হাট্টিমাটিম টিম

শিশুতোষ ছড়া

হাট্টিমাটিম টিম (মূল: হাট্টিমা টিম্ টিম্) শিশুদের জন্য উপযোগী একটি বাংলা লোকজ ছড়া।[টীকা ১] বাঙালি শিশুদের একদম ছোটবেলা থেকেই এই ছড়াটি শোনানো হয়ে থাকে। এই ছড়াটি একসময় বাংলাদেশের শিক্ষামাধ্যমের প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এখন নেই।[২]

হাট্টিমাটিম টিম 
১৮৯৯ সালে সিটি বুক সোসাইটি প্রকাশিত “খুকুমণির ছড়া” বইয়ের ১৩ তম সংষ্করণের ৩৭ নাম্বার পৃষ্ঠা।
ভাষাবাংলা
গঠনশিশুতোষ ছড়া
প্রকাশনার তারিখ১৮৯৯[১]
লাইন

ইতিহাস সম্পাদনা

হাট্টিমা টিম্ টিম্
তারা মাঠে পাড়ে ডিম্!
তাদের খাড়া দুটো শিং,
তারা হাট্টিমা টিম্ টিম্।

হাট্টিমা টিম্ টিম্ একটি লোকায়ত ছড়া। অনেক কাল ধরে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলিত হয়ে আছে। কে রচনা করেছেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

১৮৯৯ সালে ভারতের কোলকাতার সিটি বুক সোসাইটি প্রকাশিত “খুকুমণির ছড়া” বইয়ের ১৩ তম সংষ্করণের ৩৭ নাম্বার পৃষ্ঠায় “হাট্টিমাটিম টিম” ছড়াটি পাওয়া যায়। যেটা যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সংকলিত একটা বই।

কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা ‘শিশু সাহিত্য সংসদ’ ১৯৫০ সালে ছোটোদের জন্য ‘ছড়ার ছবি’ নামে রঙিন ছবি সমন্বিত একটি ছড়ার বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ের মধ্যে ‘হাট্টিমা টিম্ টিম্’ নামক কাল্পনিক প্রাণীটিকে নিয়ে চার লাইনের ছড়াটি সংকলিত হয়।

আবার ১৯৫২ সালে প্রকাশিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইয়ের ‘দুর্ধর্ষ মোটর সাইকেল’ শিরোনামের গল্পে ‘হাট্টিমাটিম টিম, তারা মাঠে পারে ডিম’ লাইন দুটি গল্পের একটি প্রধান চরিত্র প্যালারাম-এর ভাষ্যে ব্যবহার করেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।

বইটির ছড়াগুলি সংকলন করেন শ্রী মহেন্দ্রনাথ দত্ত। বইটি প্রকাশনার পর হাট্টিমা টিম টিম নামক কাল্পনিক প্রাণীটি ছোটোদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপরে, ১৯৭৪ সালে তৎকালীন দ্যা গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া' (বর্তমানে ‘সারেগামা’) ছয়টি ছড়াকে গানের রূপ দিয়ে একটি রেকর্ড প্রকাশ করেন[৩] (রেকর্ড নম্বর: 7LPE 110)। এই রেকর্ডে হাট্টিমা টিম টিম ছড়াটিরও গীতিরূপ অন্তর্ভুক্ত হয়। গানটি গেয়েছিলেন শ্রীমতি আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংগীত পরিচালনা করেছিলেন শ্রী নচিকেতা ঘোষ। রেকর্ডে এই ছড়াটিকে প্রচলিত হিসাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু সারেগামার ইউটিউব ভিডিয়োতে গীতিকার হিসেবে অন্নদাশংকর রায়ের নাম উল্লেখ করা আছে।[৪] ধীমান দাশগুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্নদাশঙ্কর নিজেই বলেছিলেন,

আমার কাছে আদর্শ ছড়া ছিল ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে,’ ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো,’ ‘হাট্টিমাটিম টিম,’ এইসব। খাঁটি লোক সংস্কৃতি, মুখে মুখে যা ছড়িয়ে পড়ে, পুরুষানুক্রমে যা সঞ্চারিত হয়। একদিকে এই আর একদিকে হিউমারাস বা নন সেন্স কিছু। এই সব লোকছড়ায় কতদিনের অভিজ্ঞতা, ফোক উইসডম ধরা থাকে।

এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, অন্নদাশংকর রায়ের লেখা নয়।

আবার অন্নদাশংকর তার ‘জলসা’ শিরোনামের ছড়ার মধ্যে ‘হাট্টিমাটিম টিম, ওরা মাঠে পারে ডিম’ - এই লাইন দুটি ব্যবহার করেছিলেন (এই ছড়ায় তিনি ইংরেজী লোকায়ত ছড়া থেকে ‘হাম্পটি, ডাম্পটি স্যাট অন এ ওয়াল’ এই দুটি লাইনও ব্যবহার করেছিলেন)।

দ্যা গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়ার তৈরি রেকর্ডটি প্রকাশমাত্রেই গানটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বিভ্রান্তি সম্পাদনা

 
১৯৬২ সালে কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রোকনুজ্জামান খানের লেখা প্রথম ছড়ার বই ‘হাট্ টিমা টিম’ এর প্রচ্ছদ এবং শিরোনাম কবিতা।

২০১৮ সালে শেষের দিকে সামাজিক ম্যাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্ট ভাইরাল হয় যেখানে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইকে বিখ্যাত ‘হাট্টিমা টিম্ টিম্’ ছড়াটির লেখক দাবি করার পাশাপাশি মূল ছড়াটি ৫২ পঙ্​ক্তির দাবি করা হয়।[৫]

এই ছড়াটি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মূল কারণটি হলো ‘হাট্ টিমা টিম’ নামে রোকনুজ্জামান খানের লেখা একটি ছড়ার বই আছে এবং সেই বইতে “হাট্ টিমা টিম” নামে তার লেখা একটি ছড়াও আছে যেটা সাথে মূল ‘হাট্টিমা টিম্ টিম্’ ছড়ার কোনো মিল নেই। রোকনুজ্জামান খানের লেখা এই ছড়ার বইটি ১৯৬২ সালে কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়।[৬] যা লেখকের প্রকাশিত তৃতীয় এবং প্রথম ছড়াগ্রন্থ। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন হাশেম খান। ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা থেকে ২য় সংস্করণ এবং ১৯৯৭ সালে ব্রাক থেকে বহুরঙা প্রচ্ছদপট ও অঙ্গসজ্জায় বইটির ৩য় সংস্করণ বের হয়; এই দুই সংস্করণেও রয়েছে শিল্পী হাশেম খানের ছোঁয়া।[৭] ভাইরাল পোস্টের লেখক এই দুটো বিষয়কে একসাথে ফেলেছিলেন।

৫২ পঙ্​ক্তির আসল লেখক যুক্তরাজ্য প্রবাসী নাদিয়া জামান। ২০১২ সালে তিনি সামহোয়্যার ইন ব্লগে পঙ্​ক্তিগুলি প্রকাশ করেন। তিনি ৪৮ পঙ্​ক্তি নিজে লিখে শেষের ৪ পঙ্​ক্তিতে প্রচলিত ‘হাট্টিমা টিম্ টিম’ ছড়াটি জুড়ে দেন।[৮]

টীকা সম্পাদনা

  1. ১৮৯৯ সালে ভারতের কোলকাতার সিটি বুক সোসাইটি প্রকাশিত “খুকুমণির ছড়া” বইয়ের ১৩ তম সংষ্করণের ৩৭ নাম্বার পৃষ্ঠায় “হাট্টিমাটিম টিম” ছড়াটি পাওয়া যায়। যেটা যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সংকলিত একটা বই।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সরকার, যোগীন্দ্রনাথ (১৮৯৯)। খুকুমণির ছড়া (পিডিএফ)। কোলকাতা: সিটি বুক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩৭। 
  2. আমার বাংলা বই (শিক্ষক সংষ্করণ) - প্রথম শ্রেণী। বাংলাদেশ: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০২০। 
  3. "The Gramophone Company of India (HMV) Records Listing"। এপ্রিল ১৮, ২০২২। 
  4. "Chhotto Pakhi Chandana By Alpana Banerjee"ইউটিউব। জুলাই ৩, ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ৮ এপ্রিল ২০২২ 
  5. "'হাট্টিমাটিম' আসলে ৫২ লাইনের একটি ছড়া, সঙ্গে রইল লেখক পরিচিতি"এবেলা। ২১ মার্চ ২০১৮। ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ 
  6. খান, রোকনুজ্জামান (১৯৬২)। হাট্ টিমা টিমবাংলাদেশ: কাকলী প্রকাশনী। আইএসবিএন 9841900904 
  7. জয়েনউদ্দীন, খালেক বিন। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইবাংলাদেশ: বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ৫৮। 
  8. জামান, নাদিয়া, হাট্টিমাটিম গল্প 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা