আশাবাদ
আশাবাদ একটি মানসিক মনোভাব। আশাবাদ এবং নৈরাশ্যবাদের মাঝে বৈপরীত্য বোঝানোর জন্য একটি সাধারণ প্রবাদ ব্যবহার করা হয়, তা হল এক গ্লাস জল অর্ধেক পূর্ণ আছে, যেখানে একজন আশাবাদী বলবেন গ্লাসটি অর্ধেক ভর্তি, সেখানে একজন নৈরাশ্যবাদী বলবেন গ্লাসটি অর্ধেক খালি।
আশাবাদ শব্দটি ইংরেজি "Optimism" এর পারিভাষিক শব্দ। Optimism শব্দটি এসেছে ল্যাতিন Optimum থেকে যার অর্থ হল "সর্বোত্তম"। "আশাবাদী হওয়া" হল একটি ধারণা যার দ্বারা কোন প্রদত্ত অবস্থায় সাম্ভাব্য সর্বোত্তম ফলাফল এর আশা করাকে বোঝায়। একে সাধারণত মনোবিজ্ঞানে ডিসপজিশনাল অপটিমিজম বা স্বভাবগত আশাবাদ বলা হয়। এটা তাই একটি বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে যা বলে ভবিষ্যতের অবস্থা সর্বোত্তম হবে বলে দেখা যাবে।[১]
আশাবাদের তত্ত্বগুলোর মধ্যে ডিসপজিশনাল বা স্বভাবগত মডেল, ব্যাখ্যামূলক ধরনের মডেল অন্তর্ভুক্ত। এই দুটো তাত্ত্বিক ব্যবস্থাতেই আশাবাদ পরিমাপ করার পদ্ধতি বের করা হয়েছে, যেমন আশাবাদের উৎপত্তিগত সংজ্ঞা অনুসারে বিভিন্ন ধরনের জীবন অভিমুখিতা পরীক্ষা (Life Orientation Test), অথবা ব্যাখ্যামূলক ধরনের মডেল অনুসারে বৈশিষ্ট্যগত রীতির প্রশ্নাবলি (Attributional Style Questionnaire) সাজিয়ে আশাবাদের পরীক্ষা নেয়া হয়।
আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের মধ্যকার ভিন্নতা কিছুটা উত্তরাধিকার সূত্রে আসে[২] এবং এটা কিছু মাত্রায় জীববিজ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে।[৩] এটা একই সাথে সামাজিক উপাদানগুলো দ্বারাও প্রভাবিত হয়, যাদের মধ্যে পারিবারিক প্রভাব রয়েছে,[২] যা বলে এটা শেখাও যেতে পারে।[৪] আশাবাদকে স্বাস্থ্যের সাথেও সম্পর্কযুক্ত করা যায়।[৫]
মনোবিজ্ঞানগত আশাবাদ
সম্পাদনাস্বভাবগত আশাবাদ
সম্পাদনাগবেষকগণ তাদের গবেষণা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আশাবাদকে অপারেশনালাইজ (সরাসরিভাবে পরিমাপ করা যায় না এমন বিষয়কে বিভিন্ন উপায়ে পরিমাপ করার ব্যবস্থা করা) করেন। বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে আশাবাদকে পরিমাপ করার কয়েকটি উপায় আছে, যেমন লাইফ ওরিয়েন্টেশন টেস্ট (LOT)।
ডিসপোজিশনাল অপটিমিজম বা স্বভাবগত আশাবাদ এবং নৈরাশ্যবাদকে[৬] সাধারণভাবে ব্যক্তিকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়, সেটা হল, ব্যক্তি ভবিষ্যৎ ফলাফলকে উপকারী হিসেবে দেখেন নাকি নেতিবাচক হিসেবে? LOT প্রত্যেক আলাদা আলাদা ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের স্কোর প্রদান করে। আচরণগতভাবে এই দুটো স্কোর r = 0.5 এ কোরিলেট করে। এই স্কেলে আশাবাদী স্কোরগুলো সম্পর্ক,[৭] উচ্চ সামাজিক মর্যাদা,[৮] এবং প্রতিকূলতার সময় ভাল ও সুখের বিষয়গুলোর কম হারানোকে ভবিষ্যদ্বাণী করে।[৯] স্বাস্থ্যরক্ষার আচরণগুলো আশাবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত যেখানে স্বাস্থ্যহানির আচরণগুলো নৈরাশ্যবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত।[১০]
