সুখাইড় জমিদার বাড়ি
সুখাইড় জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্গত ধর্মপাশা উপজেলার হাওর রাজ্যের সুখাইড়ের জমিদারদের দ্বারা(প্রায়) ৪০০ বছর আগের দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলী ও ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্থাপনা । এই জমিদার বাড়ি "রাজমহল" ও "সুখাইড় রাজবাড়ি" নামেও পরিচিত, এই রাজকীয় বাড়ির উত্তর পূর্বে মেঘালয় রাজ্য,উত্তরে আসাম রাজ্য এবং পূর্ব দক্ষিণে ত্রিপুরা রাজ্য।
সুখাইড় জমিদার বাড়ি | |
---|---|
![]() | |
সাধারণ তথ্যাবলী | |
ঠিকানা | সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন ধর্মপাশা উপজেলা |
শহর | সুনামগঞ্জ জেলা সিলেট বিভাগ |
দেশ | বাংলাদেশ |
উন্মুক্ত হয়েছে | ১৬ শতকের শেষ ভাগ |
অবস্থান
সম্পাদনাসুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নে অবস্থিত হাওর রাজ্যে প্রায় ৪০০ বছর আগের মোগল আমলের সুখাইড় জমিদার বাড়িটি ভাটি বাংলার পদ্মফুল, হাওর রাজ্যের ইন্দ্রপুরি ও রাজমহল হিসেবে বহুল পরিচিত । সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৫ কি.মি. দূরে ঘাগলাজুর নদীর উত্তরপারে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ এ বাড়িটির অবস্থান । দক্ষিণে ঘাগলাজুর নদী, উত্তরে বংশীকুন্ডা, পশ্চিমে ধর্মপাশা উপজেলা এবং পূর্বে জামালগঞ্জ উপজেলা[১] উত্তরে তাহিরপুর উপজেলা।
সুখাইড় রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ির ইতিহাস
সম্পাদনাআনুমানিক ১৬৯১ সালে মোঘল শাসনামলে মহারাজা মহামানিক্য দত্ত হুগলী থেকে আসাম যাওয়ার পথে কালিদহ সাগরের স্থলভূমি ভাটির প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে সুখাইড়ে জায়গির কেনেন।[২] ঐ সময় থেকেই সুখাইড়ে বাড়ি নির্মাণ পরিকল্পনা শুরু করেন মহারাজা মহামাণিক্য দত্ত। পাশে পাহাড়ী নদী বৌলাই, হাওরের থৈ থৈ ঢেউ, বন ঝোপ আর সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশে সমৃদ্ধ থাকায় ১৬৯৫ সালে সুখাইড়ে ২৫ একর জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন জমিদার মোহনলাল রায় চৌধুরী, জমিদার রাজীব রায় চৌধুরী এবং কেশব রায় চৌধুরী । কয়েক পুরুষের চেষ্টায় শেষ হয়েছিল বাড়ির নির্মাণকাজ।জমিদারি যুগে সুনামগঞ্জ ছিল ৩২ টি পরগনায় বিভক্ত। দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীর কারণে সুখাইড় জমিদার বাড়ি হাওর রাজ্যের রাজমহল হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এ জমিদারির বিস্তৃতি ছিল দক্ষিণে ঘাগলাজুর নদীর উত্তরপাড়, উত্তরে বংশীকুন্ডা, পশ্চিমে ধর্মপাশা এবং পূর্বে জামালগঞ্জ। এক সময় এ বাড়ির মালিকানায় ছিল কালা পানির বিল, ফিরা গাঙ্গের বিল, ধানকুনিয়া বিল, চারদা বিল, কাইমের দাইড়, সোনামোড়ল, পাশোয়া, ছাতিধরা, রাকলা, বৌলাই, নোয়ানদী, চেপ্টা এক্স হেলইন্নাসহ ২০ টিরও বেশি জলমহল।
গজারিয়া নদীর উত্তরপাড় থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজবাড়ির সীমানা। জমিদারি প্রথা অনেক আগে বিলুপ্ত হলেও রাজবাড়ি বাংলোঘর, কাচারি ঘর, জলসাঘর, গুদামঘর ও সদরমহল,অন্দরমহল,হাতিশাল,ঘোড়াশাল,খাসকামরাসহ আঙিনার পুকুরসহ বিস্তৃত সীমানা এখনো বাড়িটিকে বেশ আকর্ষণীয় করে রেখেছে।
কতিথ আছে এই প্রতাবশালী সুখাইড় রাজবাড়ি দেখতে আসেছিলেন ইংরেজ প্রশাসক বেলেন্টিয়ার। বাঘ শিকারের জন্য তিনি গিয়েছিলেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। খবর এসেছে তিনটি বাঘ জিম্মি করে রেখেছে বেলেন্টিয়ারকে। পরে ঐ সময়ের জমিদার চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরী আইন লঙ্ঘন করে বাঘ তিনটিকে গুলি করে মেরে বেলেন্টিয়ারকে উদ্ধার করেন। এ জন্য চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরীকে একটি বন্দুক উপহার দেন ইংরেজ সাহেব।
মহারাজা মহামানিক্য দত্তের উত্তরাধিকারীরা “রায় চৌধুরী” উপাধিতে ভূষিত হওয়ার ইতিহাস জানাতে গিয়ে সুখাইড়ের জমিদারদের উত্তরাধিকারী মলয় রায় চৌধুরী জানান, তাদের পূর্বপুরুষের একজন সুখাইড়ে এসে সুন্দরী ও ধনাঢ্য এক মেয়েকে বিয়ে করে নিজের উপাধী পরিবর্তন করেন। রাজা মহামাণিক্যের চতুর্থ পুরুষ প্রতাপ রায় চৌধুরী সুখাইড় পার্শ্ববর্তী রাজাপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়ে রাজাপুরে চলে যান। তিনি ধর্মান্তরিত হলেও জমিদারির অর্ধেক নিয়ে যান তিনি। পরে রাজাপুরের জমিদার হন তিনি।
জমিদারি প্রথা বিলোপের পর জমিদারের উত্তরাধিকাররা অর্থ সংকটে পড়ে যান এবং অন্য পেশায় কোন রকমে চলছে তাদের জীবন। জমিদারি প্রথা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে সামান্য কিছু ধানের জমি এবং বাড়ির ২৫ একর জায়গা ব্যাতীত বাকী জায়গা-জমি চলে যায় সরকারের হাতে।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সিলেট জেলা(বর্তমান সিলেট বিভাগ) বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার এই সুখাইড় রাজবাড়িতে যখন বিভিন্ন ধরনের রঙের আলোর বাতি ব্যবহার করা হতো তখন সুনামগঞ্জ মহুকুমার SDO বর্তমান (DC) অফিসে হারিকেন এর বাতি ঝোলানো থাকতো ভাবা যায় এই কথা, আজ সব অতীত। সুখাইড় রাজবাড়ির বিশাল হাওর জুড়েই এই রাজ্যের শাসন বিস্তৃত ছিলো।
পাকিস্তানী শাসন আমলে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্সাল আইয়ুব খানের প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ সালে পাস করার পর জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটে,সুখাইড় জমিদার বাড়ি এস্টেটে কার্যকর হয় ১৯৫২ সালে।
রাজবংশ বা জমিদার বংশ
সম্পাদনাসুখাইড় রাজবাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা থানা থেকে ১৮.২ কিলোমিটার দূরে, বৌলাই নদীর তীরে অবস্তিত। সুখাইড় রাজবাড়িকে ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। ১৬০০ শতকের শেষ দিকে, এই দৃষ্টিনন্দন সুখাইড় রাজবাড়ি নির্মাণ করা হয়, এই জমিদার বংশ মূলত দত্তরাজবংশ।[২] জানা যায় মোঘল শাসন আমলে এই জমিদার বাড়ির স্থাপিত হয়। (প্রায়) ৪০০ শত বছরের পুরনো এই রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ির ৩টি অংশ এখনও টিকে আছে। তথ্যসূত্রে জানাযায় বংশধরদের নাম- মোহন চৌধুরী, বিমান চন্দ্র রায় চৌধুরী, বিধান চন্দ্র রায় চৌধুরী ও বিপ্রেশ চৌধুরী। রাজা বিশ্বনাথ রায় চৌধুরীর থেকে বংশ বিস্তৃত হয়েছে।
সুখাইড় রাজপরিবারের সর্বশেষ মহাসামন্ত-শাসক জমিদার শ্রীযুক্ত রাজা বিমল চন্দ্র রায় চৌধুরী (ছানাবাবু)। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ার পর, যুদ্ধ-বিদ্ধস্থ স্বাধীন বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলা ধর্মপাশা উপজেলার,সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন এর সাবেক রিলিফ চেয়ারম্যান।
আনুমানিক ১৯১৮ সালে জন্ম এবং মৃত্যু ২০০৪ সালে।
শাসন আমল
সম্পাদনাবিখ্যাত ব্যক্তি
সম্পাদনাজন্মসূত্রে সুখাইড় রাজবাড়ির বিখ্যাত ব্যাক্তিদের তালিকা।
১- শ্রীযুক্ত রায়বাহাদূর মথুর চন্দ্র রায় চৌধুরী - জমিদার ও সঙ্গীতশিল্পী।
২- শ্রীযুক্ত মোহিনী মোহন রায় চৌধুরী (রায়সাহেব)- জমিদার ও সম্মানি মাজিস্ট্রেট (সুনামগঞ্জ মহুকুমা)
৩- শ্রীযুক্ত য্যোতিন্দ্রমহোন রায় চৌধুরী - জমিদার ও রাগসঙ্গীত শিল্পী।
৩- শ্রীযুক্ত মনমোহন রায় চৌধুরী- জমিদার ও স্পিকার।
৪- শ্রীযুক্ত মনরঞ্জন রায় চৌধুরী - জমিদার ও প্রথম সারকেল অফিসার (CO) থানা নির্বাহী পরিচালক।
৫- শ্রীযুক্ত দ্বীজরাজ রায় চৌধুরী - জমিদার ও তবলাবাদক।
৬- শ্রীযুক্ত বিমল চন্দ্র রায় চৌধুরী (ছানা)- জমিদার, তবলাবাদক ও রিলিফ চেয়ারম্যান।
৭- শ্রীযুক্ত নির্মলেন্দু চৌধুরী- জমিদার, কমিউনিস্ট নেতা ও সঙ্গীতশিল্পী।
৯- ঝর্নাদাশ পুরকায়স্থ (ঝর্ণা চৌধুরী) জমিদার কন্যা, কবি ও শিশুসাহিত্যক।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ dharmapasha.sunamganj.gov.bd[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ Das, Pyarimohan (১৯১৫)। Itibritta-tattwa। পৃষ্ঠা ৪০।