মোজাফফর আহমদ (রাজনীতিবিদ)
মোজাফফর আহমদ (১৪ এপ্রিল ১৯২২ - ২৩ আগস্ট ২০১৯) ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কোপন্থী) সভাপতি ছিলেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ | |
---|---|
জন্ম | ১৪ এপ্রিল ১৯২২ দেবীদ্বার, কুমিল্লা |
মৃত্যু | ২৩ আগস্ট ২০১৯ |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশি |
শিক্ষা | স্নাতকোত্তর (অর্থনীতি), ইউনেস্কো ডিগ্রি |
মাতৃশিক্ষায়তন | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
পরিচিতির কারণ | ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) |
আদি নিবাস | কুমিল্লা |
দাম্পত্য সঙ্গী | আমিনা আহমদ |
পুরস্কার | স্বাধীনতা পদক, ২০১৫ |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সম্পাদনামোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[১] তার পিতার নাম আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া, মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। তার পিতা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মোজাফফর আহমদ যথাক্রমে হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক, দেবিদ্বার সরকারি রেয়াজ উদ্দিন পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ইউনেস্কো থেকে একটি ডিপ্লোমা লাভ করেন।[২]
কর্মজীবন ও রাজনীতিতে যোগদান
সম্পাদনাঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র জনাব মোজাফফর দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। শেষমেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। তার রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত বর্ণিল। রাজনীতি অঙ্গনে তার শুভসূচনা হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ জেলা কুমিল্লার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন রাজনীতির ময়দানের সবাইকে।[৩] আওয়ামীলীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ এর প্রতিনিধি নেতা হিশেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন। দীর্ঘ আট বছর সময়ব্যাপী আত্মগোপনে থাকবার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুর জেলায় অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী-এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। মস্কো শিবিরে পূর্ব পাকিস্তানপন্থী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত ছিল। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কারাবরণও করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
সম্পাদনাবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।[৩] উপদেষ্টা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ।[৪] তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন। সে সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নিজস্ব উনিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে অধ্যাপক আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
স্বাধীন বাংলার রাজনীতিতে পদচারণা
সম্পাদনাস্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[৩] ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলে তিনি ন্যাপ, সিপিবি এবং প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।[৩] স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আহমদ কারারুদ্ধ হন। রাজনীতি জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের নানান দেশে সফর করেন। তার সহধর্মিণী আমিনা আহমদ বর্তমানে ন্যাপের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সভানেত্রী হিসেবে আছেন বাংলাদেশ নারী সমিতিতে। ১০ম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।
গ্রন্থ প্রকাশনা
সম্পাদনা- সমাজতন্ত্র কি এবং কেন
- প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা
- মাওবাদী সমাজতন্ত্র ও কিছু কথা
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনা- স্বাধীনতা পদক, ২০১৫ (গ্রহণে অস্বীকৃতি)
বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দিলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।
ব্যক্তি জীবন
সম্পাদনাতার প্রয়াসে মদনপুরে তার প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের একমাত্র শিক্ষায়তন 'সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ'।[২] বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ দিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় এবং বিভক্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) একাংশের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর নিজেকে 'কুঁড়েঘরের মোজাফফর' বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম এ ব্যক্তিত্ব নিজেকে সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবেসেছেন আজীবন। অধ্যাপক আহমদ ব্যক্তিজীবনে কথাবার্তা বলতেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে; কখনো থাকে প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালির ছোঁয়া। তিনি কাছের মানুষদের কাছে একসময় বলতেন, "আমার নাম মোজাফফর আহমদে নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি"।
মৃত্যু
সম্পাদনাদীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট রাত ৭টা ৪৯ মিনিটে ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[৩][৫][৬]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "স্যারের কথা মনে পড়ে"। বিডিনিউজ২৪। বিভুরঞ্জন সরকার। ১৪ এপ্রিল ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৮।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ "একনজরে মোজাফফর আহমদ"। বাংলাদেশ প্রতিদিন। ১১ অক্টোবর ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৮।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই"। কালের কণ্ঠ। ২৩ আগস্ট ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০১৯।
- ↑ "অধ্যাপক মোজাফফর, বামপন্থা ও স্বাধীনতা"। প্রথম আলো (মতামত সংবাদ)। সোহরাব হাসান। ২৬ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৮।
- ↑ "না ফেরার দেশে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ"। সমকাল। ২৩ আগস্ট ২০১৯। ২৩ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০১৯।
- ↑ "চলে গেলেন ন্যাপ সভাপতি মোজাফ্ফর আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর শোক | জাতীয়"। ইত্তেফাক। ২৩ আগস্ট ২০১৯। ২৩ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০১৯।