সাইয়েদুল মুরসালীন
সাইয়েদুল মুরসালীন গ্রন্থটি অধ্যাপক আবদুল খালেক কর্তৃক রচিত বাংলা ভাষার একটি সীরাতগ্রন্থ। বইটির প্রথম ২ খণ্ড প্রকাশ পায় ১৯৫১ সালে প্রকাশ পায় এবং ২০০৭ সালে ৩য় খন্ডটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।[১] বইটি ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১০ বার পুনঃমুদ্রন হয়েছে, এরমধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ৪ বার মুদ্রিত ও সম্পাদিত হয়েছে। বইটি বাংলাদেশের মাদ্রাসার উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি বাংলা সাহিত্যে কোন আলেম কর্তৃক বৃহৎ ও তথ্যবহুল প্রথম নবী-জীবনচরিত রচনা।[২] বইটির তিনখন্ড মিলিয়ে মোট পৃষ্টা সংখ্যা ১১৭০।
লেখক | অধ্যাপক আবদুল খালেক |
---|---|
দেশ | ব্রিটিশ ভারত, বাংলাদেশ |
ভাষা | বাংলা |
মুক্তির সংখ্যা | ৩ খণ্ড |
বিষয় | মুহাম্মাদের জীবনচরিত |
ধরন | সীরাতগ্রন্থ |
প্রকাশিত |
|
প্রকাশক | ছতুরা দরবার শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | ১১৭০ |
লেখক পরিচিতি
সম্পাদনাঅধ্যাপক আবদুল খালেক আরবী ও ফার্সী ভাষায় উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন, তিনি ফেনী সরকারী কলেজ, সরকারি ইডেন কলেজ ও প্রেসিডেন্সী কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছতুরা দরবার শরীফের একজন খলিফা ছিলেন। তার লেখনী ও চিন্তাতে মজাদ্দিদ আলফে সানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেলহভী (রহ) ও আহমদ শহীদ বেরলভীর প্রভার প্রবলভাবে লক্ষ্যনীয়। লেখক এই বইয়ের শুরুতেই বই লেখার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে লিখেছেন,
“ | এই জন্য এই কিতাবে তাহাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করা হয়েছে, যারা আল্লাহ পাকের দরবারে কবুলিয়ত ও রহমত লাভ করেছেন। এছাড়াও অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞতা ও জড়বাদের ভাবধারার প্রচারণার ফলে তাওহিদ, ইসলাম, কুরআন, হাদিস ও রাসুল (সাঃ) সম্পর্কে সমাজে যে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে, এই কিতাবে তাহা অপনোদন করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। | ” |
— অধ্যাপক আব্দুল খালেক, সাইয়েদুল মুরসালীন গ্রন্থ (ভূমিকা অংশ) |
বিষয়বস্তু
সম্পাদনালেখক তৎকালীন শোচনীয় সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে সেই সময়ের আরব জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে মহানবী মুহাম্মাদ আগমনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এছাড়াও নবী আবির্ভাবের পূর্বে নিজ নিজ ধর্মের বিকৃতি সাধন, তৎকালীন হিন্দুস্তান, চীন ও আরবের ভৌগোলিক অবস্থা ও তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার কথা আলোকপাত করেছেন। লেখক বইটিতে মুহাম্মাদের মাক্কী জীবন, নবুওয়াতের প্রকাশ, শবে মিরাজ, মদিনায় হিজরত, মদীনার জীবন, ইসলামের বিজয়সহ পর্যায়ক্রমে সকল ঘটনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন।
গ্রন্থটির প্রুফ রিডার লেখকের মুরিদ কবি ফররুখ আহমদ যত্নসহকারে একাধিকবার এটা পরীক্ষণ করেছেন।[৩] বইটি লেখার প্রধান অবলম্বন ও সহায়ক বই ছিলো ইমাম আলী বিন বুরহানুদ্দিন হালাবী’র সীরাত-ই-হালাবী নামক গ্রন্থ। এছাড়াও সীরাতে ইবনে হিশাম, মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া, যাদুল-মা’আদ সহ অনেক বইয়ের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।[ক]
বইটিতে মুহাম্মাদুর রাসুলকে একজন সংস্কারক, ভাববাদী অতিমানবের পরিবর্তে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল হিসাবে দেখানো হয়েছে। এবং রাসুলের জীবন থেকে নানা মুজিজার উল্লেখ করে তাকে প্রেরিত রাসুল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল্যায়ন
সম্পাদনাএই বইটি সম্পর্কে অনেক গুণী ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ ভালো ভালো মন্তব্য করেছে, সেসব মন্তব্যের কিছু:
- কবি সৈয়দ আলী আহসান ও মোহাম্মাদ আব্দুল হাই বইটিকে আধুনিক সময়ে রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বলে মন্তব্য করেন এবং বলেন, বইটিতে লেখকের অনেক শ্রম ও নবীর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পাওয়া গিয়েছে।[৪] এছাড়াও সৈয়দ আলী আহসান "মহানবী" নামের গ্রন্থের ভূমিকায় এই বইটি সম্পর্কে বলেন,
“ | বাংলাভাষায় এটিই রাসুলের সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা তথ্যবহুল জীবনীগ্রন্থ। যতটা সম্ভব তিনি রাসুলের জীবনের প্রধান প্রধান সবকটি ঘটনাকেই উল্লেখ করবার চেষ্টা করেছেন। মুদ্রণ বিভ্রাটের জন্য এবং ভাষার জটিলতার জন্য গ্রন্থটি পাঠে কিছুটা অসুবিধা হলেও তথ্যাদির দিক থেকে এই গ্রন্থটি সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। | ” |
— সৈয়দ আলী আহসান, "মহানবী" বইয়ের ভূমিকা অংশ |
- সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন, এটি বাংলা ভাষায় রচিত একটি শ্রেষ্ঠ রসুল-চরিত।[৫]
- লেখক মাহদী হাসান বলেন, সাইয়েদুল মুরসালীন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সংযোজন। এটি মোহাম্মদ আকরম খাঁ মোস্তফা চরিত, গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী পর্যায়ের গ্রন্থ এটি না হলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে অনেকটা কাছাকাছি। দু’খন্ডে প্রায় হাজার পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি লেখকের কঠোর পরিশ্রমের ফসল। কাজী নজরুল ইসলাম এবং সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখের সিরাত রচনার অন্যতম উৎস ছিল এই গ্রন্থটি। এবং এটিই ছিল প্রথম কোন আলেম রচিত বাংলায় প্রথম সিরাতগ্রন্থ।[৬]
- মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলেন- “আমার জানামতে এটি বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় মৌলিক রচনার মধ্যে লেখকের "সাইয়েদুল মুরসালীন", অধ্যাপক শিশির দাসের "প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম" ‘ ও গোলাম মোস্তফার "বিশ্বনবী" সর্বোৎকৃষ্ট বলে আমার ধারণা।[৭]
টীকা
সম্পাদনা- ↑ বইটি লিখতে যেসকল বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, সেটার তালিকা: ১। সীরাত-ই-হালাবী - ইমাম আলী বিন বুরহানুদ্দিন হালাবী ২। সীরাতে ইবনে হিশাম - আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম ৩। জাদুল-মা’আদ - ইমাম আবু আব্দুল্লাহ বিন কাজয়েম জাওমী ৪। রাওজুল উনফ - ইমাম সোহাইলী ৫। খাসাযয়েসে কুবরা - ইমাম জালালউদ্দীন সুয়ূতী ৬। সীরাতুন্নবী - শিবলী নোমানী ও সুলায়মান নদভি ৭। আসাহচ্ছিয়ার - মাওলানা আব্দুর রউফ দানাপুরী ৮। হজরতে মোহাম্মদ (সা.) - মোহাম্মদ হোসাইন হাইকেল (মিশর) ৯। শাযারাতুল কওম - শেখ আকবর ইমাম মহীউদ্দিন ইবনুল আরাবী ১০। মাকতুবাত - মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী ১১। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া - ইমাম আহমদ ১২। মিশকাতুল মাসাবীহ ও অপরাপর হাদিস গ্রন্থ ১৩। বয়ানুল কুরআন, তাফসীরে আজিজি ও অন্যান্য তাফসীর
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "সাইয়েদুল মুরসালীন : অধ্যাপক আবদুল খালেক"। Mozlish (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-১০-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-০৪।
- ↑ ফজলুল হক শাহ, হাফেজ (১৯ ডিসেম্বর ২০১৯)। "সীরাত চর্চার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট"। দৈনিক ইনকিলাব।
- ↑ খালেক এমএ, আব্দুল (১৯৫১)। সাইয়েদুল মুরসালীন। বিবাড়িয়া: ছতুরা দরবার শরীফ। পৃষ্ঠা ১৮ – ২২।
- ↑ সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক; আব্দুল হাই, মোহাম্মাদ (১৯৫৬)। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত। পৃষ্ঠা ১২১ (৭ম সংস্করণ)।
- ↑ আবদুল মান্নান, সৈয়দ (২০১৮)। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান। ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ১৯১ পৃষ্ঠা (চতুর্থ মুদ্রণ)।
- ↑ হেলাল, নাসির (১৯৯৩)। বাংলা ভাষায় সীরাত বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা প্রথম অধ্যায়।
- ↑ মুহিউদ্দীন খান (সম্পাদক), মাওলানা। প্রিয় নবীজীর (সা:) প্রিয় প্রসঙ্গ। মদীনা পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ২০৭–২০৮।