শিয়া রাজবংশ (চীন)

(সিয়া রাজবংশ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

শিয়া রাজবংশ (চীনা: ; ফিনিন: Xià Cháo; ওয়েড-জাইলস: Hsia-Ch'ao; আনু. খ্রিস্টপূর্ব ২০৭০ অব্দ – আনু. খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ) চীনের ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের প্রথম রাজবংশ। খ্রিস্টপূর্ব একবিংশ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতক পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর ১৪টি প্রজন্মের ১৭ জন সম্রাট রাজত্ব করেছিল। বর্তমান চীনের সানসি প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও হোনান প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল ছিল এই সাম্রাজ্যের ব্যপ্তি।[] ব্যাম্বু অ্যানালস, ক্ল্যাসিকস অব হিস্ট্রি, ইতিহাসের আলেখ্য গ্রন্থে চীনের এই সাম্রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে মহান ইয়ু শিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।[] তিনি সম্রাট সুনের পর সিংহাসনে আরোহণ করেন।[]

শিয়া

夏朝
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০৭০ অব্দ–আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ
শিয়া সাম্রাজ্য
শিয়া সাম্রাজ্য
রাজধানীডেনফেন
প্রচলিত ভাষাপ্রাচীন চীনা ভাষা
সরকাররাজতন্ত্র
রাজা 
ইতিহাস 
• মহান ইয়ু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০৭০ অব্দ
• শিয়াকি সিংহাসনে আরোহণ করেন
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০২৫ অব্দে
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ
উত্তরসূরী
[[শাং সাম্রাজ্য]]
শিয়া রাজবংশ
চীনা 夏朝

লিউ সিন অনুমান করেন, শিয়া সাম্রাজ্য খ্রিষ্টপূর্ব ২২০৫ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৬৬ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। অন্যদিকে, ব্যাম্বু অ্যানালস গ্রন্থ অনুসারে, এই সাম্রাজ্যের শাসনকাল খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৮৯ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৫৮ অব্দ পর্যন্ত। অবশেষে শিয়া-শাং-ঝুউ প্রজেক্ট থেকে এই সিদ্বান্তে আসে যে, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০৭০ অব্দ থেকে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ শিয়া সাম্রাজ্য স্থায়ী ছিল। এই ধারণার সূত্রপাত হয় ওরাকল হাড় আবিস্কারের পর থেকে। ওরাকল হাড় শাং সাম্রাজ্যের সময়কালের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা খ্রিষ্টপূর্ব ১৩শ শতাব্দীর বলে ধারণা করা হয়।[] শিয়া সাম্রাজ্য সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। চীনা প্রত্নতত্ত্ববিদেরা শিয়া সাম্রাজ্যের প্রাপ্ত নিদর্শনকে ব্রোঞ্জ যুগের নিদর্শন এর লি থৌ-এর সাথে তুলনা করেছেন।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা

ব্যাম্বু অ্যানালস, ক্ল্যাসিকস অব হিস্ট্রি (শুজিং), সিমা ছিয়েন রচিত ইতিহাসের আলেখ্য (শিজি) গ্রন্থে শিয়া সাম্রাজ্য সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে বর্ণিত আছে, হুয়াংহো নদীর উত্তরে প্রায় ৫০০ বছর শিয়া সম্রাটেরা রাজত্ব করেছিল।[]

উৎপত্তি

সম্পাদনা

শিয়া সাম্রাজ্যের উৎপত্তি কিংবদন্তি ত্রিলোক ও পাঁচ সম্রাট-এর সময় থেকে। প্রাচীন চীনা গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে শিয়া সম্প্রদায়ের সাথে চি ইউ সম্প্রদায়ের বেশ কিছু ছোট ছোট যুদ্ধ হয়। শিয়া সম্প্রদায় পাঁচ সম্রাটের একজন ঝুয়াংক্সুর সময়ে বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। ইতিহাসের আলেখ্যক্ল্যাসিক অব রায়টস গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, ইয়ু দ্য গ্রেট ছিলেন ঝুয়াংক্সুর নাতী। অপরদিকে, বান গু অনুমান করেন ইয়ু দ্য গ্রেট ছিলেন ঝুয়াংক্সুর পঞ্চম বংশধর। এ থেকে বলা হয়ে থাকে, শিয়া সাম্রাজ্যের উৎপত্তি ঝুয়াংক্সু থেকে।

গুন ও মহাপ্লাবন

সম্পাদনা
 
ইয়ু দ্য গ্রেট

শিয়া সাম্রাজ্যের প্রথম পুরুষ হিসেবে গুনের কথা বর্ণিত আছে। তিনি ছিলেন ইয়ু দ্য গ্রেটের বাবা। হুয়াংহো নদীতে মহাপ্লাবন দেখা দিলে বেশ কিছু ছোট জনগোষ্ঠী বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ নেয়। গুন তাদের একজন ছিলেন। তাকে সম্রাট ইয়াও এই দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি নদীর পথ আটকাতে বাঁধ নির্মাণ করেন। কিন্তু প্লাবন আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করলে তার এই চেষ্টা বৃথা যায়। নয় বছরেও তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন নি। ততদিনে সম্রাট সুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট সুন গুনকে তার কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় বর্তমান শিয়াসু রাজ্য ও শানডং রাজ্যের মধ্যবর্তী ইউসান পর্বতে (Chinese: 羽山) নির্বাসন দেন।[][]

মহান ইউ ও মহাপ্লাবন

সম্পাদনা

মহান ইউ ছিলেন সম্রাট সুনের প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন। সুন তাকে তার বাবার স্থানে নিযুক্ত করেন তার বাবার মহাপ্লাবন নিয়ন্ত্রণের কাজ শেষ করার জন্য। ইয়ু তার বাবার থেকে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। তিনি আশেপাশের অধিবাসীদের খাল খনন করার আদেশ দেন, যাতে পানি সমুদ্রে প্রবাহিত হয়। জনগণ তার অধ্যবসায়কে প্রশংসা করল এবং আশেপাশের আধিবাসীরাও তার আদেশ অনুযায়ী খনন কাজে যোগ দিল। কথিত আছে, মহাপ্লাবন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হতে ১৩ বছর লেগেছিল এবং এই সময়ের মধ্যে ইয়ু তিনবার তার বাড়ির পাশ দিয়ে গেলেও একবারের জন্যও তার বাড়ি যান নি।[][]

প্রতিষ্ঠা

সম্পাদনা

ইয়ুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার ফলে কৃষিকাজের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং শিয়া সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। ইয়ু শিয়া এবং আরও কিছু সম্প্রদায়ের নেতা হয়ে ওঠেন। কিছুকাল পরে সম্রাট সুন সীমান্তবর্তী সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনকারী সানমিয়াও সম্প্রদায়কে দমন করার জন্য তার কাছে সেনাবাহিনী পাঠান। তিনি সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে তাদের দমন করে দক্ষিণে হান নদীর তীরে নির্বাসিত করেন। এই বিজয়ের ফলে শিয়া সম্পদায়ের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। সম্রাট সুনও বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি ইয়ুকে যোগ্য হিসেবে সিংহাসনের দায়িত্ব প্রদান করেন। ইয়ুর সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কথিত আছে, তার পরে অন্য কোন যোগ্য ব্যক্তিকে সিংহাসনের দায়িত্ব না দেওয়া ও তার পুত্র শিয়াকির সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে বংশানুক্রমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। ধারণা করা হয়, ডেনফেন (বর্তমান গঙই) ছিল শিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী।[]

শিয়াজিয়ে ছিলেন বিলাসী, অহংকারী ও নিষ্ঠুর। তিনি রাজকার্য পালনের চেয়ে বেশি তার রক্ষিতাদের সাথে সময় পার করতেন। কোনো মন্ত্রী এই নিয়ে কথা বললে তিনি তাদের হত্যার নির্দেশ দিতেন। এ কারণে ছোট ছোট উপরাজ্যগুলো তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং শাং উপরাজ্যের দলপতি তাং সামরিক অভিযান চালিয়ে তাকে পরাজিত করে।[] তাং শিয়া বংশধরদের জায়গীর হিসেবে হোনান রাজ্য দান করেন। এই ধরনের রীতিকে বলা হয় দু'ই ওয়াং সানকে (二王三恪)।[]

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

সম্পাদনা
 
শিয়া সাম্রাজ্যের পাত্র

চীনের প্রত্নতত্ত্ববিদদেরা খননের ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, ব্রোঞ্জের তৈরি হাতিয়ার ও কবর আবিষ্কার করে যা প্রাচীন বইতে বর্ণিত শিয়া সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব নির্দেশ করে। এর লি থৌ শিয়া সাম্রাজ্যের সময়কালে ছিল কিনা এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। রেডিওকার্বন সময় থেকে জানা যায় যে, এর লি থৌ সময়কাল ছিল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ পর্যন্ত, যা প্রাচীন বইতে উল্লেখিত শিয়া সাম্রাজ্যের সমসাময়িক।[১০] এর লি থৌ ধ্বংসাবশেষ থেকে পাথর দিয়ে তৈরি হাতিয়ার পাওয়া গেছে। হাড় ও ঝিনুকের খোল দিয়ে তৈরি হাতিয়ারও পাওয়া গেছে। এর লি থৌ ধ্বংসাবশেষ থেকে ব্রোঞ্জের তৈরি চাকু, কুড়াল, বাটালি, তীর, অস্ত্র ও পেয়ালা পাওয়া গেছে। এছাড়া মৃৎপাত্র, তামার গুঁড়ো, উন্নতমানের জেডপাথরের পাত্র, সবুজ বল খোদিত অলংকার এবং পাথরের বাদ্যযন্ত্রও পাওয়া গেছে।[]

শিয়া সম্রাটদের তালিকা

সম্পাদনা

সিমা কিয়ান রচিত শিজি গ্রন্থে শিয়া সম্রাটদের তালিকা দেওয়া আছে। ওরাকল হাড়ে খোদাই করা শাং সাম্রাজ্যের সম্রাটদের তালিকার মত শিয়া সম্রাটদের তালিকা কোন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে খননের ফলে বা পরবর্তী শাং সাম্রাজ্যের সময়কালের ওরাকল হাড়েও পাওয়া যান নি।

ক্রমিক নং সম্রাট রাজত্বকাল চীনা ভাষা ফিনিন টীকা
০১ মহান ইউ ৪৫ তা ইউ (大禹; Dà Yǔ) নামেও পরিচিত
০২ ছি ১০ মহান ইউয়ের ছেলে
০৩ থাই খাং ২৯ 太康 Tai Kang
০৪ চুং খাং ১৩ 仲康 Zhòng Kāng
০৫ শিয়াং 28 Xiāng
০৬ শাও খাং 21 少康 Shào Kāng
০৭ চু ১৭ Zhù
০৮ হুয়াই ২৬ Huái
০৯ মাং ১৮ Máng
১০ শিয়ে ১৬ Xiè মাংয়ের ছেলে
১১ পু চিয়াং ৫৯ 不降 Bù Jiàng
১২ চিউং ২১ Jiōng
১৩ চিন ২১ Jǐn
১৪ খুং চিয়া ৩১ 孔甲 Kǒng Jiǎ
১৫ কাও ১১ Gāo
১৬ ফা ১১
১৭ চিয়ে ৫২ Jié ল্যু কুয়েই (履癸, Lǚ Guǐ) নামেও পরিচিত
আনুমানিক সময়কাল

জেনজি ছিলেন শিয়া সম্রাট শাও কাং-এর বংশধর। ইউয়ে রাজ্যের রাজারাও শাও খাংয়ের বংশধর ছিলেন। শাং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর শিয়া বংশধরদের শাং সম্রাট হেনান ও জেং রাজ্যের জায়গীর দান করেন।[১১]

শিয়া পরিবার

সম্পাদনা
শিয়া সাম্রাজ্য
(1) মহান ইউ 大禹
(2) ছি[১২]
(3) থাই খাং
太康
(4) চুং খাং
仲康
(5) শিয়াং
(6) শাও খাং
少康
(7) চু
(8) হুয়াই
(9) মাং
(10) শিয়ে
(11) পু চিয়াং
不降
(12) চিউং
(14) খুং চিয়া
孔甲
(13) চিন 廑
(15) কাও
(16) ফা
(17) চিয়ে

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "শিয়া রাজবংশ-- ইতিহাসে চীনের প্রথম রাজবংশ"ক্রি অনলাইন। ২৯ মে ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৬ 
  2. মুনগেলো, ডেভিড ই. (২৮ মার্চ, ২০০৯)। The Great Encounter of China and the West, 1500–1800। রোম্যান অ্যান্ড লিটলফিল্ড। পৃষ্ঠা ৯৭। আইএসবিএন 978-0-7425-5798-7  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  3. Bagley, Robert. "Shang Archaeology." in The Cambridge History of Ancient China. Michael Loewe and Edward Shaughnessy, ed. Cambridge: Cambridge University Press, 1999.
  4. Liu, L. & Xiu, H., "Rethinking Erlitou: legend, history and Chinese archaeology", Antiquity, 81:314 (2007) pp. 886–901.
  5. "The Xia Dynasty: Legend or History?"চায়নাহাইলাইটস। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৬ 
  6. লুইস, মার্ক এডওয়ার্ড (২০১২), The Flood Myths of Early China, স্টেট ইউনিভারসিটি অব নিউইয়র্ক প্রেস, আইএসবিএন 978-0-7914-8222-3. 
  7. "Gun-Yu and the Chinese Flood Myth"এনশিয়েন্ট অরিজিনস। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৬ 
  8. "Legendary Foundations of Chinese Civilization: The Rise of Yu the Great"দ্য এপোচ টাইমস। জুলাই ২৫, ২০১৬। ৩ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৬ 
  9. 《宗聖志》,(清)曾國荃續修,宗聖奉祀官府,১৯৭৪年
  10. ফেয়ারব্যাংক, জন কে. (১৯৯২)। China: A New History। কেমব্রিজ: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ৩৫। 
  11. 《武城曾氏重修族譜》,(清)曾繁墫纂,1807年
  12. Wang Quangen 王泉根, (1993). Huaxia Quming Yishu 華夏取名藝術. (Taipei: Zhishu-fang Chuban Jituan 知書房出版集團), 42.

গ্রন্থসূত্র

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা
পূর্বসূরী
ত্রিলোক ও পাঁচ সম্রাট
চীনের প্রাচীন সাম্রাজ্য
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০৭০ অব্দ–খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ
উত্তরসূরী
শাং সাম্রাজ্য