শক্তি মণ্ডল
শক্তি মণ্ডল(ইংরেজি: Shakti Mandal) ( ১ অক্টোবর, ১৯৪৮ — ৬ মে, ২০২১) [১] ছিলেন এক বিশিষ্ট লেখক, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী, সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ভারতে আধুনিক রীতিতে সাক্ষরতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সত্যেন মৈত্র ও ড. ফুলরেণু গুহর পর জাতীয় পর্যায়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ড. সুশীলা নায়ার লিটারেসি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন।[২]
শক্তি মণ্ডল | |
---|---|
জন্ম | কাদড়া (তেলেঙ্গাহের),পশ্চিমবঙ্গ ভারত | ১ অক্টোবর ১৯৪৮
মৃত্যু | ৬ মে ২০২১ | (বয়স ৭২)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
নাগরিকত্ব | ভারতীয় |
পরিচিতির কারণ | সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা আন্দোলন |
দাম্পত্য সঙ্গী | মায়া মণ্ডল |
সন্তান | সায়ন্তন মণ্ডল (পুত্র) সংকলিতা মণ্ডল (কন্যা) |
পুরস্কার | ড.সুশীলা নায়ার লিটারেসি অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাশক্তি মণ্ডলের জন্ম ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১ লা অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর-হুগলি-বাঁকুড়া জেলার সীমান্তবর্তী কাদড়া (তেলেঙ্গাহের) গ্রামে। পিতা সুধীর মণ্ডল ও মাতা শঙ্করী দেবী। শক্তি মণ্ডলের স্কুলের পড়াশোনা নিকটবর্তী সেলামপুর প্রাথমিক ও বদনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। তারপর গড়বেতা কলেজ হয়ে, মেদিনীপুর কলেজ থেকে স্নাতক হন। এখানে পড়াশুনার সঙ্গে তার কাজ ছিল জনসেবা মূলক কাজে অংশ গ্রহণ ও ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায়। কলেজে ও স্থানীয় এলাকায় বেশ পরিচিত ছিলেন তিনি। কলেজের পড়া শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর সায়েন্স কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞানে এম. এ. পাশ করেন। বামপন্থায় বিশ্বাসী শক্তি মণ্ডল অবশ্য ১৯৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রাবস্থাতেই ছাত্র ও কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। কৃষক আন্দোলন থেকে দাবি ওঠে লাঙ্গল যার জমি তার। অজস্র মানুষের সমর্থনে আন্দোলন চলতে থাকে। তাকে অবরুদ্ধ করার জন্য সত্তরের দশকে নিবর্তনমূলক আটক আইনে বিনা বিচারে এক বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। জেলে গিয়ে তিনি জেল বন্দীদের নিয়ে সমাজ বদলের আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই কারণে বারে বারে তাকে এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।[১]
কর্মজীবন
সম্পাদনাবিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে ড. ফুলরেণু গুহর নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণামূলক প্রকল্পে যুক্ত হন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্ট বেঙ্গল কমপ্রিহেন্সিভ এরিয়া ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (সি.এ.ডি.সি) তথা পশ্চিমবঙ্গ সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের জলপাইগুড়ি ফালাকাটা প্রকল্পে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। সেসময় দেশে শুরু হয় জাতীয় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়নের অঙ্গ হিসাবে বয়স্কদের শিক্ষাদানকে তিনি অগ্রাধিকার দেন। পরবর্তীতে মালদার রতুয়া ও পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসীদের মধ্যে বনসৃজন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক উন্নয়নে দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সাক্ষরতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সত্যেন মৈত্রর আহ্বানে যোগ দেন তার পিতা দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রর প্রতিষ্ঠিত 'বেঙ্গল সোস্যাল সার্ভিস লিগে' এবং লিপ্ত হন 'বারাসাত-ব্যারাকপুর গ্রামীণ শিক্ষা প্রকল্প এর প্রকল্প সমন্বয়কারী হিসাবে।[১] শক্তি মণ্ডলের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও নিপুণ পরিচালনায় সারা ভারতে অন্যতম আদর্শ প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে এবং প্রখ্যাত নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায় প্রশিক্ষণে ব্যবহারের উপযোগী তথ্যচিত্র "বয়স্ক শিক্ষার বিশেষ পদ্ধতি" তৈরি করেন। শক্তি মণ্ডলের কাজে সত্যেন মৈত্র খুশি হয়ে রাজ্য উপকরণ কেন্দ্রে যোগ দিতে আহ্বান জানান। অতঃপর সি.এ.ডি.সি. কাজ ছেড়ে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য উপকরণ কেন্দ্রেই যোগ দেন। জাতীয় সাক্ষরতা মিশনে যুক্ত হয়ে সার্বিক সাক্ষরতা অভিযানে সামিল হলেন আর আজীবন লিপ্ত থাকলেন সাক্ষরতা ও জনশিক্ষার কাজে কখনো সমন্বয়কারী হিসাবে, কখনো বা প্রশিক্ষক হিসাবে। সত্যেন মৈত্র-র অনুজ সহকর্মী হিসাবে তার সান্নিধ্যে ছিলেন দশ বৎসর। এরপর তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কল্যাণী ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক শিক্ষা বিভাগে ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অসংখ্য বয়স্ক শিক্ষাকর্মীকেও। শক্তি মণ্ডল কেবল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য স্তরেই নয়, তিনি জাতীয় সাক্ষরতা মিশনের থেকে দায়িত্ব পেয়ে ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, সিকিম, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যে সাক্ষরতা ও বয়স্ক শিক্ষায় নিযুক্ত প্রশিক্ষক ও সংগঠকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রচনা করেছেন বয়স্ক শিক্ষার পাঠক্রম। রচনা করেছেন বহু পুস্তিকা, প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন বেঙ্গল সোস্যাল সার্ভিস লিগের ত্রৈমাসিক পত্রিকা "জনশিক্ষা প্রসঙ্গে"। শক্তি মণ্ডলের অসংখ্য নিবন্ধ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে 'জনশিক্ষা প্রসঙ্গে ' 'জনশিক্ষা সংবাদ', জনশিক্ষা ভাবনা', শিক্ষা দর্পণ', 'পশ্চিমবঙ্গ', 'যুবমানস', 'গণশক্তি', 'দেশহিতৈষী','হরিপাল বার্তা', 'নিশান' Third dimension in education, A RBU Journal, A Journal of Calcutta Mathematical Society প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়। নিবন্ধের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। এর মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে- "তাম্রলিপ্ত: প্রাচীন ভারতের এক গৌরবময় অধ্যায়" বা "প্রতিহত করতে হবে জ্ঞান কমিশনের ভাষা সংক্রান্ত সুপারিশ" সংক্রান্ত বিষয় তেমনই "বিশ্বে সাক্ষরতা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি" র মতো সাক্ষরতা আন্দোলনে ব্যবহারের উপযোগী তথ্যসমৃদ্ধ বিষয়াদি। জনশিক্ষা আন্দোলনের মহান পথিকৃৎ সত্যেন মৈত্রকে শ্রদ্ধা জানাতে ও তার কাজকে আগামী দিনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূলত তার উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল 'সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতি' তার প্রথম প্রয়াণ বর্ষপূর্তি দিবসে, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুন।[৩] পরবর্তীতে এই সমিতির মাধ্যমের সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা কাজ ব্যস্ত থেকেছেন। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই আন্দোলনকে আরো কার্যকরী করে তুলতে সূচনা করেছিলেন 'ব্যবহারিক ও আর্থিক সাক্ষরতা প্রকল্প-২০১৫' । পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার এতে অনেক সাফল্যও এসেছে। মূলত, বিদ্যাসাগরের জীবন ও আদর্শ তাঁকে বহুলাংশে অনুপ্রাণিত করেছিল। সারাজীবন সাক্ষরতা ও জনশিক্ষায় লিপ্ত থেকে সমাজের নিরক্ষর ও আর্থিক দিক হতে দুর্বল মানুষদের জন্য কিছু করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এছাড়াও তিনি বাংলার ব্রতচারী সমিতি, ইন্ডিয়ান পাওলো ফ্রেইরি ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়ান অ্যাডাল্ট এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য কমিটি সহ বহু সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। তার রচিত ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -
সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা সম্পর্কিত -
সম্পাদনা- গণ সাক্ষরতা : ধারণা ও রূপায়ণ
- বয়স্ক শিক্ষা কি ও কেন
- ভারতে বয়স্ক শিক্ষার ইতিহাস (অনুবাদ)
- সদ্য ও স্বল্প সাক্ষরদের জন্য প্রবাহন শিক্ষা প্রকল্প (অনুবাদ)
- প্রবহমান শিক্ষা কর্মসূচি প্রশিক্ষণ সহায়িকা
- সাক্ষরোত্তর কার্যক্রম : ধারণা ও রূপায়ণ
- সাক্ষরোত্তর কার্যক্রম: কি ? কেন? কীভাবে?
- জনশিক্ষার গান
- আমাদের লেখাপড়া (১ম,২য় ও ৩য় ভাগ)
- জনশিক্ষার মহান পথিকৃৎ সত্যেন মৈত্র (যৌথ সম্পাদনা)
অন্যান্য বিষয়
সম্পাদনা- মর্ত্যের মানুষ (কাব্যগ্রন্থ) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত
- আদর্শ মানুষ বিদ্যাসাগর
- সবুজের অভিযান
- প্রতিদিনের বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা
- আলোচনার নির্দেশিকা: মৌলবাদের বিপদ ও ধর্মনিরপক্ষেতা
- বিদ্যাসাগরের জীবন ও অবদান
- অনন্য বিদ্যাসাগর: ফিরে দেখা
সম্মাননা
সম্পাদনাশক্তি মণ্ডল সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা আন্দোলনের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তবে তার অনন্য অবদানের স্বীকৃতি মিলেছে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় স্তরের "ড.সুশীলা নায়ার লিটারেসি অ্যাওয়ার্ড" প্রাপ্তিতে। সাক্ষরতার সাথে জড়িত তার নিজের "ব্যবহারিক ও আর্থিক সাক্ষরতা প্রকল্প-২০১৫"-এ উপকৃত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ফলতা সাক্ষরতা কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের স্বীকৃতি যা ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে হায়াৎনগর সুভাষ সমিতিতে প্রদত্ত হয়েছিল, তাকে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা হিসাবে নিজে উল্লেখ করেন।
জীবনাবসান
সম্পাদনাশক্তি মণ্ডল কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই মে কলকাতায় প্রয়াত হন।[১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ "জনশিক্ষা আনন্দোলনের নেতা প্রয়াত"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-০৮।
- ↑ "আলোর পথিক : শক্তি মণ্ডল"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-২৫।
- ↑ আদর্শ মানুষ নির্মল দাশ, জনশিক্ষা ভাবনা, এপ্রিল-জুন, ২০১৬ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৯০ আইএসএসএন 2319-6610