স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি
বিশ্বকোষীয় পর্যায়ে যেতে এই নিবন্ধে আরো বেশি অন্য নিবন্ধের সাথে সংযোগ করা প্রয়োজন। |
বিভিন্ন সম্ভাব্য ঘটনার মধ্যে অবাধে যেকোন একটিকে বেছে নেওয়া সক্ষমতাই হলো ইচ্ছার স্বাধীনতা।
স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ধারণাটি নিবিড়ভাবে জড়িত নৈতিক দায়িত্ববোধ, প্রশংসা, দোষ, পাপ এবং অন্যান্য নৈতিক বিবেচনার সাথে যা শুধুমাত্র সেসব কাজের বেলায়ই খাটে যেগুলো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে করা হয়। এর সাথে উপদেশ, প্ররোচনা, পর্যালোচনা এবং নিবারণের ও সম্পর্ক আছে। ঐতিহ্যগতভাবে, যেসব কাজ স্বাধীনভাবে করা হয় শুধুমাত্র সেসব কাজের ক্ষেত্রেই অবদান বা দোষের কথা বিবেচনা করা হয়। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বলে কিছু আদৌ আছে কিনা বা থাকলেও তা কীভাবে সম্বব এটা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক।
স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বলতে অনেকে বোঝেন, স্বাধীন ভাবে পছন্দ করার ক্ষমতাকে যার ফলাফল অতীতের কোনকিছু দ্বারা প্রভাবিত না। নিয়তিবাদ এর মতে সবকিছু পূর্বনির্ধারিত, যা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ধারণার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। প্রাচীন গ্রিক দর্শন থেকে আমরা এই সমস্যার ব্যাপারে জানতে পারি, যা এখনো দার্শনিক বিতর্কের প্রাণকেন্দ্র দখল করে আছে।
অসংগতিবাদে যারা বিশ্বাস করে তাদের মতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আর নিয়তিবাদ পরস্পর সাংঘর্ষিক। এদের মধ্যে আবার রয়েছে একদল যারা আধিবিদ্যক উদারবাদি (Metaphysical Libertarianist), তাদের মতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সত্য আর নিয়তিবাদ মিথ্যা। আবার আরেকদল রয়েছে কট্টর নিয়তিবাদী (Hard Determinism) যাদের মতে, নিয়তিবাদ সত্য আর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি মিথ্যা। একদল এমনও আছে যারা নিয়তিবাদ এবং এর বিপরীত দুটোকেই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির সাথে সাংঘর্ষিক ভাবে দেখেন (Hard Incompatibilism)
অপরদিকে সংগতিবাদে যারা বিশ্বাসী তাদের মতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং নিয়তিবাদ দুটিই সংগতিপূর্ণ। এমনকি কিছু সংগতিবাদীদের মতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির জন্য নিয়তিবাদ অপরিহার্য। কারণ, দুটি ঘটনার মধ্যে যেকোন একটিকে পছন্দ করে নেওয়া তখনই সম্ভব যখন কারো দুটি ঘটনার পরিণতি সম্পর্কেই জানা থাকে (determinism) । তাই তাদের মতে কট্টর নিয়তিবাদি এবং উদারবাদিদের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও নিয়তিবাদ নিয়ে যে বিতর্ক সেটা False Dilemma. ভিন্ন ভিন্ন সংগতিবাদীদের মতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির সংজ্ঞা ভিন্ন এবং তাদের মতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির সীমাবদ্ধতাও ভিন্ন ভিন্ন। Classical Compatibilitist দের মতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি মানেই হল কাজ করার স্বাধীনতা। কোন ব্যক্তির তার ইচ্ছামতো যেকোন কাজ করার ক্ষমতা থাকলেই তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। অপরদিকে সমসাময়িক সংগতিবাদীদের মতে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করাই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। এছাড়াও, আরো অনেক মতবাদ রয়েছে যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ইচ্ছার স্বাধীনতার ইতিহাস
প্রাচীন গ্রীক দর্শন সাহিত্যে ইচ্ছার স্বাধীনতার সমস্যাটি চিহ্নিত হয়।সংগতিপূর্ণ ইচ্ছার স্বাধীনতা ধারনাটি বিশেষায়িত করেন এরিস্টটল ও এপিকটেটাস, "কোন কিছুই আমাদের কোন কিছু করা বা পছন্দ করা হতে বিরত রাখতে পারেন না যা আমাদের তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।" সুসান ববজিয়ানের মতে অসংগতিবাদি ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রথম দেখা মেলে আফ্রোদিতিসের আলেক্সান্ডারের কাজে, "প্রকৃত ঘটনা আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে দৈবক্রমে অনিশ্চিত যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ বস্তুগুলোর উপর প্রতিষ্ঠা করে এবং এভাবে আমরা কোন কিছু করা বা না করার মধ্যে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি।"
খ্রিষ্টিয় দর্শনে প্রথম ইচ্ছার স্বাধীনতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে যার অর্থ মানুষের ইচ্ছায় প্রয়োজনীয়তার অভাব এজন্য ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন অর্থ ইচ্ছা শক্তি যেমন আছে তেমন থাকবে না। এর প্রয়োজনীয়তা সংগতিবাদী ও অসংগতিবাদী দুইদল দ্বারাই সমাদৃত হয়।
পাশ্চাত্য দর্শন
সম্পাদনাঅন্তর্নিহিত প্রশ্নটি হচ্ছে আমাদের কাজের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা। যদি থেকে থাকে তাহলে তা কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ এবং তা কতটুকু। এসব প্রশ্ন আদিকালের গ্রীক দুঃখবাদীরাও করেছিল এবং তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চালিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক কালে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা তেমন হয়নি।
স্বজ্ঞালব্ধ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি(intuitive free will) আর প্রাকৃতিক নিয়মকানুনকে সমঝোতায় আনাটা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। মানুষ ভাবে যে সবকিছু তার ইচ্ছার অধীনে হচ্ছে কিন্তু যা কিছু হচ্ছে তার সবটাকেই কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে ফেলেছেন বিজ্ঞানিরা। এই সমস্যাটা তখনই আসে যখন আমরা নৈমিত্তিক নিবর্তন (Causal Closure) ও প্রাকৃতিক নিয়তিবাদকে (Physical Determinism) কে বিবেচনায় আনি। নৈমিত্তিক নিবর্তন বলে, প্রাকৃতিক কোন ঘটনার কারণও প্রাকৃতিক হতে হবে। প্রাকৃতিক নিয়তিবাদ আবার বলে, ভবিষ্যতের সবকিছুই কারণ ও কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত।
প্রাকৃতিক নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলা এই নিয়তিবাদি মহাবিশ্বে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির সামঞ্জস্যতা নিয়ে এই সমস্যাটাকে Problem of freewill অথবা Dilemma of Determinism বলা হয়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই অপর একটি নৈতিক দ্বন্দের জন্ম নেয় - যদি সবকিছুই অতীত ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় তাহলে মানুষকে কীভাবে তার কাজের জন্য দায়ী করা সম্ভব?
সংগতিবাদীরা বলে থাকে মানসিক বাস্তবতা নৈমিত্তিক ফলপ্রসূতার ব্যাপারে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। Classical Compatibilist দের মতে বহিরাগত বাধা বা চাপ না থাকলেই কেবলমাত্র স্বাধীনইচ্ছাশক্তি থাকতে পারে। আধুনিক সংগতিবাদীরা এক্ষেত্রে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মশক্তি দুটো ধারণার কথা বলে।
অসংগতিবাদীরা অপরদিকে এই সমস্যাটার সমাধান দেয় এভাবে, তাদের মতে নিয়তিবাদি মহাবিশ্বে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি শুধুমাত্র একটি ভ্রান্ত ধারণামাত্র। উদারবাদিদের মতে, নিয়তিবাদ মিথ্যা এবং অন্তত কিছু ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক অনিয়তিবাদি বিশ্বেও উদারবাদ প্রবর্তন (origination) এর বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে।
স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ক্ষেত্রে সাধারণত প্রাকৃতিক নিয়তিবাদকেই (physical determinism) বিবেচনায় নেওয়া হয় বিশেষ করে, সাধারণ নিয়তিবাদ (nomological determinism), এছাড়াও অন্যান্য নিয়তিবাদও স্বাধীনইচ্ছাশক্তির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। যেমন- যৌক্তিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক নিয়তিবাদ উদারবাদি মতবাদকে ভাগ্য ও নিয়তি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নিচে এই দ্বন্দ্ব নিয়ে চিরায়ত কিছু যুক্তি উপস্থাপন করা হল।