হিন্দু মেলা

কলকাতার প্রাক্তন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব
(হিন্দুমেলা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

হিন্দু মেলা (১৮৬৭–১৮৯৯) ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে স্বাদেশিকতার ভাব জাগরণ তথা জাতীয় চেতনার প্রসারের উদ্দেশ্যে আয়োজিত একটি মেলা। এই প্রতিঠান জাতীয় মেলাস্বদেশী মেলা নামেও পরিচিতি লাভ করে। ১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে ঠাকুর পরিবারের সহযোগিতায় কলকাতায় প্রথম হিন্দু মেলা আয়োজিত হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরনবগোপাল মিত্রের যৌথ উদ্যোগে প্রথম হিন্দু মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলার অপর বৈশিষ্ট্য ছিল দেশীয় শিল্পোৎপাদনে উৎসাহ দান,দেশীয় প্রতিক সমূহের প্রতি আনুগত্য । এই জন্য এই মেলাকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বসূরি বলে মনে করা হয়। [১] হিন্দু মেলা কলকাতার বাঙালি সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটি নির্দেশ করে। ১৮৩০-এর দশকে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন বাংলায় দুটি পরস্পরবিরোধী সমাজচেতনার জন্ম দিয়েছিল। কেউ কেউ ধর্মীয় বিষয়বস্তুর পরিবর্তে আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলির প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। আবার কেউ কেউ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরাই মুখ্য কাজ বলে বিবেচনা করেন।[২]

উদ্বোধন সম্পাদনা

প্রথম দিকের হিন্দু মেলা উদ্বোধিত হত চৈত্র সংক্রান্তির দিন। বস্তুত ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল নবগোপাল মিত্র চৈত্রমেলা নামে একটি জাতীয় মেলার সূচনা করেন। পরে এই নাম হয় হিন্দুমেলা।[৩] এই উপলক্ষে দেশাত্মবোধক কবিতা ও গান লেখা হত। বাঙালি ও পাঞ্জাবি ছাত্রদের মধ্যে আয়োজিত হত কুস্তি প্রতিযোগিতাও। থাকত হিন্দুদের কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত নানা প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও। [১] মেলার প্রধান উদ্যোক্তা নবগোপাল মিত্র চাইতেন সরকারের উপর দেশের জনসাধারণের নির্ভরতা কমিয়ে তাদের স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী করে তুলতে। এই মেলার পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা কমলকৃষ্ণ রমানাথ ঠাকুর, কাশীশ্বর মিত্র, দুর্গাচরণ লাহা, প্যারীচরণ সরকার, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণদাস পাল, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, পণ্ডিত ভারতচন্দ্র শিরোমণি, পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই মেলায় যোগ দিতেন।

হিন্দু মেলার প্রথম সচিব গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবাসীর পরনির্ভরতা মনুষ্যত্বের পক্ষে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করে আত্মনির্ভরতার চেতনাকে মেলার আদর্শের অঙ্গীভূত করার কথা বলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ইংরেজি আচার-আচরণের অনুকরণ কেবল ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যোগসূত্রটিকে দৃঢ়তা দান করবে। যা ভারতের সাংস্কৃতিক সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। এই জন্য তিনি আধুনিকতাবাদীদের পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতার আলোকে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত হতে এবং সমাজের ভিতর থেকে তার পরিবর্তন সাধন শিক্ষা করার আহ্বান জানান। [১]

হিন্দু মেলা উপলক্ষে “লজ্জায় ভারত-যশ গাইব কী করে” গানটি লিখে গণেন্দ্রনাথ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই গানটি হিন্দু মেলায় প্রায়শই গাওয়া হত।[৪]

পরবর্তী বছরগুলি সম্পাদনা

১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে হিন্দু মেলা আয়োজনের সময় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় ছিলেন না। তবে ১৮৬৮ সালের দ্বিতীয় হিন্দু মেলায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। এই উপলক্ষে তিনি "মিলে সবে ভারতসন্তান " গানটি রচনা করেন। এই গানটি ভারতের প্রথম জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা অর্জন করে।[৫]

১৮৭০ সাল থেকে এপ্রিলের বদলে ফেব্রুয়ারি মাসের মেলার আয়োজন করা হতে থাকে। এই সময় মেলার নামকরণ হয় জাতীয় মেলা। মেলায় নবকুমার মিত্রের প্রভাব ১৮৭৫ সাল অবধি বজায় ছিল। তারপর তিনি মেলার আয়োজন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ১৯৮০-এর দশকে হিন্দু মেলা ম্লান হয়ে যায়। [১]

গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অল্পবয়সেই হিন্দু মেলার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। নবকুমার মিত্রের অনুরোধে তিনি এই মেলায় একটি কবিতা পাঠ করেছিলেন।[৬] মেলার নবম বছরে তিনি মেলার সচিব নির্বাচিত হন।[৭]

১৮৬৭ সালে যখন হিন্দু মেলা শুরু হয় তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ছয় বছরের বালকমাত্র। কিন্তু কয়েক বছর পরেই তিনি এই মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ছাপার অক্ষরে রবীন্দ্রনাথের নামযুক্ত প্রথম কবিতা 'হিন্দু মেলায় উপহার' হিন্দুমেলায় পঠিত হয়।[৩]১৮৭৫ সালে রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে আয়োজিত হিন্দু মেলায় তিনি একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ পত্রিকায় ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৫ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে লেখা হয়েছিল, “Baboo Rabindranath Tagore, the youngest son of Baboo Debendranath Tagore, a handsome lad of some 15 had composed a Bengali poem on Bharat (India) which he delivered from memory; the suavity of his tone much pleased the audience.” (বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরে পঞ্চদশবর্ষীয় কনিষ্ঠ পুত্র বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বরচিত কবিতা মুখস্থ আবৃত্তি করে শ্রোতাদের বিমোহিত করেন।) ১৮৭৭ সালে তিনি “দিল্লি দরবার” কবিতাটি হিন্দু মেলায় আবৃত্তি করেছিলেন।[৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. The Brahmo Samaj and the shaping of the modern Indian mind। Princeton Univerity Press। আইএসবিএন 0691031258 
  2. Majumdar, Swapan, Literature and Literary Life in Old Calcuttain Chaudhuri, Sukanta (editor),Calcutta The Living City Vol I, page 111, edited by Sukanta Chaudhuri, first published 1990, paperback edition 2005, Oxford University Press, আইএসবিএন ০-১৯-৫৬৩৬৯৬-১
  3. শিশিরকুমার দাশ সংকলিত ও সম্পাদিত, সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৯, পৃষ্ঠা ২৪৩ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-০০৭-৯ {{আইএসবিএন}} এ প্যারামিটার ত্রুটি: চেকসাম
  4. Goswami, Karunamaya। "Music"। amrakajon.org। ২০০৭-০৩-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২৪ 
  5. Bandopadhyay, Hiranmay, Thakurbarir Katha, pp. 98–104, Sishu Sahitya Sansad (বাংলা).
  6. Bandopadhyay, Hiranmay, Thakurbarir Katha, pp. 106-113.
  7. Dastider, Shipra। "Jyotirindranath Tagore"Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। ২০০৭-০৪-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২৪ 
  8. Bannerjee, Hiranmay, Thakurbarir Katha, pp.137-138. The author has mentioned the event as Swadeshi Mela, obviously referring to Hindu Mela.

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা