সৈয়দ শাহনুর
সৈয়দ শাহনূর (জন্ম ১৭৩০ - মৃত্যু ১৮৫৪) একজন বাংলাদেশী মরমী কবি ও সাহিত্যিক। তিনি সাধক কবি ও পীর হিসেবে সমধিক পরিচিত। সৈয়দ শাহনূর বিরচিত আধ্যাত্মিক গান বাংলাদেশের মরমী ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে। সিলেটের মরমী সাহিত্যে সৈয়দ শাহ নুরকে সকলের উর্ধে স্থান দেয়া হয়। এছাড়া তত্বসংগীত রচনায় বাংলার বিখ্যাত কবি লালন শাহের পূর্বসুরী হিসেবে সৈয়দ শাহনুর অনুমিত হন।[১] চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভুষণ সহ গবেষকদের মতে সৈয়দ শাহনুরের রচিত আধ্যাত্মিক গান ভাববাদী মানুষকে আধ্যাতিক জগতের সন্ধান দিতে সহায়ক।[২][৩] বাংলা সাহিত্যের প্রথমিক যুগে সৈয়দ শাহনুর রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ নুর নছিয়ত। যা ছিল সিলেটের স্বতন্ত্র নাগরী লিপিতে লিখা অমুদ্রিত সুফী শাস্ত্র গ্রন্থ। রচনার সময় কাল ১২২৬ বাংলা মোতাবেক ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দ । ৩০২ পৃষ্ঠায় রচিত এ গ্রন্থে ১০৮ টি গান, ৪১ ধাঁধা রয়েছে। এছাড়া রাগনূর, নূরের বাগান, সাত কন্যার বাখান ও মণিহার নামে আরও চারটি বই তিনি লিখেছেন।[৩]
সৈয়দ শাহনূর | |
---|---|
জন্ম | ১৭৩০ |
মৃত্যু | ১৮৫৪ |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
পেশা | কবি ও সাহিত্যিক |
পরিচিতির কারণ | সাধক কবি ও পীর |
পরিচিতি
সম্পাদনাশাহ জালালের সঙ্গীয় দরবেশ সৈয়দ শাহ আলাউদ্দিনের পুত্র সৈয়দ শাহ রোকন উদ্দিনের অধঃস্থন পুরুষ সৈয়দ শাহনুর। তার পিতা সৈয়দ মোহাম্মদ নূর, মাতা কলসী বিবি। সৈয়দ শাহনুর কোথায় জন্ম গ্রহণ করেছেন এ নিয়ে গবেষকগণ ভিন্ন মত ব্যক্ত করেন। প্রখ্যাত গবেষক আসদ্দর আলীর মতে মৌলভীবাজার জেলায় কুলাউড়া উপজেলার ঘরগাও গ্রামে তার জন্ম হয়।[৩]
পারিবারিক জীবন
সম্পাদনাসৈয়দ শাহনূর দুটি বিয়ে করেন বলে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা লিখেন। তিনি প্রথম বিয়ে করেন রাজনগর উপজেলার কদমহাটা গ্রামের মুহাম্মদ দরছ মিয়া চৌধুরীর কন্যা হামিদা খাতুনকে। পরে তিনি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে বসবাস করেন এবং সেখানে বিয়ে করেন সামিনা বানুকে। সৈয়দপুরে কয়েক বছর বসবাসের পর শাহনূর আবার কদমহাটায় স্ত্রীসহ চলে আসেন এবং কদম হাটার নিকটে বিনেছিরিতে বসবাস করেন।[৩] বিনেছিরি উল্লেখ্য সৈয়দ শাহ নুরের রচিত একটি গানে পাওয়া যায়ঃ
“ | "কদম হাটা বিনিছিরি -- শাহনুরে বানাইল বাড়ী শাহনুর থাকইন চাড়াল পাড়ার মাঝে" |
” |
উল্লেখিত বিনিছিরি মৌলভীবাজার জেলার কদমহাটা গ্রামে নিকট অবস্থিত এবং চাড়াল পাড়া মুলত সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের ছোট একটি পাড়া বলে ঐতিহাসিক আসদ্দর আলী সহ অনেকের ধারণা। সৈয়দ শাহনুরের মাজার হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলাধীন জালালসাপ গ্রামে অবস্থিত। সৈয়দ শাহনুরের দুই ছেলে মঞ্জুর আলী ও তবারক আলী থেকে তার বংশবৃদ্ধি হয়ে জালাসাপ, বিনিছিরি ও সৈয়দপুরে বসবাস করছেন।[২]
সৈয়দ শাহ্ নুরের মুর্শিদ শাহ্ মঞ্জুর আলী নূরের তো শেষ নাই,নূর নাম খালি। পীরের পীর ভজিয়া কহি শাহ্ চান্দের চরণ মুর্শিদ শাহ্ মঞ্জুর আলী পীর শাহ্ চান্দ আমার গলে দেখিলাম প্রেম রসের ফান্দ।
সৈয়দ পুরের চাড়াল পাড়ার অলৌকিক ঘটনা
সম্পাদনাজগন্নাথপুর উপজেলার খ্যাতনামা সৈয়দপুর গ্রাম। এ গ্রামটিতে সৈয়দ শাহনুর বসবাস করেছেন অনেক দিন। এছাড়া এখানে তিনি বিয়ে করেছেন সামিনা বানুকে। সর্বদিক বিশ্লেষনে পাওয়া যায়, সৈয়দপুর গ্রাম-এর সাথে সৈয়দ শাহনুরের সম্পর্ক ছিল গভীর। এতদসত্বে সৈয়দ পুরের চাড়াল পাড়া সাথে সৈয়দ শাহনুরের আধ্যাত্মিক ভাবে একটি সম্পর্কের উল্লেখ এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত । আজ থেকে প্রায় তিন শত বত্সর পূর্বে সৈয়দ শাহনুরকে নিয়ে এই গ্রামে ঘটিত এক অলৌকিক কাহিনী যা আজও সিলেট বিভাগে বহুল প্রচার হচ্ছে। সে কাহিনী উল্লেখিত চাড়াল পাড়ার হিন্দু ধোপার বাড়ি নিয়ে । সৈয়দ পুরের থাকা কালে এক শুক্রবার দিবসে গ্রামবাসী মুসল্লীদের চাপে পড়ে সৈয়দ শাহনুরকে নামাজ আদায়ে মসজিদে যেতে হয়। ইসলামিক রেওয়াজ মতে ইমামের পিছনে মুসল্লীরা যখন এক কাতারে (সারিতে) জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ শুরু করেন। সৈয়দ শাহনুরও অন্য মুসল্লীদের মতই সারিতে জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করছেন ঠিক কিছুক্ষন পরেই সৈয়দ শাহনুর উত্তর দহ্মিণ পূর্ব প্রশ্চিম চার দিকে চার সজিদাহ দিয়ে ইমাম সহ অন্য সবার নামাজ শেষ করার পূর্বেই তার নামাজ শেষ করে তিনি মসজিদ থেকে বাহির হলেন । যা ছিল ইসলামের আইন পরিপন্থি একটি অপরাধ জনিত কাজ। নামাজ শেষে মসজিদের মুসল্লীরা গ্রামের মাতেব্বরদের একত্রিত করে সৈয়দ শাহনুরের ইসলাম পরিপন্থি এ ধরনের কাজ করার জন্য তাকে দণ্ডিত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। গ্রাম মাতেব্বরা সৈয়দ শাহনুরকে ডেকে এনে এ ধরনের কর্মে জন্য তার মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে, সৈয়দ শাহনুর বলেন, মসজিদের ইমাম শহরে গিয়ে ফেরত আসার সময় নিজ ছাতা হারান। যা নিয়ে তিনি নামাজের মধ্যে সজিদাহ আদায় কালে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। যে নামাজ আল্লাহ'র ধ্যান ব্যতীত সাংসারিক বিষয়ের চিন্তা নিয়ে আদায় করা হয়, সে নামাজ আমার কোন কাজের ? মাতব্বররা ইমামকে ডেকে বিষয়টি জেনে বুঝতে পারলেন সৈয়দ শাহনুর আধ্যাত্মিক ভাবে প্রবল । তার কাছে গোপন বিষয়ও প্রকাশিত । এরপরেও মাতব্বরগণের বাড়াবাড়ির আর শেষ ছিল না। অবশেষে শুকনা মাঠ দিয়ে নৌকা চালিয়ে সৈয়দ শাহনুরকে সৈয়দপুর ত্যাগ করে আসতে হয় । সৈয়দ শাহনুরের উক্ত ঘটনাটি বিভিন্ন কবি বাউলদের ছন্দে আজও সিলেট বিভাগের জেলায় জেলায় ধ্বনিত হচ্ছে এ ভাবে;
“ | "ইশারাতে কাঠের তরী শুকনায় চলে মাঠে ভক্ত যারা, পার হতে চায় সে তরীতে উঠে "[২] |
” |
সৈয়দ শাহনুরের তত্বসংগীতের আংশিক
সম্পাদনা“ | "আমি, না চিনিলামরে সঙ্গে আইলাম কার আখিঁ মুঞ্জিলে ঘর হইব অন্ধকার তিনে জুড়িয়াছে চাইরে কইল মূল বসতি নাই কোথায় শুনি বোল" |
” |
“ | "পাক পানি চিয়া নাও বাইও-রে ওরে আমার আ'উশের নাইয়া ও ভাই-রে পাক পানি চিনিয়া নাও বাইও আড়ি কোনায় কইল সাঁজ, ঈশানিয়া বাও দখিনাল বাতাসে মাইলো ময়ুর পঙ্খী নাও-রে""[২] |
” |
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ লাল সাহের পূর্বসুরী হিসেবে সৈয়দ শাহনুর অনুমিত। এখানে দেখুন (dcsunamganj) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ আগস্ট ২০১১ তারিখে
- ↑ ক খ গ ঘ সিলেটের মরমী মানস সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রকাশনায়- মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, প্রকাশ কাল ২০০৯
- ↑ ক খ গ ঘ সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত। মোহাম্মদ মুমিনুল হক। প্রাকাশনায় - সেন্টার ফর বাংলাদেশ রিসার্চ ইউ. কে. গ্রন্থ প্রকাশকাল, সেপ্টেম্বর ২০০১।