শ্রীশ্রী বাসুদেব থান
শ্রীশ্রী বাসুদেব থান লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ থান। ঢকুয়াখনা চারিআলি থেকে পশ্চিমমুখ করে প্রায় ১০ কি:মি: গেলে এই প্রসিদ্ধ থানটি পাওয়া যায়।। থানটির সাথে বাসুদেবের একটি নামঘর আছে। সত্রের মোট আয়তন প্রায় ২০০ বিঘা। বর্তমানে এই তীর্থস্থানটি বলাহী চামপরা এবং চৌপারের মধ্যের সোবণশিরি নামের স্থানে অবস্থিত[১]।
শ্রীশ্রী বাসুদেব থান | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
জেলা | লখিমপুর |
অবস্থান | |
দেশ | ভারত |
স্থাপত্য | |
ধরন | অসমীয়া, মিসিং |
ইতিহাস এবং প্রবাদ
সম্পাদনাপূর্বে সত্রের ভূমি (যেখানে এটি মূলে অবস্থিত ছিল) ১৩৯২ খ্রিস্টাব্দে সদধাপুর/শদেয়া রাজ্যের চুতীয়া রাজা সত্যনারায়ণ বিষ্ণু পূজা করতে নারায়ণকে দান করেছিলেন এবং সাথে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু, বানভাসি জলের কারণে মন্দিরটির স্থান পরিত্যক্ত হয় এবং ১৪০১ খ্রিস্টাব্দে রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ (সত্যনারায়ণের পুত্র) একভাগ নতুন করে মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত করেন। মন্দিরটির ভূমি রবিদাস বনসপতি নামের একজন পুরোহিতকে দান করা হয়েছিল। পরের পর্য্যায়ে রবিদাসের বংশের বাহুদ নামের একজন ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব সন্ত দামোদরদেব আতাকে সত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মন্দিরটি দিয়ে দিয়েছিলেন।
চরিত পুথির মতে, ঠাকুরের আগমনের দিন রাতে স্বর্গদেউ জয়ধ্বজসিংহ রাতের স্বপ্নে চতুর্ভূজরূপী বিষ্ণুর অবতার দর্শন করে পরদিন ঠাকুরর আগে ব্যক্ত করে এবং নিজ রাজ্যে সত্রাদি করতে কুণ্ডিলর(শদিয়া) থেকে বাসুদেব মূর্তি আনতে রাজআধিকারিক প্রেরণ করেন। মূর্তি আনার পর সোবণশিরি নদীর কাছের চারিভাগী নামের স্থানের বাসুদেব মন্দিরের ভূমিতে সত্র স্থাপন করেন। এই চারিভাগী এবং লাউমুরী নামের স্থানে এই দুটি সত্র দামোদর ঠাকুর[২] প্রতিষ্ঠা করার জন্য নরোয়াসত্র নামে প্রসিদ্ধ হল। ১৮৫৮ সালে দামোদর ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রমাকান্তর সময়ে বাসুদেব থান নরোয়া সত্র নামে পরিচিত হয়। ১৬৮৩ সালে রমাকান্ত আতার মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রামদেব আতা দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু সোবণশিরি গ্রাস করলে থানটি সেখান থেকে তুলে এনে চামপরা এবং কঢ়ানৈর মধ্যে রমাকান্ত আতার পুত্র রামচরণ আতার সময়ে স্বর্গদেউ শিবসিংহের রাজসাহায্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং বাসুদেব থান নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সাতসরী আসাম ইতিহাসতে উল্লেখ থাকা মতে, মানের আক্রমণে সত্র উজার হওয়ার পর নরোয়ার অচ্যুত আতা পুনরায় সংস্কার করে থানটি তৈরি করেন। অচ্যুত আতার বিয়োগর পর তাঁর চারজন পুত্রের বরপুত্র মুক্তিনাথদেব সত্রের সত্রাধিকার হওয়ার সাথে থানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পুত্র কুশচন্দ্রদেব এবং মহেশচন্দ্রদেব এবং বহির্বিষয়ের দেখাশুনা করেছিলেন শিবচন্দ্রদেব। এদের সময়ে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের এবং তখনকার পূর্ববঙ্গ থেকে রাজমিস্ত্রী এনে চারিকোণ বিশিষ্ট পকী মন্দির নির্মাণ করা হয়[৩]
প্রথম অবস্থায় এই সত্রটির নাম "নরোয়া সত্র"। এখনকার সত্রটির নামকরণকে নিয়ে অনেকের মতবিরোধ হতে দেখা যায়। অনেকেই বলে যে, দামোদর আতা উজনির থেকে আসেন এবং তিনিই এই লাউমূরি সত্র স্থাপন করেছিলেন। বাহুদ নামের একজন ব্রাহ্মণ দামোদর আতাকে সত্রটির মাটিটুকু উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। ১৭০৭ সালে আহোম স্বর্গদেউ গৌরীনাথসিংহ এখানে আসেন, কিন্তু অগত্যা কারণে তিনি পুনরায় ফিরে চলে গিয়েছিলেন। যে নদী দিয়ে তিনি নৌকায় আসেন সেই নদীটি চামপরা বলে পরিচিত। ১৭ শতকের আরম্ভতে রামাকান্ত আতা আচম্বিতে নিম্নের বরপেটায় গিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করেন। পরে সেই সত্রটির সাথে একটি প্রকান্ড নামঘর তৈরি করা হয়। মাঘী পূর্ণিমার রাতে সেখানে "পাল নাম"-এর আজও চলে আছে। প্রবাদ আছে যে, এখানে যে প্রার্থনা করে তাঁর মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। আসামের দূর-দূরান্তের ভক্তের সাথে নেপালের অসংখ্য ভক্তকে এসে এখানে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। থানটির কথা নেপালে কীভাবে এমন প্রসিদ্ধ হল এর বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না।
বিবরণ
সম্পাদনাএই থানের মাটি প্রায় ২০০টি আবরা। প্রায়ভাগ গাছ-গাছালিতে ভরা। এই থানের কাছের অনেক গ্রামে বিভিন্ন মূর্তি উদ্ধার হয়েছে, যে মূর্তি লোকেরা এই থানে অর্পণ করেছেন।[৪][৫]
জন বিশ্বাস
সম্পাদনালোকবিশ্বাসানুসারে, রুক্মিণী বাসুদেব থানের মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন, বাসুদেবকে নিজের পতি হিসাবে পেতে। সেজন্য এই থানে ইচ্ছা পূর্ণ করার শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করা হয়।[৬]
যোগযোগ
সম্পাদনালখিমপুরের নকাড়ী রেলওয়ে স্টেশন সমীপতম্ রেলওয়ে স্টেশন ও লীলাবাড়ি বিমানবন্দর সমীপতম্ বিমান বন্দর।
শাখা থান
সম্পাদনাসত্রাধিকার মুক্তিনাথদেব গোস্বামীর সময়ে লখিমপুরের বিহপুরীয়া এবং পাহাড়ে দুটি শাখা থান প্রতিষ্ঠা করা হয়।[৩] এই দুটি যথাক্রমে—
- কাচি কটা বাসুদেব থান
- তরাজুলি বাসুদেব থান
বাসুদেব নামের অর্থ এবং তাৎপর্য
সম্পাদনা“কৃষ্ণ বাসুদেব” নামের আভিধানিক ব্যুৎপত্তি এবং অর্থ হচ্ছে-
বসুদেব+ষ্ণ (অপত্যার্থে) = বাসুদেব;
অর্থঃ বসুদেবের পুত্র পূর্ণব্রহ্ম দৈবকীনন্দন কৃষ্ণ, অর্থাৎ বসুদেব এবং তৎপত্নী দৈবকীর পুত্ররূপে অবতার হওয়া পরমব্রহ্ম কৃষ্ণই হচ্ছেন “বসুদেব”
মহাপুরুষ মাধবদেবের ঘোষার নামান্বয় অংশের ব্যুৎপত্তি করলেও পাওয়া যায় যে, পরমব্রহ্মের ‘কৃষ্ণ’ এবং ‘বাসুদেব’ এই দুটি নামে ব্রহ্মার একরূপকেই প্রকাশ করে একটি টাকার দুটি পিঠরূপে জগতে বিরাজ করেছে। কৃষ্ণরূপে সমস্ত পৃথিবীকে আনন্দ সাগরে দ্রবীভূত করে, বাসুদেবরূপে সমস্ত জগতে বাস করছেন এবং সমস্ত জগৎ তাতে নিবাস করছেন। সেই নিমিত্তে পণ্ডিতরা পরমব্রহ্ম কৃষ্ণকে বাসুদেব বলেছেন।[৩]
নরোয়া নামের তাৎপর্য
সম্পাদনাবেড সাহেবের “আসামের বিবরণ” পুথির মতে, ছাঁপরা নদীর পারে নরোয়া নামের স্থানে একটি থান আছে বলে উল্লেখ আছে এবং তাতে বছরে সহস্রাধিক দর্শনার্থী এসে বাসুদেব মূর্তি দর্শন করেন।[৭]
"NAROA is much smaller district, which does not exceed eight miles in length and six in breadth. It is chiefly noted for a temple or Takoorbari. The waters of Sowpurra (Champora) river contribute to enrich the estate of the NAROA GOSAIN or GOSWAMI. --- P. Wedd"
দামোদর ঠাকুর আই কনকলতার সাথে এসে বরদোয়া থান পুনরোদ্ধার করে নতুনভাবে একটি সত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে সত্রটিকে নরোয়া সত্র বলা হয়[৮]। অন্যদিকে বাসুদেবের মূর্তি বিরাজ করা থানটিতে নরোয়া বংশের গোঁসাই থাকার কারণে একে নরোয়া সত্রও বলে জানা যায়[৯]
বাসুদেব থানের মূর্তি
সম্পাদনাবাসুদেব থানের মূর্তিসমূহ বহু কালের পুরানো। পুরানো বাসুদেব থানের মূর্তিটি চুতীয়া রাজা সত্যনারায়ণ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বর্তমান থানের (সত্রর) বৃহৎ পাথরের মূর্তিটি কুণ্ডিলের চুতীয়া রাজার হাতে ছিল এবং পরবর্তীকালে দামোদর দেবের সময়ে নরোয়া সত্র পর্যন্ত স্থানান্তর করা হয়েছিল। এমনভাবে বাসুদেব থান এবং নরোয়া সত্রের সংযোগ ঘটে। ‘ঠাকুর চরিত্র’ নামের সাঁচিপতীয়া একটি পুথির থেকে জয়ধ্বজসিংহের সময়ে বাসুদেব-মূর্তি শদিয়া থেকে এনে নরোয়া থানে স্থাপন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। কলীয়া পাথরে খোদিত এই মূর্তিটির শিল্পকর্ম যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। চতুর্ভুজবিশিষ্ট এই মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুট অর্থাৎ ১২২ সেমিঃ। মন্দিরে থাকা অন্যান্য মূর্তি এবং কলার্কীতিসমূহ ১৪শ খ্রিস্টাব্দে চুতীয়া রাজার সময়ের বলে ধরতে পারা যায়।
সত্রাধিকার তথা ধর্মাচার্যগণ
সম্পাদনা- প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী দামোদর ঠাকুর
- রমাকান্ত ঠাকুর
- রামচন্দ্র ঠাকুর
- রামদেব
- ভদ্রদেব
- লক্ষ্মীদেব
- বামদেব
- অচ্যুৎ চন্দ্রদেব
- মুক্তিনাথদেব
- মহেশ চন্দ্রদেব
- শ্রীশ্রী রূপেন্দ্র দেব[৩]
অতিথিশালা
সম্পাদনাবাসুদেবে একটি অতি সুন্দর অতিথিশালা আছে। দূরের ভক্তদের জন্য এখানে থাকা এবং খাওয়ার সু-ব্যবস্থা আছে।
যোগাযোগ
সম্পাদনাবাসুদেব পর্যন্ত আসতে দুটি রাস্তা আছে। একটি ঘিলামরার বরদৈবাম থেকে এবং অন্যটি ঢকুয়াখনা পড়ে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ http://www.assaminfo.com/tourist-places/27/shri-shri-basudev-than.htm
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১০ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ ক খ গ ঘ * শ্রী শ্রী বাসুদেবথান নরোয়াসত্রের ইতিবৃত্ত, লেখক – প্রফুল্লনারায়ণ গোস্বামী শাস্ত্রী (প্রকাশকঃ শ্রীযুত মোহন চন্দ্র দেব গোস্বামী, প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
- ↑ 6th para Assaminfo.com
- ↑ http://www.cic.nic.in/cicwebpages/Assam/dakhuakhana/basudevthan1.htm ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে cic
- ↑ "cicwebpages, Assam, Dhakuakhana, Basudevthan1 Para 6"। ১০ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ ডঃ মহেশ্বর নেওগ সংকলিত এবং সম্পাদিত ‘পবিত্র অসম’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা নং ১৪-১৫
- ↑ শ্রী শ্রী বাসুদেব থান- অতীত এবং বর্তমান, লেখক – প্রফুল্লনারায়ণ গোস্বামী শাস্ত্রী (প্রকাশকঃ শ্রীযুত মোহন চন্দ্র দেব গোস্বামী, প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
- ↑ ১৯৮৫ সালের আসাম সাহিত্য সভার স্মৃতিগ্রন্থে অধ্যাপক শ্রীহরেন্দ্রদেব গোস্বামী লেখা প্রবন্ধ
- শ্রী শ্রী বাসুদেবথান নরোয়াসত্রের ইতিবৃত্ত, লেখক – প্রফুল্লনারায়ণ গোস্বামী শাস্ত্রী (প্রকাশকঃ শ্রীযুত মোহন চন্দ্র দেব গোস্বামী, প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
- শ্রী শ্রী বাসুদেব থান – অতীত এবং বর্তমান, লেখক — প্রফুল্লনারায়ণ গোস্বামী শাস্ত্রী (প্রকাশকঃ শ্রীযুত মোহন চন্দ্র দেব গোস্বামী, প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
- ডঃ মহেশ্বর নেওগ সংকলিত এবং সম্পাদিত ‘পবিত্র অসম’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা নং ১৪-১৫
- ১৯৮৫ সালের আসাম সাহিত্য সভার স্মৃতিগ্রন্থে অধ্যাপক শ্রীহরেন্দ্রদেব গোস্বামী লেখা প্রবন্ধ