কেউ কেউ বলেন, আশাবাদ এবং নৈরাশ্যবাদ উভয়ই একটি একই মাত্রার বা একই বিষয়ের দুই প্রান্ত, এদের মধ্যকার যেকোন পার্থক্যই সোশ্যাল ডিজায়ারেবিলিটির মত উপাদানকে প্রতিফলিত করে। তাদের কাছে আশাবাদ, নৈরাশ্যবাদের মডেল একমাতৃক এবং একটি নির্দিষ্ট স্কোর দ্বারাই সোশ্যাল ডিজায়ারেবিলিটি বা অন্যান্য একক বিষয়ের স্কোর দ্বারা আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদ উভয়কেই পরিমাপ করা উচিত। যাইহোক, কনফারমেটরি মডেলিং আবার দ্বিমাতৃক মডেলকে সমর্থন করে[১১] এবং আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের দুটো মাত্রা দুটো ভিন্ন ফলাফলকে ভবিষ্যদ্বাণী করে।[১২] জেনেটিক মডেলিং আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে, যেখানে দেখানো হয় আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদ দুটো আলাদা আলাদা স্বাধীন বৈশিষ্ট্য থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় এবং এদের মধ্যকার কোরিলেশন বা সমন্বয় ঘটে যখন সাধারণ ওয়েল-বিইং ফ্যাক্টর বা মঙ্গলজনক উপাদান এবং পারিবারিক পরিবেশ ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে।[২]
ব্যাখ্যামূলক রীতি
সম্পাদনাএক্সপ্লানেটরি স্টাইল বা ব্যাখ্যামূলক রীতি হল আশাবাদের স্বভাবগত তত্ত্বের একটি বিশেষ ধরন। লাইফ ওরিয়েন্টেশন বা জীবন অভিমুখিতাভিত্তিক পরিমাপের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এট্রিবিউশনাল স্টাইল থিওরি বা বৈশিষ্ট্য আরোপন রীতির তত্ত্বগুলো প্রস্তাব করে যে, আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদ হল কীভাবে মানুষ কোন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে তারই প্রতিফলন, অর্থাৎ ঘটনার উপর ব্যাখ্যার এট্রিবিউশন বা আরোপনের কারণেই ব্যক্তির মাঝে আশাবাদী ও নৈরাশ্যবাদী স্বভাবেই উদ্ভব হয়। এট্রিবিউশনাল স্টাইলের পরিমাপে ঘটনার উপর এক্সপ্লানেশন বা ব্যাখ্যার আরোপনের ক্ষেত্রে এই ব্যাখ্যাকে তিনটি মাত্রার উপর ভিত্তি করে পৃথক করা হয়। এগুলো হল, ব্যাখ্যাগুলোকে অভ্যন্তরীন (internal) নাকি বহিরাগত (external) কারণে টানা হয়েছে; ব্যাখ্যাগুলোকে স্থিতিশীল (stable) নাকি অস্তিতিশীল (unstable) হিসেবে দেখা হচ্ছে; এবং ব্যাখ্যাগুলোকে গ্লোবালি বা সার্বজনীনভাবে নাকি পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্টভাবে (situationally specific) দেখা হচ্ছে। অধিকন্তু, এই পরিমাপগুলো ইতিবাচক ঘটনা এবং নেতিবাচক ঘটনার জন্য বৈশিষ্ট্য আরোপনগুলোর মধ্যেও পার্থক্য সৃষ্টি করে।
এই রীতি অনুযায়ী একজন আশাবাদী ব্যক্তি হলেন তিনি, যিনি ইতিবাচক ঘটনায় অভ্যন্তরীন, স্থিতিশীল ও সার্বজনীন ব্যাখ্যা আরোপ করবেন। অন্যদিকে নৈরশ্যবাদী তিনিই হন যিনি এই স্থিতিশীলতা, সার্বজনীনতা ও অভ্যন্তরীনতার বৈশিষ্ট্যগুলো নেতিবাচক ঘটনায় আরোপ করেন।[১৩] আশাবাদী ও নৈরাশ্যবাদী আরোপনগুলোর মডেলগুলো দেখায় যে এই আরোপনগুলো নিজেই একটি কগনিটিভ স্টাইল বা জ্ঞানীয় রীতি। যেসব ব্যক্তির সার্বজনীন ব্যাখ্যাগুলোর উপর মনোযোগ দেবার ঝোঁক থাকে তারা এটা সকল ধরনের ঘটনার উপরেই করেন, এবং এই জ্ঞানীয় রীতি একে অপরের মাঝে সমন্বয় তৈরি করে। অধিকন্তু, ইতিবাচক ঘটনায় ব্যক্তির আরোপন কিরকম আশাবাদী এবং নেতিবাচক ঘটনায় ব্যক্তির আরোপন কিরকম নৈরাশ্যবাদী তা ভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়, কিন্তু আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের এই দুটি বৈশিষ্ট্যে গুলো আন-কোরিলেটেড বা অ-সমন্বিত।[১৪]
ব্যাখ্যামূলক রীতি এবং আশাবাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কিছু গবেষক যুক্তি দেখান যে গবেষকগণ ব্যাখ্যামূলক রীতি বলতে যা জানে আশাবাদ আসলে তাকেই নির্দেশ করে।[১৫] আবার এটাও দেখা যায়, ব্যাখ্যামূলক রীতি স্বভাবগত আশাবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা,[১৬][১৭] এবং এই দুটোকে একই অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ তারা বড়জোড় সীমিতভাবে সমন্বিত। এই ধারণাগুলোর মাঝে সম্পর্ক খোঁজার জন্য আরও বেশি গবেষণার দরকার।[১৩]
আশাবাদের উৎস্য
সম্পাদনাসকল মনোবিজ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যের মত, স্বভাবগত আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের মধ্যকার ভিন্নতা[২] এবং এট্রিবিশনাল স্টাইল বা আরোপন রীতির ভিন্নতা[১৮] হল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আশাবাদ, নৈরাশ্যবাদ উভয়ই পারিবারিক পরিবেশের মত পরিবেশগত উপাদান দ্বারা শক্তিশালীভাবে প্রভাবিত হয়।[২] এটাও প্রস্তাব করা হয়েছে যে আশাবাদ সম্ভবত সরাসরিভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত না হয়ে বুদ্ধিমত্তা, মেজাজ ও মদ্যাসক্তির মত কোন বৈশিষ্ট্যকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে প্রাপ্ত হয়।[১৮] অনেক তত্ত্বই ধরে নেয় যে আশাবাদকে শিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা বা শেখা সম্ভব,[৪] এবং গবেষণা থেকে পারিবারিক পরিবেশের একটি বিনয়ী ভূমিকা বের হয়ে আসে যেখানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আশাবাদ বৃদ্ধি (বা হ্রাস) করা হয়, এবং নৈরাশ্যবাদ ও নিউরোটিসিজম হ্রাস (বা বৃদ্ধি) করা হয়।[২]
ব্রেইন ইমেজিং এবং জৈবরসায়ন নিয়ে করা গবেষণাগুলো বলছে যে, একটি জীববিজ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যের মাত্রায়, আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদ মস্তিষ্কের ব্যবস্থাগুলোর প্রতিফলন করে যা যথাক্রমে ইতিবাচক ও নেতিবাচক তথ্য সম্পর্কে বিশ্বাসকে প্রক্রিয়াকরণ ও সংঘবদ্ধ করে।[৩]
পরিমাপ
সম্পাদনাজীবন অভিমুখিতা পরীক্ষা
সম্পাদনালাইফ ওরিয়েন্টেশন টেস্ট (LOT) বা জীবন অভিমুখিতা পরীক্ষা শেইয়ার এবং কারভার কর্তৃক ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই পরীক্ষাটি আবিষ্কারের উদ্দেশ্য ছিল স্বভাবগত আশাবাদ পরিমাপ করা যার দ্বারা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক ফলাফলের আশা করা বোঝায়।[১৩] এটা আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদ সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত পরীক্ষাগুলোর মধ্যে একটি। এখানে আটটা আইটেম এবং চারটা ফিলার আইটেম ছিল। চারটি ছিল ইতিবাচক আইটেম (যেমন "নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, আমি সাধারণত সবচেয়ে ভালটা আশা করি ") এবং চারটি ছিল নেতিবাচক আইটেম (যেমন "যদি আমার সাথে কোন খারাপ কিছু হবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেই খারাপটাই হবে। ")।[১৯] এই LOT পরীক্ষাকে দুইবার পুনরালোচনা করা হয় - একবার করা হয় এই পদ্ধতিটিকে আসলে যারা তৈরি করেছেন তাদের (LOT-R) দ্বারা পরবর্তীতে এবং আরেকবার চ্যাং, মেডিউ-অলিভারস এবং ডি'জুরিলা কর্তৃকা বর্দ্ধিত জীবন অভিমুখিতা পরীক্ষা বা এক্সটেন্ডেড লাইফ ওরিয়েন্টেশন টেস্ট (ELOT) পদ্ধতি তৈরি করার সময়। পুনরালচিত জীবন অভিমুখিতা পরীক্ষা বা রিভাইসড লাইফ ওরিয়েন্টেশন টেস্টে (LOT-R: শেইয়ার কারভার এবং ব্রিজেস, ১৯৯৪) ছয়টি আইটেম আছে যাদের প্রত্যেকেরই ৫ পয়েন্টের স্কেলে "প্রবলভাবে অসম্মত" থেকে "প্রবলভাবে সম্মত" পর্যন্ত স্কোর করা হয়।[২০]
আরোপন রীতি প্রশ্নাবলি
সম্পাদনাআরোপন রীতি প্রশ্নাবলি বা এট্রিবিউশনাল স্টাইল কোয়েশ্চনারি (ASQ: Peterson et al. 1982[২১]) পদ্ধতিটি গড়ে উঠেছে আশাবাদের ব্যাখ্যামূলক রীতিকে ভিত্তি করে। এখানে ব্যক্তিদেরকে ছয়টি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ঘটনার তালিকা পড়েন (যেমন "আপনি কিছু সময়ের জন্য চাকরি খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছিলেন "), এবং তারপর তাদেরকে সেই ঘটনার একটি সাম্ভাব্য কারণ লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়। এরপর তারা সেই কারণ বা ব্যাখ্যা অভ্যন্তরীন নাকি বহিরাগত, স্থিতিশীল নাকি পরিবর্তনশীল, এবং সার্বজনীন নাকি স্থানীয় এগুলো মূল্যায়ন করতে বলা হয়।[২১] ASQ এর কয়েকটি পরিবর্তিত ভারশন আছে যার মধ্যে এক্সপেন্ডেড এট্রিবিউশনাল স্টাইল কোয়েশ্চনারি (EASQ) বা সম্প্রসারিত আরোপন রীতি প্রশ্নাবলি, কনটেন্ট এনালাইসিস অব ভারবেটিম একপ্লানেশন (CAVE) এবং বাচ্চাদের আশাবাদ পরীক্ষা করার জন্য পরিকল্পিত আরোপন রীতি প্রশ্নাবলি অন্তর্ভুক্ত।[১৩]
স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্ক
সম্পাদনাআশাবাদ এবং স্বাস্থ্য পরিমিতভাবে সম্পর্কযুক্ত।[২২] আশাবাদকে ৫% থেকে ১০% এর মাঝামাঝি ভেরিয়েশনে হৃদরোগ[২৩][২৪][২৫], স্ট্রোক[২৬] এবং বিষণ্ণতা[২৭][২৮] সহ কিছু হেলথ কন্ডিশন (কোরিলেশন কোয়েফিশিয়েন্ট ০.২ এবং ০.৩ এর মাঝে)[২৯] তৈরির সম্ভাবনার ব্যাখ্যাকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে।
রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস, হাঁপানি এবং ফাইব্রোমায়ালজায় ভোগা ব্যক্তির শারীরিক লক্ষণ, তাদের মানিয়ে নেয়ার কৌশল বা কোপিং স্ট্র্যাটেজি এবং এই রোগগুলোর নেতিবাচক প্রভাব প্রভৃতিকে কেন্দ্র করেও আশাবাদ ও স্বাস্থ্যের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।
এটা খুঁজে পাওয়া গেছে যে, আশাবাদী ও নৈরাশ্যবাদীদের মাঝে মানসিক পার্থক্য দেখা গেলেও, এই রোগগুলোয় আক্রান্তদের মাঝে, আশাবাদীদের বেলায় কোপিং স্ট্র্যাটেজির ম্যাধ্যমে ব্যাথা হ্রাসের খবর নৈরাশ্যবাদীদের বেলায় পাওয়া খবরের চেয়ে বেশি দেখা যায় না।[৩০] একটি মেটা এনালাইসিস থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আশাবাদ মানসিক সুস্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত: "সহজ ভাবেই বোঝা যায় যে, আশাবাদীরা নৈরাশ্যবাদীদের তুলনায় কম চাপ বা যন্ত্রণা নিয়ে কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসে।"[৩১] আবার আশাবাদের সাথে মানসিক সুস্বাস্থ্যের সম্পর্ককে কোপিং স্টাইল বা মানিয়ে নেয়ার রীতির উপরেও প্রয়োগ করা যায়: "অর্থাৎ, আশাবাদীরা সমস্যার মুখোমুখি হতে আগ্রহী হয়, এবং তারা সমস্যার সমাধাণের জন্য সক্রিয় এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন; নৈরাশ্যবাদীদেরকে বরং তাদের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টাকে ত্যাগ করতে দেখা যায়।"[৩১]
স্ট্রেস বা চাপের ক্ষেত্রে আশাবাদীদেরকে নৈরাশ্যবাদীদের চেয়ে ভাল সাড়া দিতে দেখা যায়: স্ট্রেসর বা চাপ তৈরি করে এমন উপাদানের সম্মুখীন হলে নৈরাশ্যবাদীদের শরীরে উচ্চমাত্রায় কর্টিসল ("স্ট্রেস হরমোন" নামে পরিচিত) এবং ট্রাবল রেগুলেটিং কর্টিসল এর সাড়া দেখা যায়।[৩২] শেইয়ার সার্জারির মধ্য দিয়ে যাওয়া অনেকগুলো রোগীর সুস্থ হবার প্রক্রিয়া নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেন।[৩৩] গবেষণায় দেখা যায়, সুস্থ হয়ে ওঠার হারের ক্ষেত্রে আশাবাদ খুবই শক্তিশালী উপাদান এবং অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখে। দেখা যায় আশাবাদীরা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখান যেমন, বিছানায় বসতে পারা, হাঁটাচলা করতে পারা ইত্যাদি। হাসপাতালের স্টাফরাও মন্তব্য করেন যে, আশাবাদীরা তাড়াতাড়ি সেড়ে ওঠেন। ছয় মাস পরে দেখা যায়, আশাবাদীরা খুব দ্রুত স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেন।
আশাবাদ এবং ভাল থাকা
সম্পাদনাআশাবাদ এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকার সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। ১৯৯০ সালে এসপিনওয়াল এবং টেইলর ফ্রেশম্যান বা নবশিক্ষার্থীদের উপর আশাবাদ, আত্মসম্মান, আত্মসংযমের অবস্থান ইত্যাদি সহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন।[৩৩] অন্যান্য পারসোনালিটি ফ্যাক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করে দেখা যায়, কলেজে ঢোকার পূর্বে যেসকল ফ্রেশম্যান আশাবাদের ক্ষেত্রে বেশি স্কোর করেছিলেন, নৈরাশ্যবাদীদের থেকে তাদের মানসিক চাপ কম ছিল। সময়ের সাথে সাথে দেখা যায় আশাবাদী ছাত্রছাত্রীরা নৈরাশ্যবাদী ছাত্রছাত্রীদের থেকে কম পরিমাণ চাপ নিয়ে থাকে, কম একাকী সময় কাটায় এবং কম মর্মপীড়ায় ভুগছেন। এভাবে গবেষণা আশাবাদের সাথে মানসিকভাবে ভাল থাকার একটি শক্তিশালী সম্পর্ক নির্দেশ করে।
আশাবাদ নিয়ে একটি সাম্প্রতিক মেটা এনালাইসিস পূর্বে পাওয়া আশাবাদের সাথে জীবন সন্তুষ্টি, সুখ, মানসিক এবং শারীরিক ভাবে ভাল থাকার ইতিবাচক সমন্বয় বা সম্পর্ক এবং বিষণ্নতা এবং উদ্বিগ্নতার নেতিবাচক সমন্বয়কে সমর্থন করছে।[৩৪]
এই সমন্বয়ের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে গবেষকগণ দেখেন, আশাবাদীরা এমন জীবনধারা বেছে নেন যা স্বাস্থ্যকর হয় এবং যা অসুখবিসুখকেও প্রভাবিত করতে পারে। যেমন, আশাবাদীরা কম ধূমপান করেন, শারীরিকভাবে সক্রিয় হন, বেশি ফলমূল, শাকসব্জি এবং হোল-গ্রেইন রুটি খান এবং পরিমিত মদ্যপান করেন।[৩৫]
দৃষ্টিভঙ্গিকে নেতিবাচক থেকে ইতিবাচকে স্থানান্তর করা
সম্পাদনাএটা বলে রাখা উচিত, গবেষকগণ দেখিয়েছেন যে, আশাবাদীদের নির্দিষ্ট কিছু রোগ কম হয়। কিন্তু গবেষকগণ সাইকোলজিকাল ইন্টারভেনশন বা মানসিক হস্তক্ষেপের সাহায্যে ব্যক্তির আশাবাদের মাত্রা পরিবর্তনের ক্ষমতা এবং এর মাধ্যমে রোগের সময় অথবা রোগ হবার সম্ভাবনাকে পরিবর্তন করাকে এখনও দেখাতে পারেন নি। যদিও মায়ো ক্লিনিক নামক একটি গবেষক দলের একটি আর্টিকেল সেলফ টক বা নিজের সাথে নিজের কথা বলার মাধ্যমে ব্যক্তির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে ইতিবাচক বা আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে প্রকাশ করেছে।[৩৬] এই কৌশলের মধ্যে ছিল। ইতিবাচক লোকজনের পরিবেশে থাকা, পরিবর্তনের স্থানকে শনাক্ত করা, ইতিবাচকভাবে নিজের সাথে কথা বলার চর্চা, হাস্যরসের বেলায় মুক্ত থাকা এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা।[৩৬]
দার্শনিক আশাবাদ
সম্পাদনামনোবিজ্ঞানগত আশাবাদ যেরকমভাবে ভবিষ্যতে সব কিছু ভাল হবে এরকম বিশ্বাস করাকে বোঝায়, দার্শনিক আশাবাদ এরকম কিছুকে না বুঝিয়ে বরং একটি দার্শনিক ধারণাকে বোঝায়। এই ধারণা অনুসারে, বর্তমান মুহূর্তটি হল সর্বোত্তম অবস্থা। একে প্যানগ্লোসিয়ানিজম বলা হয়। এই মতবাদ অনুসারে, প্রকৃতির সব কিছুই- অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ হ্যামিলটনের নীতির লাইন বরাবর অবটিমাইজেশনের নিয়মে (যেখানে সবসময় সাম্ভাব্য সর্বোত্তম ঘটনাই ঘটে) চালিত হয়। যে হ্যামিলটনের নীতির উপর ভিত্তি করে এই মতবাদটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আইডিয়ালিজম, রিয়ালিজম এবং দার্শনিক নৈরাশ্যবাদ দ্বারা বিরোধিতা করা হয়। দার্শনিকগণ প্রায়ই আশাবাদকে গটফ্রিড উইলহেম লাইবনিৎস নামের সাথে সম্পর্কিত করেন, যিনি বলতেন, আমরা সাম্ভাব্য সর্বোত্তম জগতে বাস করি, অথবা ঈশ্বর এমন একটি মহাবিশ্ব তৈরি করেছেন যাতে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো প্রযুক্ত হয়। এই ধারণাটিকে ভলতেয়ার তার বিখ্যাত ব্যাঙ্গাত্মক উপন্যাস ক্যানডাইড এর মাধ্যমে উপহাস করেছেন, যেখানে প্যানগ্লস নামের একটি চরিত্রের বিশ্বাসের উদাহরণ দিয়ে এধরনের আশাবাদকে ভিত্তিহীন বলা হয়েছে। এখানে প্যানগ্লসের বিশ্বাস ভ্রমণকারী মারটিনের নৈরাশ্যবাদ এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ঝোঁকের বিপরীত ছিল। "প্যানগ্লসিয়ান নৈরাশ্যবাদ" শব্দটিকে একটি নৈরাশ্যবাদী অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয় যা বলে, যেহেতু এই জগৎ সাম্ভাব্য সকল জগতের মধ্যে সর্বোত্তম, এর চেয়ে ভাল কিছু পাওয়া অসম্ভব।
আপাতবিরোধিতার মধ্য দিয়ে বলা যায়, দার্শনিক নৈরাশ্যবাদ বোধহয় সবচাইতে আশাবাদী দীর্ঘ মেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে জড়িত, কারণ এতে পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত থাকে। উইলিয়াম গডউইন একবার যুক্তি দেখান, সমাজ একসময় এমন একটা অবস্থায় পৌঁছাবে যেখানে সকল শক্তি ও হিংস্রতা প্রশান্ত যুক্তিবোধের দ্বারা পরিবর্তিত হবে, এসময় মন বস্তুকে নিজেদের অধীনে পরিণত করবে, এবং বুদ্ধিমত্তা তখন এমন অবস্থানে পৌঁছাবে যে মানুষ অমরত্বের গোপনীয়তা আবিষ্কার করবে।
পজিটিভিজম এবং আশাবাদ
সম্পাদনাদার্শনিক চিন্তাধারা অনুযায়ী, পজিটিভিজম হল দর্শনের একটি পদ্ধতি যা আপনাকে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে আপনি শুধুমাত্র সেইসব বিষয়কেই সত্য বলে স্বীকার করবেন যেগুলোকে আলোচনা করা যায় এবং পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহার করা যায়। পজিটিভ জ্ঞান হল বস্তুবাচক, এবং আশাবাদ হল একটি যন্ত্র যা একই পরীক্ষাগুলোকে চালিত করে। এটা তার মুক্ত এবং অজানা রেজাল্টের কারণে অস্থিতিশীল থাকে - অগাস্ট কোঁত একে "রিলেটিভ" বা আপেক্ষিক বলেছেন। একটি উদাহরণ দিয়ে আশাবাদের অস্থিতিশীলতা এবং পজিটিভিজমের সাথে এর সম্পর্ক তুলে ধরা যায়। আমাদেরকে কোন ফ্যাক্ট বা সত্যের চারপাশ ঘিরে একটি মডেল তৈরি করতে হয়। ধরুন আপনার একটা অসুখ হল। এখন অসুখের ছড়িয়ে পড়ার নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে আপনি অনুমান করতে পারেন যে, এই অসুখটি আসলে ভাইরাল ইনফেকশন। যতক্ষণ আপনি কোন পরীক্ষা দ্বারা নিশ্চিত না হচ্ছেন যে, আসলে এই রোগের কোন বিকল্প কারণ থাকতে পারে, ততক্ষণ আপনি একে ভাইরাল ইনফেকশন বলে মনে করবেন। এখান থেকে দেখা যায়, নতুন ফ্যাক্ট বা সত্য আমাদের বাস্তবতার নকশা বা মডেল অব রিয়ালিটিকে নতুন করে বিবেচনা করায়... এভাবেই আসলে পজিটিভিজম আশাবাদ, দর্শন, মনোবিজ্ঞান এবং বিশেষ করে জ্ঞানতত্ত্বের সাথে কাজ করে।
অপ্টিমালিজম
সম্পাদনানিকোলাস রেশার দার্শনিক অপটিমালিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই মতবাদ অনুসারে, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে, কারণ এটা এর অন্যান্য বিকল্পগুলোর চেয়ে ভাল।[৩৭] এই দর্শনটি যেমন কোন ঈশ্বরের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয় না, ঠিক তেমনিভাবে এটার জন্য কোন ঈশ্বরের প্রয়োজনও নেই, এবং এটি নাস্তিক্যবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[৩৮]
পজিটিভ মনোবিজ্ঞানী তাল বেন-শাহার মনোবিজ্ঞানগত অপটিমালিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এর অর্থ হল ব্যর্থতাকে স্বীকার করার ইচ্ছা এবং সামনে সাফল্য আসবে এব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী থাকা। তিনি নেগেটিভ পারফেকশনিজমের সাথে এই ইতিবাচক প্রবণতার মধ্যে তুলনা করেন।[৩৯] পারফেকশনিজম বলতে অর্জন করা সম্ভব না এমন কোন লক্ষ্যের দিকে একটি অটল আবশ্যক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়নকে বোঝায় যা সম্পূর্ণভাবে অর্জনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।[৪০] পারফেকশনিস্টরা বাস্তব ও মানুষের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে বর্জন করেন। তারা ব্যর্থতাকে স্বীকার করতে পারেন না এবং পুনরায় ব্যর্থতার ভয় তাদেরকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে আরও দেরি করায়।[৪১] এই নিউরোটিজম তাদের মধ্যে হতাশা, বিষণ্নতা তৈরি করতে পারে এবং এর ফলে তাদের কর্মক্ষমতাও কমে যায়।[৪২] এই নেগেটিভ পারফেকশনিজমের বিকল্প হিসেবে বেন শাহার অপটিমালিজমকে ধারণ করার প্রস্তাব দেন। অপ্টিমালিজম লক্ষ্যপূরণের পথে ব্যর্থতাকে স্বীকার করার অনুমতি দেয়, এবং এধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে যা বলে, কাজের প্রবণতা ইতিবাচক দিকে ঝোঁকে, তখন এমন কথা নেই যে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সবসম্য সাফল্যই আসবে। বাস্তবতার ভিত্তি একজন অপটিমালিস্টকে ব্যর্থতার মুখোমুখি হলে বিহ্বল হওয়া থেকে আটকায়।[৩৯]
অপটিমালিস্টগণ ব্যর্থতাকে স্বীকার করে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেয়, যা তাকে সাফল্য অর্জন করতে আরও বেশি উৎসাহিত করে।[৪১] ডঃ তাল বেন-শাহার মনে করেন, অপটিমালিজম এবং পারফেকশনিজমের উদ্দেশ্য আলাদা। অপটিমালিস্টদের প্রবণতা বেশি অন্তর্মুখী, তাদের ভেতরের আকাঙ্ক্ষা বেশি থাকে, যেখানে শেখার তাড়নাও বিদ্যমান। অন্যদিকে পারফেকশনিস্টরা নিজেদেরকে মূল্যবান প্রমাণিত করতেই বেশি তাড়িত হন।[৩৯]
আরও দেখুন
সম্পাদনা
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
আরও পড়ুনসম্পাদনা
বহিঃস্থ সূত্রসম্পাদনাউইকিউক্তিতে আশাবাদ সম্পর্কিত উক্তির সংকলন রয়েছে। উইকিবিশ্ববিদ্যালয়ে Positive thinking সম্পর্কে শেখার উপকরণ রয়েছে উইকিবিশ্ববিদ্যালয়ে Optimism সম্পর্কে শেখার উপকরণ রয়েছে উইকিমিডিয়া কমন্সে আশাবাদ সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।
|