হুতোম প্যাঁচার নকশা

কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক সামাজিক রচনা


কলিকাতা সহরের চার দিকেই ঢাকের বাজ্‌না শোনা যাচ্চে, চড়্‌কীর পিঠ সড়্‌ সড়্‌ কচ্চে, কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে –; সর্ব্বাঙ্গে গয়না,পায়ে নূপুর, মাতায় জরির টুপি, কোমোরে চন্দ্রহার, সিপাই পেড়ে ঢাকাই সাড়ি মালকোচা করে পরা, তারকেশ্বরে ছোবান গাম্‌চা হাতে বিল্বপত্র বাঁদাসূতা গলায় যত ছুতর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাশাঁরির আনন্দের সীমা নাই—“আমাদের বাবুদের বাড়ি গাজোন!”…

এদিকে দুলে বেয়ারা , হাড়ি ও কাওরারা নূপুর পায়ে উত্তরি সূতা গলায় দিয়ে। নিজ নিজ বীরব্রতের ও মহত্ত্বের স্তম্ভস্বরূপ বাণ ও দশলকি হাতে করে প্রত্যেক মদের দোকানে, বেশ্যালয়ে ও লোকের উঠানে ঢাকের সংগতে নেচে ব্যাড়াচ্চে। ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখির পালক, ঘণ্টা ও ঘুমুর বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরু মশায়ের পাঠশাল বন্দ হয়ে গিয়েছে—ছেলেরা গাজনতলাই বাড়ি করে তুলেচে; আহার নাই, নিদ্রা নাই; ঢাকের পেচোনে পেচোনে রপ্টে রপ্টে ব্যাড়াচ্চে; কখন “বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব” চিৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্চে, কখন ঢাকের টোয়ের চামর ছিঁড়্‌ছে, কখন ঢাকের পেছনটা দুম্‌ দুম্‌ করে বাজাচ্চে—বাপ মা শশব্যস্ত, একটা না ব্যায়রাম কল্লে হয়। …

এ দিকে আমাদের বাবুদের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, ঢাক বাজতে লাগ্‌লো, শিবের কাছে মাথা চালা আরম্ভ হল,…

গাজন তলায় সজোরে ঢাক বেজে উঠলো, সকলে উচ্চ স্বরে ‘ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব” বলে চিৎকার কর্‌তে লাগ্‌লো; বাবু শিবের সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম কল্লেন। …

এ দিকে সহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁশোর ঘণ্টার শব্দ থাম্‌ল। সকল পথের সমুদায় আলো জ্বালা হয়েছে। “বেল ফুল!” “বরফ!” “মালাই!” চিৎকার শুনা যাচ্চে। …

সৌখীন কুটিওয়ালা মুখে হাতে জল দিয়ে জলযোগ করে সেতারটি নিয়ে বসেচেন। পাসের ঘরে ছোট ছোট ছেলেরা চিৎকার করে—বিদ্দেসাগরের বর্ণ পরিচয় পড়্‌চে। …

শোভাবাজারে রাজাদের ভাঙ্গা বাজারে মেচুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা মাচ ও লোনা ইলিস নিয়ে ক্রেতাদের—“ও গামচা কাঁদে ভালো মাচ নিবি?” ও “খেংরা গুপো মিন্‌সে চার আনা দিবি” বলে আদর কচ্চে—মধ্যে মধ্যে দু এক জন রসিকতা জানাবার জন্য মেচুনী ঘেঁটিয়ে বাপান্ত খাচ্চেন। রেস্তহীন গুলিখোর, গেঁজেল ও মাতালরা লাটি হাতে করে কানা সেজে “অন্ধ ব্রাহ্মণকে কিছু দান কর দাতাগণ,” বলে ভিক্ষা করে মৌতাতের সম্বল কচ্চে; এমন সময় বাবুদের গাজন তলায় সজোরে ঢাক বেজে উঠ্‌লো, “বলে ভদ্দেশ্বর শিবো” চিৎকার হতে লাগ্‌ল; গোল উঠ্‌লো, এ বারে ঝুল সন্ন্যাস। বা?”

— কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ‘‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’’, ১৮৬২

হুতোম প্যাঁচার নকশা কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তনকালীন পর্যায়ে রচিত একটি গদ্য উপাখ্যান, যা তিনি "হুতোম প্যাঁচা" ছদ্মনামে লিখেছেন। এটি মূলত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক সামাজিক নকশা[ক] জাতীয় রচনা।[১] ১৮৬১ সালে "চড়ক" শিরোনামে একটি নকশায় এটি প্রকাশিত হয়, পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে প্রথম ভাগ এবং ১৮৬৪ সালে দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়।[১]

হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা

নকশার বিষয়বস্তু সম্পাদনা

এতে কলকাতার হঠাৎ ফেঁপে ওঠা ঐশ্বর্য-ভারাক্রান্ত নব্য সমাজ এবং তার প্রায় সব ধরনের মানুষের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। গ্রন্থে যাদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে তারা সবাই লেখকের স্বশ্রেণীর ও তৎকালীন সমাজের অসাধারণ পরিচিত মানুষজন। তারা তিন ভাগে বিভক্ত সাহেবি ওল্ড অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষিত সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী; ইংরেজি শিক্ষিত নব্যপন্থী, যারা অনুকরণকারী নয় এবং ইংরেজি না-জানা গোঁড়া হিন্দু। এরা সকলেই কমবেশি জাল-জুয়াচুরি ফন্দি-ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। নকশায় ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকলেও শ্লীলতার মাত্রা অতিক্রম করেনি। গ্রন্থে উল্লিখিত যেসব চরিত্র নিন্দা করার মতো নয়, লেখক তাদেরকে সঙ সাজিয়ে উপস্থাপিত করেছেন। নকশা বুঝতে হলে নকশার চরিত্রদের আসল পরিচয় জানা দরকার, সেসঙ্গে বোঝা প্রয়োজন সেকালের অনুষ্ঠান, প্রথা, স্থাননাম এবং অপ্রচলিত অজস্র শব্দের অর্থ।[২]

প্রথম ভাগে বিকাশমান কলকাতা শহরের চড়কপার্বণ, বারোয়ারি পূজো, ছেলেধরা, ক্রিশ্চানি হুজুক, মিউটিনি, মড়াফেরা, সাতপেয়ে গরু, দরিয়াই ঘোড়া, লখনৌয়ের বাদশা, ছুঁচোর ছেলে বুঁচো, জাস্টিস ওয়েলস, টেকচাঁদের পিসী, বুজরুকি, হঠাৎ অবতার ইত্যাদি; দ্বিতীয় ভাগ রথ, দুর্গোৎসব, রামলীলা, রেলওয়ে। সমকালের বাস্তব জীবন যেমন, তেমনি জীবনসংলগ্ন ভাষাভঙ্গির জন্য গ্রন্থখানি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। এর প্রধান চরিত্র দানুবানু।

দ্বিতীয় ভাগ

রচনা শৈলী সম্পাদনা

কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মৌখিক ভাষার প্রথম সুষ্ঠু প্রয়োগ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলা গদ্যে এরকম নিরঙ্কুশ কথ্য বুলির যথার্থ প্রয়োগ ইতোপূর্বে আর দেখা যায়নি। লেখক ‘হুতোম’ ছদ্মনামে লিখতেন বলে এর ভাষা ‘হুতোমী বাংলা’ বলে পরিচিত।[৩] এ ভাষা প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালী ভাষা’[খ] থেকে মার্জিততর ও বিশুদ্ধতর; এতে কথ্য ও সাধু ক্রিয়াপদের মিশ্রণ নেই। প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাষাকে তিনি আরও কথ্যেএবং আরও সমকালীন করে তুললেন। কালীপ্রসন্ন সিং বুঝেছিলেন নব্য আধুনিক কলকাতার সমাজের যা অনাচার, ভ্যষ্টতা ও বিকৃতি, তাকে আক্রমণ করতে হলে সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা কাজ হবে না, বরং লাগসই কথ্য ভাষা প্রয়োগ করতে হবে। তার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। পাঠকের কাছে ‘‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’’ ব্যাপক আবেদনের পেছনে ভাষাশৈলীর অবদান প্রত্যক্ষ।[৪]

সমালোচনা সম্পাদনা

উনিশ শতকের কলকাতা কেন্দ্রিক আধুনিক বাঙ্গালী সমাজের অনেক অনেক বাস্তব চরিত্র ছদ্মাবরণে স্থান লাভ করেছে। উপরন্তু তৎকালীন কলকাতার সংস্কৃতি, প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, যানবাহন, অলঙ্কার, পল্লি নাম-এর বিস্তৃত বর্ণনা আছে এই রচনায়। উনিশ শতকের কলকাতা জায়মান নাগরিক জীবনের বৃত্তান্ত এ রচনার মুখ্য বিষয়। কালীপ্রসন্ন সিংহের ভাষাভঙ্গী ও রসবোধ এই রচনাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই নকশা আজো সমানভাবে সমাদৃত। নতুন শহর কলকাতার উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের ছবি এ নকশায় অংকিত হয়েছে তা তুলনাহীন। উনিশ শতক, সেই শতকের শহর কলকাতা ও সেই কলকাতার বাঙালি, কোথায় না নকশা লেখনীর বিষয় খুঁজে নিয়েছিলেন হুতোম। সেই সার্চ-ই হুতোমের নকশার গুণ। সেই সময়ের শহরের মানুষের মুখের ভাষা ও জীবন চর্চাকে এমন জীবন্ত ভাবে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি। ছদ্মনামে আড়ালে বাস্তব অনেক চরিত্রকে এমন কিছু গুণ দিয়ে চিত্রায়িত করা হয়েছে পাঠক সহজেই চিহ্নিত করতে সক্ষম। সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেমন নীল বিদ্রোহ, সিপাই বিদ্রোহ বা ওয়াজিদ আলী শাহ্‌-এর আগমন বিষয়কে আরও সরস করে তুলেছে। এই বাস্তব যোগ নকশাটিকে ‍দিয়েছেে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

“হুতোম প্যাঁচার নকশা” প্রকাশের পর কলকাতায় ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল ছদ্মনামের আড়ালের মানুষগুলোর পরিচয় অস্পষ্ট ছিল না। গোপনও থাকে নি। তাই প্রথম খণ্ড প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার ‘ফুলবাবুরা’ রে রে করে উঠেছিলেন। নকশার লেখক কাউকে যে ছেড়ে কথা বলেননি। এমনকি নিজেকেও ছাড় দেন নি। “হুতোম প্যাঁচার নকশা” প্রকাশের পর কালীপ্রসন্ন সিংহের বহু মানুষের শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন।

নকশার প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সত্য বটে অনেকে নকশাখানিতে আপনারে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক সেটি যে তিনি নন তা বলাই বাহুল্য, তবে কেবল এইমাত্র বলতে পারি যে আমি কারেও লক্ষ্য করি নাই অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এমনকী স্বয়ংও নকশার মধ্যে থাকিতে ভুলি নাই।’’ দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘‘তবে বলতে পারেন ক্যানই বা কলকেতার কতিপয় বাবু হুতোমের লক্ষ্যান্তবর্ত্তী হলেন, কি দোষে বাগাম্বর বাবুরে প্যালানাথকে পদ্মলোচনকে মজলিসে আনা হলো, ক্যানই বা ছুঁচো শীল, প্যাঁচা মল্লিকের নাম কল্লে, কোন দোষে অঞ্জনারঞ্জন বাহদুর ও বর্ধমানের হুজুর আলী আর পাঁচটা রাজা রাজড়া থাকতে আসোরে এলেন?’’

“হুতোম প্যাঁচার নকশা” প্রকাশের পর অনেকেই কালীপ্রসন্ন সিংহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ শিরোনামের বই প্রকাশ করে এক চোট প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের পুত্র চুনীলাল মিত্রও কালীপ্রসন্ন সিংহের ওপর ক্রোধান্বিত ছিলেন। এবার সুযোগ পেয়ে তিনি প্রকাশ করলেন “কলিকাতার নুকোচুরি” নামের একটি পুস্তিকা যাতে কালীপ্রসন্ন সিংহকে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। চুনীলাল মিত্র লিখেছিলেন, ‘‘হুতোম নিজে বজ্জাত হয়ে অন্যের খুঁত ধরছেন। হুতোম জীবনে যা করেছেন সবই খারাপ কাজ। ভালর মধ্যে শুধু ওই মহাভারত।’’[গ][৪] এ গ্রন্থে এক স্থানে লেখা এরকম, “কিছুদিন পরেই বয়েস প্রাপ্ত হোলো। বাপের বিষয় পেতে আর ধুমধামের পরিসীমা ছিল না। যখন যা মনে আসে তাই করেন। কখন হোটেলের খানা আনিয়ে আমোদ আহ্লাদ কচ্চেন, কখন তেলেভাজা ফুলরি বেগ্‌নির সহ রকমারি নিয়ে ইয়ারকি দিচ্চেন। আজ স্যাম্‌পেন ঢালোয়া -- কাল ব্রাণ্ডির মোচ্ছব -- পরশু পাঁচ রকম মদ দিয়ে পঞ্চ্‌ কচ্চেন। বাঁদি নেসা না হলে কখন বা মদের সঙ্গে, লডেনম্‌, ও মরফিয়া মিশাচ্চেন। পাঁচ ইয়ারির দল হলেই পাঁচ রকম লোক এসে যোটে। কোথাও ভটচাজ্জির টিকি কেটে সন্দেশের সঙ্গে ফ্যান্সি বিষকুট দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কাহাকে ডাবের জলে এমিটিক দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কেহ নেশায় অচেতন হয়ে পোড়ে আছে। কোথায় কেহ হাত পা আছড়াচ্চে, কোথাও কেহ গড়াগড়ি দিচ্চে, কোথাও কেহ বমি কোচ্চে, কোথাও কেহ দুটো হাত তুলে ইংরাজী লেকচার দিচ্চে, কোথাও কেহ বাঙ্গালায় বক্তৃতা কোচ্চে।”

পাদটীকা সম্পাদনা

^ ক:  নকশা হলো হাস্যরস পরিপূর্ণ ব্যঙ্গাত্মক রচনা যার মাধ্যমে সামাজিক অনাচার, ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিদ্রূপ করা হতো এবং সামাজিক দোষ দূর করতে শিক্ষাদান করা হতো। নকশা প্রধানত আকৃতিতে হয় নাতিদীর্ঘ, ভাষা হয় লঘু এবং ইঙ্গিতপূর্ণ।
^ খ:  ‘আলালী ভাষা’ বলতে প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত “আলালের ঘরের দুলাল” গ্রন্থের ভাষাশৈলীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
^ গ:  মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে কালিপ্রসন্ন সিংহ “সংস্কৃত “মহাভারত” বাংলায় অনুবাদের কাজে হাত দিযেছিলেন। পরবর্তীকালে সাত জন পণ্ডিতের সাহায্যে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে অনুবাদের কাজ সমাপ্ত হয়েছিল। অনুবাদ ছিল অনবদ্য। তৎকালে আড়াই লক্ষ টাকা ব্যয়ে তা ছেপে বিনামূল্যে বিতরণ ছিল এক অতুলনীয় কীর্তি।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা