হাসান আল-খাররাত

সিরিয়ান যোদ্ধা

হাসান আল-খাররাত (আরবি: حسن الخراط; ১৮৬১ বা ১৮৭৫[১]–২৫ ডিসেম্বর ১৯২৫) ছিলেন একজন সিরিয়ান জাতীয়তাবাদি এবং ফরাসি মেন্ডেটের বিরুদ্ধে সংঘটিত সিরিয়ান মহাবিদ্রোহের একজন প্রধান নেতা। দামেস্ক ও গাওতায় বিদ্রোহী বাহিনীর সামরিক নেতৃত্বদানের জন্য তিনি বেশি পরিচিত। তিনি দামেস্কের আল-শাগুর মহল্লার বাসিন্দা ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে তিনি বিদ্রোহে যোগ দেন এবং এরপর নিজ মহল্লাসহ অন্যান্য পার্শ্ববর্তী বসতি ও গ্রাম থেকে যোদ্ধাদের নিয়ে সশস্ত্র দল গড়ে তোলেন। অক্টোবরের মধ্যভাগে তিনি দামেস্কে ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহী আক্রমণে নেতৃত্ব দেন এবং এসময় ফরাসি হাইকমিশনার মরিস সারাইলের বাসভবন দখল করতে সক্ষম হন। দামেস্ক থেকে ফিরে আসার সময় তারা ফরাসিদের ব্যাপক বোমাবর্ষণের শিকার হন। তিনি ফরাসি অবস্থানের উপর হামলা অব্যাহত রাখেন। গাওতায় একটি ফরাসি আক্রমণে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি লড়াই চালিয়েছিলেন। ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম এবং লড়াইয়ে মৃত্যুর কারণে হাসান আল-খাররাতকে সিরিয়ায় একজন বীর হিসেবে সম্মান করা হয়।[২]

হাসান আল-খাররাত
حسن الخراط
হাসান আল-খাররাতের পোর্ট্রেট
জন্ম১৮৬১
মৃত্যু২৩ ডিসেম্বর ১৯২৫ (বয়স ৬৩–৬৪)
জাতীয়তাসিরিয়ান
পেশাবসতির প্রহরী, আল-শাগুরের কাবাদাই
পরিচিতির কারণসিরিয়ান মহাবিদ্রোহে দামেস্কের বিদ্রোহী নেতা
সন্তানফাখরি আল-খাররাত

প্রারম্ভিক ও কর্মজীবন সম্পাদনা

হাসান আল-খাররাত ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে দামেস্কের একটি সুন্নি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[৩][৪] তিনি শহরে বেড়ে উঠেছেন। উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা তিনি লাভ করেননি।[৪] তিনি পুরনো শহরের আল-শাগুর কোয়ার্টারের রাত্রিকালীন প্রহরী এবং ফলবাগানের রক্ষী হিসেবে কাজ করেছেন।[৪][৫][৬] ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিক পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।[৭]

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়ায় ফরাসি মেন্ডেট শুরু হয়। মেন্ডেটের শুরুর দিকে হাসান ছিলেন আল-শাগুরের কাবাদাই[৫][৮] কাবাদাই ছিলেন গ্রাম বা মহল্লার প্রথাগত নেতা। স্থানীয় অপরাধীদের কাছ থেকে মহল্লার রক্ষা করার অনানুষ্ঠানিক দায়িত্ব তাদের উপর ছিল। ইতিহাসবিদ ফিলিপ এস. খুরির মতে ব্যক্তিগত ক্ষমতা,[৯] সম্মান এবং সংখ্যালঘু ও দরিদ্রদের রক্ষার জন্য জনতা কাবাদাইদের সম্মানিত হিসেবে দেখত।[১০] তার মতে একজন কাবাদাই সাধারণত গতানুগতিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পরিহার করেন এবং "আরব ঐতিহ্য ও প্রথার ধারক, জনপ্রিয় সংস্কৃতির অভিভাবক" হিসেবে গণ্য হন।[৯][১০] কাবাদাইরা শহরের গণ্যমান্যদের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। গণ্যমান্যদের সাথে বাসিন্দাদের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও কাবাদাইদের সাথে মহল্লার বাসিন্দাদের সরাসরি সম্পর্ক থাকত।[৯]

সিরিয়ান মহাবিদ্রোহে ভূমিকা সম্পাদনা

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মের মধ্যভাগে সুলতান আল-আত্রাশ তার দ্রুজ যোদ্ধাদের নিয়ে অগ্রসর হন এবং জাবাল আল-দ্রুজে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। দামেস্কে আত্রাশ গোত্রীয় তিনজন প্রধান দ্রুজ নেতার গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় এই বিদ্রোহ হয়। ফরাসি কর্তৃপক্ষ সৃষ্ট উত্তেজনা বন্ধের জন্য তাদের দামেস্কে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানায়। এর আগের বছর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্রাশের লোকেরা কয়েকটি লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার ফলে সমগ্র দেশব্যপী সিরিয়ান জাতীয়তাবাদিরা উৎসাহিত হয় এবং উত্তরদিকে দামেস্কসহ অন্যান্য অঞ্চলেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। হাসান আল-খাররাতের সাথে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং দামেস্ক ও গাওতা ভিত্তিক বিদ্রোহীদের প্রধান সংযোগকারী নাসিব আল-বাকরির মিত্রতা ছিল।[৬] তৎকালীন প্রখ্যাত সিরিয়ান জাতীয়তাবাদি নেতা আবদুর রহমান শাহবান্দার হাসান আল-খাররাতকে চর্চাগতভাবে একজন সমাজবাদি বলে বর্ণনা করেছেন।[৫] আল-বাকরির পরিবার আল-শাগুরে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। নাসিব ও তার ভাই ফাউজির সাথে হাসানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে নাসিব আল-বাকরি এবং শাহবান্দারের মধ্যে বৈঠকের পর আল-বাকরি অভ্যুত্থানে যোগ দেয়ার জন্য হাসানকে উৎসাহিত করেন।[১১] আল-বাকরির এই অনুরোধ হাসান সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি বিদ্রোহের জন্য তিনি দামেস্কের বাসিন্দাদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলেন।[৪] ইতিহাসবিদ মাইকেল প্রুভেন্সের মতে হাসান এই কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন।[১১] তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী ইসাবাত আল-শাওয়াগিরাহ নামে পরিচিত ছিল। আল-শাগুর নাম থেকে এই নামের উদ্ভব হয়েছে। তবে তার দলের সদস্যরা জারমানা, কাফর বাতনা, বাইত সাহিম, আল-মালিহা ও আল-আমারা গ্রাম থেকেও এসেছিলেন।[৬] এছাড়াও হাসান দামেস্কের সুফি শাইখ মুহাম্মদ আল-হিজাজের সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সাইদ আল-আসের মতে তারা দুইজন বিদ্রোহে ইসলামি মাত্রা যোগ করেছিলেন।[১১]

 
দ্রুজ শেখ ইজ্জউদ্দিন আল-হালাবির (মধ্যভাগে "x" চিহ্নিত) নেতৃত্বে গাওতায় বিদ্রোহীরা, ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ।

দামেস্কে ফরাসি অবস্থানে রাত্রিকালীন আক্রমণের কারণে হাসান আল-খাররাতের খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আল-শাগুর, সারুজা ও জাজমাতিয়া বসতিতে হাসান ও তার ইসাবাতরা সব ফরাসি ভবন ধ্বংস করে দেয়, ফরাসি বাহিনীর সাথে লড়াই করে তাদের নিরস্ত্র ও বন্দী করে।[৪] পূর্ব গাওতা, বিশেষত বৃক্ষাচ্ছাদিত আল-জুর জঙ্গল এবং আল-শাগুর কোয়ার্টার তার অপারেশনের এলাকা ছিল।[১২] অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে হাসান ও তার যোদ্ধাদের গ্রেফতার করার জন্য ৬০ সদস্যের একটি ফরাসি দল নিযুক্ত করা হয়। তারা আল-মালিহার মুখতারের ("গ্রামপ্রধান") বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সন্ধ্যায় দামেস্ক, গাওতা ও জাবাল আল-দ্রুজের বিদ্রোহীদের নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনী মুখতারের বাড়িতে হানা দেয় এবং পুরো ফরাসি দলকে বন্দী করে। এসময় একজন ফরাসি সৈনিক মারা যায়। বাকিদের নিরস্ত্র করা হয়। অধিকাংশ ফরাসি সৈনিককে তাদের মালপত্র ছাড়া দামেস্কে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে চারজন অফিসারকে জাবাল আল-দ্রুজে পাঠানো হয়েছিল। তারা বিদ্রোহীদের প্রতিহত করেনি জানার পর সুলতান পাশা আল-আত্রাশ তাদের মুক্তি দেন।[৭]

১২ অক্টোবর ফরাসি বাহিনী ট্যাংক, গোলন্দাজ ও বিমান আক্রমণের সহায়তা নিয়ে আল-জুরের জঙ্গলে গাওতা বিদ্রোহীদের আবদ্ধ ও উৎখাতের জন্য ব্যাপক আকারে অপারেশন শুরু করে। ফরাসিরা বারাদা নদীর তীর ধরে হাসান আল-খাররাতের লোকেদের অনুসরণ করলেও তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আল-মালিহার কিছু বাসিন্দা ফরাসি অভিযানের ব্যাপারে বিদ্রোহীদের পূর্বেই তথ্য দিয়েছিল। ফরাসিরা অপারেশন থেকে ফিরে আসার পর গ্রাম লুঠ করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়।[১৩] ফরাসি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি মতে এক সপ্তাহ পূর্বে আল-মালিহার এক বালক ফরাসিদের উপস্থিতি সম্পর্কে হাসানের বাহিনীকে জানানোর কারণে গ্রামের উপর সম্মিলিতভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এভাবে ফরাসি গোয়েন্দারা বিদ্রোহীদের কর্তৃক ফরাসি বাহিনীর বন্দীত্বের জন্য সহায়তা করার কারণে প্রতিশোধ হিসেবে গ্রামের উপর হামলাকে যথাযথ বলেছে।[১৪]

ফরাসিরা অগ্রসর হয়ে ইতিপূর্বে বোমাবর্ষণের শিকার হওয়া জারামানায় লুঠপাট চালায় এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। এখানে অনেক দ্রুজ বাসিন্দা থাকত। এর ফলে জাবাল আল-দ্রুজের দ্রুজ বিদ্রোহীরা ক্রোধান্বিত হয় এবং তারা তাদের স্বগোত্রীয়দের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নেয়। ফরাসিরা হাসানের বাহিনীর সাথে সরাসরি লড়াইয়ে নামতে সক্ষম না হলেও গাওতা গ্রামের প্রায় ১০০ জন বেসামরিক বাসিন্দাকে হত্যা করে। তাদের লাশ দামেস্কে নিয়ে আসা হয়। নিহতদের মধ্যে ১৬ জনকে ফরাসিরা ডাকাত হিসেবে বর্ণনা করে এবং তাদের লাশ দিনের বেশিরভাগ সময় প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়।[১৪]

দামেস্কের যুদ্ধ সম্পাদনা

 
জেনারেল মরিস সারাইল, সিরিয়ায় ফরাসি মেন্ডেটের হাইকমিশনার।

দ্রুজদের কর্মকাণ্ডের খবর পেয়ে আল-বাকরি ফরাসি বাহিনীর অবস্থানস্থল দামেস্কের দুর্গ এবং আজম প্রাসাদ দখলের পরিকল্পনা করেন। হাইকমিশনার মরিস সারাইল ১৭-১৮ অক্টোবর এই প্রাসাদে থাকবেন বিদ্রোহীরা এমন তথ্য পেয়েছিল।[১৫] হাইকমিশনার একজন জেনারেল ছিলেন। তিনি ফ্রান্সের তরফ থেকে সিরিয়ার সামগ্রিক প্রশাসন পরিচালনা করতেন এবং সর্বময় ক্ষমতা তার হাতে ছিল।[১৬] সারাইলকে বন্দী করা ছিল বিদ্রোহীদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।[১৪] এসময়ে দামেস্কে বিদ্রোহীদের মধ্যে শুধু হাসান আল-খাররাতের ইসাবাত বাহিনী এবং জাবাল আল-দ্রুজ, আল-মিদান ও গাওতার যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি মিশ্র বাহিনী ছিল। এ কারণে সুলতান আল-আত্রাশকে আল-বাকরি অতিরিক্ত যোদ্ধা পাঠাতে বলেন। আল-আত্রাশ উত্তর দেন যে তিনি হাওরানে অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত আছেন তবে তিনি এখানকার সামরিক তৎপরতা শেষ করার পর দামেস্কে তার পুরো দল নিয়ে যোগ দেবেন। হামা অঞ্চলের বিদ্রোহী নেতা ফাওজি আল-কায়ুকজিকেও আসতে বলা হয়। কিন্তু ফিরতি চিঠি দামেস্কে এসে পৌছার আগে আল-বাকরি অপারেশন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন।[১৫]

১৮ অক্টোবর হাসান তার ৪০ জন যোদ্ধাকে নিয়ে দক্ষিণের বাব আল-সাগির ফটকের পুরনো কবরস্থান দিয়ে আল-শাগুর কোয়ার্টারে প্রবেশ করেন। এখানকার বাসিন্দারা বিদ্রোহীদের সাদরে গ্রহণ করে। তাদের অনেকে অস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। হাসানের লোকেরা প্রথমে কোয়ার্টারের থানা দখল করে এবং একে নিরস্ত্র করে।[১৭] এরপর দাইর আজ-জুরের বিদ্রোহী নেতা রামাদান আল-শাল্লাশ তার ২০জন বেদুইন যোদ্ধাকে নিয়ে হাসান আল-খাররাতের সাথে যোগ দেন। এই যৌথ বাহিনী এরপর হামিদিয়া বাজারের দিয়ে অগ্রসর হয় এবং এখান থেকে তারা আজম প্রাসাদ দখল করে নেয়।[১৭][১৮] তবে জেনারেল সারাইল এর পূর্বেই একটি বৈঠকের জন্য দক্ষিণাঞ্চলের দারআ শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন।[১৭]

আল-বাকরি ও তার আল-মিদানের যোদ্ধারা শহরে ছড়িয়ে পড়ার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং বেসামরিক জনতা ব্যাপকভাবে তাদের সাথে যোগ দিতে থাকে।[১৭] হাসান আদেশ দেন যাতে ফরাসি বাহিনীর সাথে জড়িত যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ১৮০ জন ফরাসি সেনা নিহত হয়েছিল। তিনি এরপর পুরনো শহরে ফরাসি সেনা প্রবেশ বন্ধ করেন। সারাইল শহরে আকাশপথে গোলাবর্ষণের জন্য নির্দেশ দেন। ইতিহাসবিদ ফিলিপ এস. খুরির মতে এই বিমান হামলায় ১,৫০০ জন নিহত হয়েছিল।[১৯] তবে সামি মাওবায়েদের মতে দুই দিনের হামলায় ৬,০০০ জন নিহত হয়েছিল। বসতি, মসজিদ ও গির্জা ধ্বংস এবং সিরিয়ান জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের কয়েকশত নেতৃস্থানীয় নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে পুরো রাজধানী জুড়ে বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্ন লড়াই শুরু হয়।[১৮] গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে হাসানের পুত্র ফাখরিও ছিলেন।[৬] ২২ অক্টোবর দামেস্ক নিয়ন্ত্রণকারী ফরাসি বাহিনীর উপর বিদ্রোহীদের একটি রাত্রিকালীন হামলার সময় ফাখরি গ্রেপ্তার হন।[১২] সারাইল ও দামেস্কের গণ্যমান্য শ্রেণীর প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠকের পর ২৪ অক্টোবর ফরাসিরা শহরের উপর বোমাবর্ষণ বন্ধ করে।[১৯]

গাওতায় পরবর্তী কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে হাসান আল-খাররাতের যোদ্ধারাসহ আরও তিনটি বিদ্রোহী গ্রুপ গাওতা জুড়ে ফরাসি অবস্থানের উপর হামলা চালায়। ২২ নভেম্বর হাসান প্রায় ৭০০ জন যোদ্ধার একটি দলকে নিয়ে দামেস্কের বাইরে প্রায় ৫০০ জন ফরাসি সৈনিকের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। হাসানের বাহিনী ফরাসিদের ক্ষতি করতে পারলেও তার নিজের বাহিনীর ৩০জন নিহত এবং ৪০জন আহত হয়।[২০] ৫ ডিসেম্বর হাসান আল-খাররাত, আবদুল কাদির সুক্কার, সুলতান আল-আত্রাশের ভাই জায়েদ, ইজ্জউদ্দিন আল-হালাবি এবং খলিল আল-বাসালি ২,০০০ বিদ্রোহী যোদ্ধাকে নিয়ে দামেস্কের দক্ষিণে আল-কাদামে ফরাসি সেনা ঘাটিতে আক্রমণ করেন।[২১]

বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যকার অমিল ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ফলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ছিল। ২৬ নভেম্বর সাকবা গ্রামে বিদ্রোহী নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।[২২] এই বৈঠকে সাইদ আল-আস গাওতায় লুঠতরাজের জন্য হাসান আল-খাররাত, দুমা ভিত্তিক আকাশা ভ্রাতৃবৃন্দ এবং দ্রুজ ও বেদুইন যোদ্ধাদের অভিযুক্ত করেন।[২৩] আল-শাল্লাশের বিরুদ্ধে হাসান আল-মিদান ও দুমার বাসিন্দাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের অভিযোগ করেন।[২৪] তবে বিতর্ক সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বিদ্রোহী কমান্ডের মাধ্যমে গাওতার বাসিন্দাদের মধ্য থেকে যোদ্ধা সংগ্রহ বৃদ্ধি ও সমন্বিত সামরিক আক্রমণ পরিচালনা এবং গুপ্তচরদের মৃত্যুদন্ডের জন্য একটি বিপ্লবী আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সরকার গঠনের ব্যাপারে সমঝোতা হয়। এই বৈঠকে জাবদিন গ্রাম এবং দুমা সড়কের উত্তরের মধ্যবর্তী স্থান আল-খাররাতের সামরিক অঞ্চল হিসেবে গৃহীত হয়। বিদ্রোহীদের সামরিক তৎপরতায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন সত্ত্বেও হাসান আল-খাররাতকে এবং আল-বাকরির মিত্রদের কাউকে নবগঠিত বিদ্রোহী কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আল-আস বিদ্রোহীদের সামগ্রিক প্রধান হন।[২৩]

বিদ্রোহী নেতাদের সাথে উত্তেজনা সম্পাদনা

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর সাকবায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৈঠকে বিদ্রোহীদের মধ্যে মতপার্থক্য ফুটে উঠে। সিরিয়ান সাংবাদিক ও জাতীয়তাবাদি আন্দোলনকারী মুনির আল-রাইসের মতে হাসান আল-খাররাত এবং আল-শাল্লাশের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ব্যাপারে বিদ্রোহীরা জ্ঞাত ছিল।[২২] তাছাড়া আল-শাল্লাশ প্রধান ভূস্বামী এবং শহরের অভিজাতদের উপর কর ধার্য করার ফলে হাসানের মিত্র আল-বাকরি তাকে শহরের প্রথাগত অভিজাত শ্রেণীর প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছিলেন।[২৫] আল-বাকরি নিজেও এই শ্রেণীর সদস্য ছিলেন। মুনির আল-রাইস দাবি করেছেন যে হাসান এই বৈঠক আহ্বান করেচিলেন এবং আল-শাল্লাশকে গ্রেপ্তার করে সাকবায় নিয়ে আসার জন্য তার অনুসারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।[২৬] তবে আল-আসের মতে আল-শাল্লাশ এই বৈঠক আহ্বান করেছিলেন এবং আল-শাল্লাশ গ্রামে পৌছানোর পর হাসান তাকে আটক করে তার ঘোড়া, অস্ত্র ও অর্থ বাজেয়াপ্ত করেন।[২৭]

গ্রেপ্তারের পর আল-শাল্লাশকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এতে হাসান আল-খাররাত তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামে অর্থ আদায়ের অভিযোগ তোলেন। অন্যদিকে আল-বাকরি তার বিরুদ্ধে দুমার বাসিন্দাদের কাছ থেকে ১,০০০ গিনি অর্থ আদায়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলেন।[২২] সেসাথে ব্যক্তিগত লাভের জন্য হারান আল-আওয়ামিদ, আল-কিসা ও আল-মিদার বাসিন্দাদের উপর অতিরিক্ত জরিমানা ধার্যে‌র অভিযোগ করেন।[২৮] ফরাসি গোয়েন্দা নথি অনুযায়ী আল-শাল্লাশ দুমার সবচেয়ে বড় ও ফরাসিপন্থি ভূস্বামীর উপর ২,০০০ গিনি জরিমানা ধার্য করেছিলেন।[২২] রায়ে আল-শাল্লাশকে বিদ্রোহ থেকে বাদ দেয়া হয় এবং তার দপ্তর কেড়ে নেয়া হয়।[২৫] বিদ্রোহীদের অনেক অফিসার শ্রেণীর ব্যক্তি এই রায়ে অসন্তুষ্ট হলেও তারা এতে হস্তক্ষেপ করেনি।[২২] আল-রাইস এই বিচারের জন্য বিদ্রোহী নেতাদের দোষারোপ করেছেন এবং আল-খাররাতকে প্রতিশোধ গ্রহণের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।[২৬] আল-আসের প্রতিবাদের পর আল-শাল্লাশকে তার ঘোড়া ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তার উপর আর কোনো শাস্তি প্রয়োগ হওয়ার পূর্বে গ্রামে ফরাসি বিমান আক্রমণের কারণে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আল-আস দাবি করেছেন যে গ্রামে বোমা হামলা হওয়ায় তিনি তাকে মুক্তি দিয়েছেন।[২৭] আল-শাল্লাশ পরে নতুন ফরাসি হাইকমিশনার হেনরি দ্য জুভেনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং এরপর ফরাসি কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করেছেন।[২৯]

মৃত্যু ও স্মরণ সম্পাদনা

 
হাসানের পুত্র ও বিদ্রোহী কমান্ডার ফাখরি আল-খাররাতকে মারজাহ চত্বরে ফাঁসি দেয়া হয়, জানুয়ারি ১৯২৬

২৫ ডিসেম্বর গাওতায় ফরাসি আক্রমণের সময় আল-খাররাত নিহত হন।[২৬] বিদ্রোহের বাকি সময়জুড়ে তার যোদ্ধারা ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল।[৩০] ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বিদ্রোহ শেষ হয়। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ফরাসি কর্তৃপক্ষ আল-খাররাতের পুত্র ফাখরি এবং আরও দুইজন বিদ্রোহ যোদ্ধাকে মারজাহ চত্বরে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়।[৩১] বন্দীত্ব থেকে মুক্তির বিনিময়ে পিতাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করানোর জন্য ফরাসিরা ফাখরিকে প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ফাখরি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[১২]

সিরিয়ান জাতীয়তাবাদি নেতা আবদুর রহমান শাহবান্দার গাওতা ও দামেস্কে ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাসান আল-খাররাতকে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[৫] ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল নিপ লিখেছেন যে আল-খাররাত ছিলেন দামেস্ক ভিত্তিক বিদ্রোহী নেতাদের মধ্য সবচেয়ে পরিচিত।[৬] ফিলিপ এস. খুরি বলেছেন যে আল-খাররাত ছিলেন কাবাদাইদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত।[৮] আল-খাররাত ও তার পুত্র ফাখরি তাদের কর্মকাণ্ড এবং ফরাসি বিরোধী সংগ্রামে নিহত হওয়ার কারণে সিরিয়ানদের কাছে শহীদ হিসেবে সম্মানিত হন।[১১][২৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

উদ্ধৃতি সম্পাদনা

  1. Author Sami Moubayed lists the birth year as 1861 (Moubayed, 2006, p. 381,) while author Michael Provence writes al-Kharrat was 50 years old in late 1925 (Provence, 2005, p. 100.)
  2. Provence, 2005, p. 119.
  3. Syria Opposition Leader Interview Transcript. Wall Street Journal. 2011-12-02.
  4. Moubayed, 2006, p. 381.
  5. Batatu, 1999, p. 117.
  6. Neep, 2012, pp. 79–80.
  7. Provence, 2005, p. 100.
  8. Burke and Khoury, 2006, p. 157.
  9. Burke and Khoury, 2006, p. 152.
  10. Burke and Khoury, 2006, p. 154.
  11. Provence, 2005, p. 101.
  12. Provence, 2005, p. 118.
  13. Provence, 2005, pp. 101–102.
  14. Provence, 2005, p. 102.
  15. Provence, 2005, pp. 102–103.
  16. Peretz, 1994, pp. 365–366.
  17. Provence, 2005, p. 103.
  18. Moubayed, 2006, p. 382.
  19. Provence, 2005, pp. 104–105.
  20. Reuters (১ জানুয়ারি ১৯২৬)। "Syrian Revolt: Hassan Kharrat Killed"The Advocate। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৪-০৭ 
  21. Provence, 2005, p. 116.
  22. Provence, 2005, pp. 134–135.
  23. Neep, 2012, p. 81.
  24. Neep, 2012, p. 83.
  25. Provence, 2005, p. 134.
  26. Provence, 2005, p. 135.
  27. Provence, p. 137.
  28. Provence, 2005, p. 136.
  29. Provence, 2005, pp. 138–139.
  30. Provence, 2005, p. 138.
  31. Neep, 2012, p. 54.

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা