হেলা খেয়াল দঙ্গল হল রাজস্থানের লোকনাট্যের একটি স্বতন্ত্র রূপ। এটি বিভিন্ন দলের দ্বারা ব্যঙ্গ গানের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশনা নিয়ে গঠিত। প্রায় তিনশো বছর আগে রাজস্থানে এই প্রথা শুরু হয়েছিল। অনেক জায়গায় হেলা খেয়াল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো, কিন্তু লালসোট হয়ে ওঠে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।[১] প্রতি বছর গাঙ্গৌর উৎসবকে ঘিরে দৌসার লালসোটে লোকশিল্পীরা ভিড় জমান। সরাসরি প্রদর্শনের মাধ্যমে সৃজনশীল বিষয়বস্তু, লোকগান, লোক বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শন করা হয়। বিরাট জনসংখ্যার সামনে একটানা তিন দিন ধরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, শুধুমাত্র স্বল্প বিরতি দিয়ে। দর্শকদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ নয়। এটি কৃষকদের বিনোদনের একটি রূপ হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল এবং সমসাময়িক উদ্বেগের বিষয়ে উজ্বল ব্যঙ্গের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পাদনা

হেলা খেয়ালের ইতিহাস সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি কারণ এটি একটি লোকশিল্প ছিল। তবে এটা নিশ্চিত যে রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গায় ঐতিহ্যটি প্রায় তিন শতাব্দী ধরে চলে আসছে।[২] দৌসা, কারৌলি, সওয়াই মাধোপুর, আলোয়ার, ঢোলপুর, টঙ্ক অঞ্চল এবং জয়পুরে হেলা খেয়ালের ইতিহাস রয়েছে।[১] সবচেয়ে বিখ্যাত কেন্দ্র ছিল দৌসার লালসোট যেখানে হেলা খেয়ালের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল এবং সমস্ত প্রদর্শনশিল্পী এতে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হওয়াকে সম্মানজনক মনে করতেন।[৩]

হেলা খেয়াল দঙ্গল সাধারণত দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠান গ্রামে গ্রামে সম্প্রদায় স্তরে সংগঠিত হয়েছে। ফসল তোলার পর ফসল বিক্রি করে কৃষকদের কিছু টাকা থাকত। গ্রামের সমস্ত পরিবার অনুষ্ঠানের জন্য টাকা দিয়ে বা সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করত। শিল্পীদের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হত। সংগৃহীত তহবিল দিয়ে, গ্রামের আয়োজক দল আমন্ত্রিত দলের শিল্পীদের খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার ব্যবস্থা করত।[৪]

রাজস্থানের বেশিরভাগ গ্রামে সম্প্রদায়ের জন্য একটি উন্মুক্ত এলাকা রয়েছে, যেখানে গ্রামবাসী বসে সামাজিক যোগাযোগ করতে পারেন। রাতে শিল্পীরা তাঁদের পরিবেশনার জন্য এই এলাকায় অনুশীলন করতেন। অনুশীলন সময়কালকে রাগি বলা হয়। হেলা খেয়াল শুধু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবেই বিবেচিত হয় না, এখানে হাদাউতিধুন্ধি সংস্কৃতির সঙ্গমও হয়।[৫]

পরিবেশনা সম্পাদনা

হেলা খেয়াল হল এমন একটি মাধ্যম যেখানে একজন গায়ক যে কোন ধর্মীয়, পৌরাণিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়কে শ্রোতাদের জন্য বহুমুখী আকারে উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠান শুরু হয় ভবানী পুজো দিয়ে – দেব-দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।[৬] তারপর দোহা নামক দ্বিপদী গাওয়া হয়। প্রতিটি দলের শিল্পী সংখ্যা ২০ থেকে ৪০ পর্যন্ত হয়। তাঁরা সাধারণত দুটি দলে বিভক্ত থাকেন। একটি দল ঢোলের মতো লোকযন্ত্র নাগাড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, এই যন্ত্রটি তাল প্রদান করে। অন্য দলটি দর্শকদের মাঝে দাঁড়িয়ে গান গায়। এক খেয়াল হল একটি সমন্বিত গীতিকবিতা যা দুটি অংশে সঞ্চালিত হতে পারে, মাঝখানে একটি ছোট বিরতি নিয়ে।[৭]

হেলা খেয়ালের জন্য ব্যবহৃত লোকযন্ত্র হল ঢোলক, নাগাড়া, মঞ্জিরা, হারমোনিয়াম, ঝাঁঝ, খঞ্জরি, চিমটা ইত্যাদি। গান পরিবেশন শুরু করার আগে কখনও কখনও শিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র বাজান এবং একটি লোকনৃত্য পরিবেশন করেন। একে বলা হয় বাজা মিলানা[৭] হেলা খেয়ালে শুধুমাত্র পুরুষ শিল্পীরা প্রদর্শন করেন। একটি দলের প্রদর্শনের শেষে, একটি স্পর্ধামূলক প্রশ্ন পরবর্তী গোষ্ঠীর কাছে উত্থাপিত হয়। দ্বিতীয় গোষ্ঠী হেলা খেয়ালের শৈলীতে জবাব দেবে বলে আশা করা হয়।[৮]

বিষয়বস্তু এবং শৈলী সম্পাদনা

হেলা খেয়ালের গান দোহা, বারোমাসি, ফিল্মির [৯] মতো শৈলীর ভিত্তিতে বিভক্ত।[১০] সাধারণত, প্রতিটি রচনার শেষে তার সুরকারের নামও থাকে। প্রয়াত গোপিলাল যোশী, পেয়ারেলাল যোশী, শ্রীনারায়ণ, গাইন্দালাল কারিগর, মথুরেশ যোশী, কল্যাণ প্রসাদ মিশ্র, রোশন তেলি, মাতাদিন যোশী, কালীচরণ, পণ্ডিত, দেবকিনন্দন, হুকমচাঁদ, রাধারমণ, রামপ্রতাপ, দেবীসিংহ চৌধুরী, রামবিলাস প্রমুখ গীতিকার খ্যাতি অর্জন করেছেন।[১] লালরামের রচনা নিয়ে একটি বই সংকলিত হয়েছে।[৭]

হেলা রচনায় যৌতুক, বাল্যবিবাহ, জাতিগত বৈষম্য, অশিক্ষার মতো সামাজিক কুফলগুলির সমালোচনা করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে।[১১] রাজনৈতিক ব্যঙ্গকে তুরাকালাঙ্গী বলা হতো।[১২][১৩] দঙ্গলের আগে, পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্মের আলোচনা বিষয়বস্তুতে প্রাধান্য পেয়েছিল, যদিও তুরা এবং কালাঙ্গির গানগুলিও জনপ্রিয় ছিল।[১৪] সাম্প্রতিক সময়ে, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের ভাষ্যগুলি দঙ্গল প্রদর্শনে প্রাধান্য পেয়েছে। গায়করা দেশপ্রেম, দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবক্ষয়, দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সঙ্গীত রচনা উপস্থাপন করেন।[১৫] কোনো বিশেষ মঞ্চ নেই এবং অভিনয়শিল্পীদের তিন দিকেই দর্শকরা বসেন।[১৬] হেলা খেয়াল দঙ্গলের লোকনাট্য রূপটি শিল্পীদের জন্য বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে জনসাধারণের অনুভূতিকে বিনোদনমূলকভাবে প্রকাশ করার একটি সুযোগ দেয় এবং সেই সাথে মানুষকে প্রগতিশীল হতে এবং সামাজিক মন্দের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "लालसोट में 272 वर्षों से चली आ रही हेला ख्याल संगीत दंगल की अनूठी परंपरा, जानें पूरी कहानी"Zee News (হিন্দি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  2. "Lalsot Hela Khayal Dangal: 273 वर्षो पुराना हेला ख्याल दंगल शुरू, लालसोट में जुटे राज्यों भर के गायक"News18 हिंदी (হিন্দি ভাষায়)। ২০২৩-০৩-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  3. "लोकानुरंजन की पहचान बना लालसोट का हेला ख्याल संगीत दंगल"Dainik Bhaskar (হিন্দি ভাষায়)। ২০১৯-০৪-০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  4. "कलाकारों के दम पर जिंदा है हेेला ख्याल गायकी व संगीत दंगल | Artists are alive on the side of Heela Khyal singing and music disturb"Patrika News (হিন্দি ভাষায়)। ২০১৯-০৪-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  5. Mathur, Madan Mohan (২০০৬)। Kuchamaṇi Khyal: An Endangered Folk Theatre Style of Rajasthan (ইংরেজি ভাষায়)। Madan Mohan Mathur। 
  6. "हेला संगीत दंगल का आगाज: वाद्य यंत्रों की धुनों व गीतों के साथ मां भवानी की आराधना"Patrika News (হিন্দি ভাষায়)। ২০২৩-০৩-২৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  7. "हेला ख्याल- Hela Khayal | Exotic India Art"www.exoticindiaart.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  8. Miśra, Dayānidhi (২০১৫)। Lok Aur Shastra: Anwaya Aur Samanwaya (হিন্দি ভাষায়)। Vani Prakashan। আইএসবিএন 978-93-5072-996-0 
  9. Ramanarayan, Meena (২০১৮)। Khyāla Theatre of Rajasthan (ইংরেজি ভাষায়)। Amazon Digital Services LLC - Kdp Print Us। আইএসবিএন 978-1-7237-7283-2 
  10. उपेक्षित समुदायों का आत्म इतिहास (হিন্দি ভাষায়)। Vāṇī Prakāśana। ২০০৬। আইএসবিএন 978-81-8143-593-4 
  11. "लालसोट का ऐतिहासिक गणगौर हेला ख्याल संगीत दंंगल, कई दशकों से पहचान बनाए रखने में सफल"Patrika News (হিন্দি ভাষায়)। ২০২৩-০৩-২৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  12. Braja loka vaibhava (হিন্দি ভাষায়)। Rājasthāna Brajabhāshā Akādamī। ১৯৯৭। 
  13. Singh, Karan (২০১৯-১১-২৬)। Folk Theatres of North India: Contestation, Amalgamation and Transference (ইংরেজি ভাষায়)। Taylor & Francis। আইএসবিএন 978-1-000-76972-2 
  14. Jain, Dr Hukam Chand; Mali, Dr Narayan Lal (২০২২-১১-১৫)। Rajasthan Ka Aitihasik Evam Sanskritik Digdarshan (হিন্দি ভাষায়)। Prabhat Prakashan। আইএসবিএন 978-93-5488-456-6 
  15. "hela khayal dangal lalsot हेला ख्याल: रुस-यूक्रेन युद्ध, कोरोना व घटनाओं पर चले व्यंग्यबाण"Patrika News (হিন্দি ভাষায়)। ২০২২-০৪-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-২২ 
  16. Meena, Dr R. N. (২০১৮-১০-১২)। Folk Theater of Rajasthan: A Special Emphasis on Folk Theatre of Eastern Rajasthan (ইংরেজি ভাষায়)। Amazon Digital Services LLC - Kdp। আইএসবিএন 978-1-7287-1790-6