সুপ্ততাপ (সুপ্তশক্তি বা রূপান্তর তাপ নামেও পরিচিত) হলো তাপমাত্রা স্থির রেখে কোনো বস্তু বা তাপগতীয় সিস্টেমের এক দশা থেকে অন্য দশায় রূপান্তরের সময় গৃহীত বা বর্জিত তাপশক্তি। এটি সাধারণত প্রথম ক্রমের দশা রূপান্তর। বস্তুত, যে তাপশক্তি কোনো বস্তুর তাপমাত্রার পরিবর্তন না ঘটিয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় তাকেই সুপ্ততাপ বলা হয়ে থাকে।

সুপ্ততাপ মূলত বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তি যা তাপমাত্রার পরিবর্তন না করেই পদার্থের এক দশা থেকে অন্য দশায় রূপান্তর করে। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও চাপে গলনের সুপ্ততাপ পদার্থের কঠিন থেকে তরলে রূপান্তরের সুপ্ততাপকে এবং বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ তরল থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরের সুপ্ততাপকে নির্দেশ করে।[১][২]

১৭৬২ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদ জোসেফ ব্ল্যাক প্রথম "ল্যাটেন্ট হিট" (সুপ্ততাপ) কথাটি ব্যবহার করেন। ল্যাটিন শব্দ ল্যাটেরে বা ল্যাটেন্স (অর্থ: অন্তর্নিহিত থাকা) থেকে ইংরেজি "ল্যাটেন্ট" শব্দের উৎপত্তি। ব্ল্যাক ক্যালোরিমিতি প্রসঙ্গে এটি ব্যবহার করেছিলেন, যেখানে তাপ প্রদানে বস্তুর আয়তন পরিবর্তিত হয় কিন্তু তাপমাত্রা ধ্রুব থাকে।

সুপ্ততাপের বিপরীত ধারণা প্রকাশ করে অনুভূত তাপ (সেন্সিবল হিট), যা বস্তুর তাপমাত্রা পরিবর্তনের মাধ্যমে গৃহীত বা বর্জিত তাপশক্তিকে নির্দেশ করে।

ব্যবহার সম্পাদনা

অনুভূত তাপ ও সুপ্ততাপ মূলত কোনো বস্তু ও তার পরিবেশের মধ্যে আদান-প্রদানকৃত তাপশক্তিকে নির্দেশ করে, শুধুমাত্র তাপমাত্রার পরিবর্তন হওয়া বা না হওয়ার ভিত্তিতে এদেরকে পৃথক করা হয়। উভয়ই বস্তুর উপাদানের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। অনুভূত তাপ বস্তুর তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় অনুভব করা বা বোঝা যায়। অন্যদিকে সুপ্ততাপ হলো বস্তুটির তাপমাত্রা অপরিবর্তিত রেখে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় নিতে যে তাপশক্তির আদান-প্রদান হয়, উদাহরণস্বরূপ: দশা পরিবর্তন (কঠিন/তরল/গ্যাস)।

সুপ্ততাপের দুটি সাধারণ প্রকারভেদ হলো গলনের সুপ্ততাপ ও বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ। এদের নাম থেকেই বোঝা যায় দশা পরিবর্তনের সময় শক্তিপ্রবাহ কোন দিকে হবে। গলনের সুপ্ততাপ কঠিন থেকে তরল এবং বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ তরল থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরের সুপ্ততাপকে নির্দেশ করে।

সুপ্ততাপ ও অনুভূত তাপ উভয়ই এন্ডোথার্মিক পরিবর্তন, অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই সিস্টেম শক্তি শোষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন পানি বাষ্পীভূত হয় তখন পানির অণুগুলোর মধ্যকার আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল ভাঙতে বাইরে থেকে শক্তির প্রয়োজন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে পানি থেকে জলীয় বাষ্পে রূপান্তরের জন্য শক্তি ইনপুট দেওয়া প্রয়োজন।

পক্ষান্তরে, বাষ্প যখন কোনো পৃষ্ঠে তরলে ঘনীভূত হয় তখন বাষ্পীভবনের সময় গৃহীত সুপ্ততাপ ঐ পৃষ্ঠ থেকে পরিবেশে অনুভূত তাপ হিসেবে নির্গত হয়।

জলীয় বাষ্পের ঘনীভবনের উচ্চ এনথালপির কারণেই ফুটন্ত পানির চেয়ে জলীয় বাষ্প অধিক কার্যকরী তাপ প্রদান মাধ্যম এবং একইসাথে বিপজ্জনক।

আবহাওয়া বিজ্ঞান সম্পাদনা

আবহাওয়া বিজ্ঞানে সুপ্ততাপীয় ফ্লাক্স হলো পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলে নির্গত শক্তির ফ্লাক্স যা বাষ্পায়ন বা পানি নির্গমনের সাথে সম্পর্কিত এবং ট্রপোমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন সংক্রান্ত একটি রাশি। আগে বোয়েন অনুপাতের মাধ্যমে এটি মাপা হতো, তবে ১৯৫০ এর পর থেকে এডি সমবায় (কভারিয়েন্স) পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয়।

ইতিহাস সম্পাদনা

সুপ্ততাপের ইংরেজি প্রতিশব্দ "ল্যাটেন্ট" এসেছে ল্যাটিন শব্দ ল্যাটেন্স (অর্থ: অন্তর্নিহিত থাকা) থেকে। ১৭৫০ এর দিকে সুপ্ততাপ কথাটি ক্যালোরিমিতিতে প্রথম প্রচলন করেন রসায়নবিদ জোসেফ ব্ল্যাক।[৩] ১৮৪৭ সালে বিজ্ঞানী জেমস প্রেসকট জুল বলেন, সুপ্ততাপ বিভব শক্তির সাথে সম্পর্কিত রাশি এবং অনুভূত তাপ থার্মাল শক্তির সাথে সম্পর্কিত রাশি যা থার্মোমিটার দ্বারা নির্দেশ করা যায়।[৪]

আপেক্ষিক সুপ্ততাপ সম্পাদনা

একক ভরের কোনো পদার্থকে (সাধারণত ১ কেজি) সম্পূর্ণরূপে এক দশা থেকে অন্য দশায় রূপান্তরিত করতে প্রয়োজনীয় তাপশক্তিই হলো ঐ পদার্থের উপাদানের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ ( )। এর সমীকরণ:

 

উক্ত সংজ্ঞানুসারে, কোনো প্রদত্ত ভরের বস্তুর সুপ্ততাপের পরিমাণ:

 

এখানে,

  হলো দশা পরিবর্তনের সময় গৃহীত বা বর্জিত তাপশক্তি (কিলোজুল বা বিটিইউ এককে)।
  হলো বস্তুর ভর (কিলোগ্রাম বা পাউন্ড এককে)।
  হলো ঐ বস্তুর উপাদানের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ (কিলোজুল/কেজি বা বিটিইউ/পাউন্ড এককে)। এক্ষেত্রে গলনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ হিসেবে  f এবং বাষ্পীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ হিসেবে  v ব্যবহার করা হয়। বরফ গলনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ   f ৩৩৪০০০ জুল/কেজি

বিভিন্ন পদার্থের আপেক্ষিক সুপ্ততাপের ছক সম্পাদনা

পদার্থ গলনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ (কিলোজুল/কেজি) গলনাঙ্ক (°সে.) বাষ্পীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ (কিলোজুল/কেজি) স্ফুটনাঙ্ক (°সে.)
ইথাইল অ্যালকোহল ১০৮ −১১৪ ৮৫৫ ৭৮.৩
অ্যামোনিয়া ৩৩২.১৭ −৭৭.৭৪ ১৩৬৯ −৩৩.৩৪
কার্বন ডাইঅক্সাইড ১৮৪ −৭৭ ৫৭৪ −৫৭
হিলিয়াম     ২১ −২৬৮.৯৩
হাইড্রোজেন(২) ৫৮ −২৫৯ ৪৫৫ −২৫৩
সীসা[৫] ২৩.০ ৩২৭.৫ ৮৭১ ১৭৫০
নাইট্রোজেন ২৫.৭ −২১০ ২০০ −১৯৬
অক্সিজেন ১৩.৯ −২১৯ ২১৩ −১৮৩
শীতায়ক আর১৩৪এ   −১০১ ২১৫.৯ −২৬.৬
শীতায়ক আর১৫২এ   −১১৬ ৩২৬.৫ -২৫
সিলিকন[৬] ১৭৯০ ১৪১৪ ১২৮০০ ৩২৬৫
টলুইন ৭২.১ −৯৩ ৩৫১ ১১০.৬
টার্পেন্টাইন     ২৯৩  
পানি ৩৩৪ ২২৬৪.৭০৫ ১০০

মেঘে পানির ঘনীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ সম্পাদনা

-২৫° সেলসিয়াস থেকে ৪০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানির ঘনীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ নির্ণয়ে নিম্নোক্ত ত্রিঘাত সমীকরণটি ব্যবহৃত হয়:

 [৭]

এখানে, তাপমাত্রা ( ) °সেলসিয়াস এককে নিতে হবে।

আবার, বরফ থেকে ঊর্ধ্বপাতন ও অবক্ষেপণের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ -৪০° সেলসিয়াস থেকে ০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ধ্রুব থাকে এবং তা নিম্নোক্ত চতুর্ঘাত সমীকরণ দ্বারা নির্ণয় করা যায়:

 [৭]

তাপমাত্রা ও চাপের প্রভাব সম্পাদনা

 
তাপমাত্রার উপর পানি, মিথানল, বেনজিন ও অ্যাসিটোনের বাষ্পীভবনের তাপের নির্ভরশীলতা

তাপমাত্রা বা চাপ যখন সংকট বিন্দুতে পৌঁছায় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ শূন্যে নেমে আসে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Perrot, Pierre (১৯৯৮)। A to Z of Thermodynamics। Oxford University Press। আইএসবিএন 0-19-856552-6 
  2. Clark, John O.E. (২০০৪)। The Essential Dictionary of Science। Barnes & Noble Books। আইএসবিএন 0-7607-4616-8 
  3. James Burke (১৯৭৯)। "Credit Where It's Due"। The Day the Universe Changed। পর্ব 6। event occurs at 50 (34 minutes)। BBC। 
  4. J. P. Joule (১৮৮৪), The Scientific Paper of James Prescott Joule, The Physical Society of London, পৃষ্ঠা 274, I am inclined to believe that both of these hypotheses will be found to hold good,—that in some instances, particularly in the case of sensible heat, or such as is indicated by the thermometer, heat will be found to consist in the living force of the particles of the bodies in which it is induced; whilst in others, particularly in the case of latent heat, the phenomena are produced by the separation of particle from particle, so as to cause them to attract one another through a greater space. , Lecture on Matter, Living Force, and Heat. May 5 and 12, 1847
  5. Yaws, Carl L. (২০১১)। Yaws' Handbook of Properties of the Chemical Elements। Knovel। 
  6. Elert, Glenn। "Latent Heat"The Physics Hypertextbook 
  7. Polynomial curve fits to Table 2.1. R. R. Rogers; M. K. Yau (১৯৮৯)। A Short Course in Cloud Physics (3rd সংস্করণ)। Pergamon Press। পৃষ্ঠা 16। আইএসবিএন 0-7506-3215-1 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা