটি দেশের জাতীয় আইনসভার নাম দেখানো হয়েছে

বিভিন্ন দেশের উপর নির্ভর করে জাতীয় আইনসভার নামগুলির মধ্যে রয়েছে "সংসদ", "কংগ্রেস", "ডায়েট" এবং "পরিষদ"।

অভ্যন্তরীণ সংস্থা

সম্পাদনা

আইনসভার প্রতিটি কক্ষ বেশ কিছু সংখ্যক আইন-প্রণেতা নিয়ে গঠিত হয় যারা রাজনৈতিক ইস্যুতে সংসদীয় বিধিতে বিতর্কে অংশ নেয় এবং প্রস্তাবিত আইনের উপর ভোট প্রদান করে। এই কার্যপদ্ধতি পরিচালনার জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আইন-প্রণেতাকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে; এটিকে কোরাম বলে।

কোন আইনসভার কিছু দায়িত্ব থাকে যেমন নতুন প্রস্তাবিত আইনকে প্রথমে বিবেচনা করার জন্য সাধারণত কক্ষের কিছু সদস্যদকে নিয়ে গঠিত কমিটিতে পাঠানো হয়।

আইনসভার সদস্যরা সাধারণত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন; প্রতিটি দলের সদস্যরা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি সংগঠিত করার জন্য সাধারণত ককাস হিসাবে মিলিত হন।

ক্ষমতা

সম্পাদনা

বিচারপতি, সামরিক বাহিনী এবং নির্বাহী বিভাগের মতো অন্যান্য রাজনৈতিক অংশের তুলনায় আইনসভা ব্যাপক পরিমাণে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এম. স্টিভেন ফিশ এবং ম্যাথু ক্রোয়েনিগ জাতীয় আইনসভাগুলির মধ্যে ক্ষমতার বিভিন্ন মাত্রা পরিমাপের জন্য একটি সংসদীয় ক্ষমতা সূচক তৈরি করেন। জার্মান বুন্দেসট্যাগ, ইতালীয় সংসদ এবং মঙ্গোলিয়ার রাজ্য বৃহৎ খুরাল সবচেয়ে শক্তিশালী, যেখানে মিয়ানমারের প্রতিনিধি পরিষদ এবং সোমালিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় পরিষদ (সোমালিয়া কেন্দ্রীয় সংসদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার পর থেকে) সবচেয়ে কম শক্তিশালী।[]

কিছু রাজনৈতিক ব্যবস্থা আইনসত্তা আধিপত্যের নীতি অনুসরণ করে, যার অধীনে আইনসভা সরকারের সর্বোচ্চ শাখা এবং বিচার বিভাগ বা লিখিত সংবিধানের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। এই জাতীয় ব্যবস্থা আইনসভাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

সংসদীয় এবং আধা-রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে নির্বাহী বিভাগ আইনসভার নিকট দায়বদ্ধ, যা অনাস্থা ভোট দিয়ে অপসারণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে, ক্ষমতা পৃথকীকরণ মতবাদ অনুসারে, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে আইনসভাকে বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ও সমকক্ষ শাখা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[]

আইনসভাগুলি কখনও কখনও তাদের আইনি ক্ষমতা প্রশাসনিক বা নির্বাহী সংস্থাগুলির হাতে অর্পণ করে।[]

আইনসভাগুলি পৃথক সদস্য নিয়ে গঠিত, যারা আইন-প্রণেতা হিসাবে পরিচিত এবং প্রস্তাবিত আইনের উপর ভোট দেয়। একটি আইনসভায় সাধারণত নির্ধারিত সংখ্যক আইন-প্রণেতা থাকে; যেহেতু আইনসভায় সাধারণত আইন-প্রণেতাদের আসনে ভরা একটি নির্দিষ্ট ঘরে মিলিত হন, এটিকে প্রায়শই এতে থাকা "আসন" সংখ্যা দ্বারা বর্ণনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যে আইনসভায় ১০০টি "আসন" আছে তার ১০০ জন সদস্য আছে। বিস্তারিত ভাবে, একটি নির্বাচনী জেলা যা একজন আইন-প্রণেতাকে নির্বাচিত করে সেটিকে একটি "আসন" হিসাবেও বর্ণনা করা যায়, উদাহরণস্বরূপ, "নিরাপদ আসন" এবং "দোদুল্যমান আসন" আখ্যায়িত করা যায়।

 
The Congress of the Republic of Peru, the country's national legislature, meets in the Legislative Palace in 2010

কোন আইনসভা বিলকে একক হিসাবে বিতর্ক করতে এবং ভোট দিতে পারে, আবার এটি একাধিক পৃথক পরিষদের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে, যাদেরকে আইনসভা কক্ষ, বিতর্ক কক্ষ এবং হাউস সহ বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, যেগুলি আইনের উপর তর্কবিতর্ক করে ও পৃথকভাবে ভোট দেয় এবং স্বতন্ত্র ক্ষমতা ধারণ করে। একটি আইনসভা যা একক ইউনিট হিসাবে কাজ করে তাকে এককক্ষবিশিষ্ট,  দুটি কক্ষে বিভক্ত আইনসভাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং তিনটি কক্ষে বিভক্ত আইনসভাকে ত্রিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বলে।

 
The British House of Commons, its lower house

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় একটি কক্ষ সাধারণত উচ্চকক্ষ হিসাবে এবং অন্যটি নিম্নকক্ষ হিসাবে বিবেচিত হয়। দুটি কক্ষ কঠোরভাবে পৃথক নয়, তবে উচ্চকক্ষের সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত না হয়ে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হয়ে থাকে, জনসাধারণের চেয়ে প্রশাসনিক বিভাগ দ্বারা নিয়োগ দেওয়া হয় এবং নিম্নকক্ষের সদস্যদের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী হয়ে থাকে। কিছু পদ্ধতিতে বিশেষত সংসদীয় পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কম থাকে এবং অধিকতরভাবে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে থাকে, তবে অন্য পদ্ধতির মধ্যে, বিশেষত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে উচ্চ কক্ষ সমান বা বেশি ক্ষমতাধর হয়ে থাকে।

 
The German Bundestag, its theoretical lower house

যুক্তরাষ্ট্রিয় পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গ রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আধিজাতিক আইনসভা এর একটি উদাহরণ। উচ্চ কক্ষে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি থাকতে পারে - যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জার্মানি এবং ১৯১৩ সালের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে - অথবা এমন একটি সূত্র অনুসারে নির্বাচিত হতে পারে যা ছোট জনগোষ্ঠীর রাজ্যগুলি সমান প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়, যেমনটি রয়েছে ১৯১৩ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অস্ট্রেলিয়ায়

 
The Australian Senate, its upper house

ত্রিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বিরল; ম্যাসাচুসেটস গভর্নর কাউন্সিলে এখনও তা বিদ্যমান, তবে সবচেয়ে সাম্প্রতিক জাতীয় উদাহরণ দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ-সংখ্যালঘু শাসনের ক্ষয়িষ্ণু বছরগুলিতে বিদ্যমান ছিল। চতুর্কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাগুলির অস্তিত্ব আর নেই, তবে এগুলি আগে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় বিদ্যমান ছিল।

আইনসভাগুলি বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। জাতীয় আইনসভাগুলোর মধ্যে চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস ২,৯৮০ জন সদস্য নিয়ে বৃহত্তম,[] এবং ভ্যাটিকান সিটির পন্টিফিক্যাল কমিশন ৭ জন সদস্য নিয়ে সবচেয়ে ছোট আইনসভা।[] কোন কোন আইনসভা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয় না: জাতীয় পিপলস কংগ্রেস পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়।[][]

আইনসভার আকার কার্যকারিতা এবং প্রতিনিধিত্বের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখে; আইনসভা যত ছোট হবে তত বেশি কার্যকারিতার সাথে এটি পরিচালনা করতে পারে তবে আইনসভা যত বড় হবে, তত বেশি তার নির্বাচনী এলাকাগুলির রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। জাতীয় আইনসভাগুলির তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে একটি দেশের নিম্নকক্ষের আকার তার জনসংখ্যার ঘনমূলের সাথে সমানুপাতিক বলে মনে হয়; অর্থাৎ নিম্নকক্ষের আকার জনসংখ্যার অনুপাতে বাড়তে থাকে, তবে তা অনেক ধীরে ধীরে।[]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Fish, M. Steven; Kroenig, Matthew (২০০৯)। The handbook of national legislatures: a global surveyCambridge University Pressআইএসবিএন 978-0-521-51466-8 
  2. "Governing Systems and Executive-Legislative Relations (Presidential, Parliamentary and Hybrid Systems)"। United Nations Development Programme। ২০০৮-১০-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১০-১৬ 
  3. Schoenbrod, David (২০০৮)। "Delegation"Hamowy, RonaldThe Encyclopedia of Libertarianism। Thousand Oaks, CA: SAGE; Cato Institute। পৃষ্ঠা 117–18। আইএসবিএন 978-1-4129-6580-4এলসিসিএন 2008009151ওসিএলসি 750831024ডিওআই:10.4135/9781412965811.n74 
  4. "IPU PARLINE database: "General information" module"IPU Parline Database। International Parliamentary Union। সংগ্রহের তারিখ ৩০ এপ্রিল ২০১৯ 
  5. "Vatican City State"। Vatican City State। ২৫ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ এপ্রিল ২০১৯ 
  6. Pope John Paul II (২৬ নভেম্বর ২০০০)। "Fundamental Law of Vatican City State" (পিডিএফ)। Vatican City State। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ এপ্রিল ২০১৯ 
  7. Frederick, Brian (ডিসেম্বর ২০০৯)। "Not Quite a Full House: The Case for Enlarging the House of Representatives"Bridgewater Review। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৫-১৫ 

আরও পড়ুন

সম্পাদনা

টেমপ্লেট:Separation of powers