লতিকা সরকার (৪ঠা জানুয়ারি ১৯২৩ - ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০১৩) ছিলেন একজন ভারতীয় নারীবাদী, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ এবং আইনজীবী, যিনি ভারতে নারী অধ্যয়ন এবং নারী অধিকারের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত দিল্লির সেন্টার ফর উইমেনস ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (সিডব্লিউডিএস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর উইমেন স্টাডিজ-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৫১ সালে শুরু করে, ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে আইন পড়িয়েছেন এবং আইন অনুষদের প্রধান ছিলেন; এরপর তিনি ভারতীয় আইন শিক্ষালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন এবং পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী প্রথম মহিলা হন।[১][২]

লতিকা সরকার
চিত্র:Lotika Sarkar.jpg
জন্ম(১৯২৩-০১-০৪)৪ জানুয়ারি ১৯২৩
মৃত্যু২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩(2013-02-23) (বয়স ৯০)
নতুন দিল্লি, ভারত
জাতীয়তাভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনকেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়
পেশানারীবাদী, শিক্ষাবিদ এবং আইনজীবী
প্রতিষ্ঠানদিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়
ভারতীয় আইন শিক্ষালয়

প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা সম্পাদনা

লতিকা সরকার ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন, যেখানে তাঁর বাবা স্যার ধীরেন মিত্র ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান আইনজীবী।[৩]

তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে কেমব্রিজের নিউনহ্যাম কলেজে আইন অধ্যয়ন করেন এবং তারপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন।[২][৪][৫] পরে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আইনে পিএইচডি করেন, ১৯৫১ সালে তিনি এই ডিগ্রি পান।[৬][৭] তারপরে ১৯৬০ সালে, তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক আইন অধ্যয়ন করেন, সেখানে তিনি চারজন ভারতীয় ছাত্রের মধ্যে একজন ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন।[৭]

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৫৩ সালে, লতিকা সরকার যখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে শিক্ষকতা শুরু করেন, তখন তিনি অনুষদের প্রথম মহিলা প্রভাষক ছিলেন। আইন তখনও মহিলাদের জন্য একটি নতুন ক্ষেত্র ছিল, প্রাথমিকভাবে কার্যক্রমে মাত্র ১০ জন মহিলা ছিলেন, সংখ্যাটি ১৯৬০-এর দশকে ৮০ -১০০তে উন্নীত হয়।[৩][৭] তিনি ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতা করেছেন, বিশিষ্ট আইনবিদ এবং আইনজীবীদের শিক্ষা দিয়েছেন। অবশেষে তিনি আইন অনুষদের প্রধান[৬] এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডন হন।[২][৮]

১৯৭১ সালে, তিনি ভারতের স্ট্যাটাস অফ উইমেন (সিএসডব্লিউআই) কমিটির সদস্য হন,[৯] সেখানে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বীনা মজুমদার, যিনি ১৯৭৩ সালে সদস্য-সচিব হিসাবে যোগদান করেছিলেন।[১০] তাঁরা দুজনে সেখানে একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ পত্র প্রকাশ করেন, যার নাম ছিল টুওয়ার্ডস ইকুয়ালিটি: দ্য রিপোর্ট অফ দ্য কমিটি অন দ্য স্ট্যাটাস অফ উইমেন ইন ইণ্ডিয়া (১৯৭৪ - ৭৫)।[২][১১] ১৯৭৯ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মথুরা ধর্ষণ মামলায় বোম্বে হাইকোর্টের রায়কে বাতিল করে দেয়, হাইকোর্টের রায়ে একটি থানার মধ্যে ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের দায়ে দুই পুলিশ সদস্যকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। এই বেকসুর খালাস প্রদান ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনেকটাই নজরে আসেনি। এরপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উপেন্দ্র বক্সি, রঘুনাথ কেলকর ও লতিকা সরকার এবং পুনের বসুধা ধাগমওয়ার রায়ে সম্মতির ধারণার প্রতিবাদ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। "সম্মতি প্রদানের সঙ্গে নমন জড়িত থাকে, কিন্তু এর বিপরীত সবসময় সত্য নয়...কেসের ঘটনা থেকে, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নমন, সম্মতি নয়...বিবাহ-পূর্ব যৌনতার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কি এতটাই শক্তিশালী যে ভারতীয় পুলিশকে তরুণীদের ধর্ষণের লাইসেন্স প্রদান করা হতে পারে?"[১২] পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে লতিকা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রথম নারীবাদী দল গঠন করেন, যার নাম "ধর্ষণের বিরুদ্ধে ফোরাম"। এরপর ব্যাপক প্রতিবাদ হয় এবং অবশেষে ভারতীয় দণ্ডবিধি সংশোধন করা হয়।[৪][১৩][১৪]

১৯৮০ সালে, তিনি বীনা মজুমদার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দিল্লির সেন্টার ফর উইমেনস ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (সিডব্লিউডিএস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়েছিলেন। এটি ভারতে মহিলাদের অধ্যয়ন-এর কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।[১৫] ১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকে, তিনি দিল্লিতে ভারতীয় আইন শিক্ষালয়ে ফৌজদারি আইন পড়াতে শুরু করেন।[৩][৬] তিনি ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর উইমেনস স্টাডিজের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন।[১৬]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

১৯৫১ সালে চঞ্চল সরকারের সাথে লতিকার পরিচয় হয়, চঞ্চলও তখন কেমব্রিজে পড়ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তাঁদের বিয়ে হয়।[৭] চঞ্চল সরকার একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, দ্য স্টেটসম্যানের সহকারী সম্পাদক এবং ১৯৬৩ সালে প্রেস ইনস্টিটিউট অফ ইণ্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হয়েছিলেন; তিনি ২০০৫ সালের ১০ই অক্টোবর দিল্লিতে মারা যান।[১৭][১৮] তাঁদের কোন সন্তান ছিল না।[১৯]

এরপর থেকে লতিকা তাঁদের দিল্লির হৌজ খাস বাসভবনে বসবাস করতে থাকেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তাঁর ভাড়াটিয়ারা তাঁকে বাড়ি থেকে উৎখাত করেছিল, যার ফলে গণমাধ্যমে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।[২০] বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সমাজকর্মী এবং এক ডজনেরও বেশি জাতীয় দল এবং সংস্থা দ্রুত বিচারের দাবিতে তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।[২১][২২] কেউ কেউ এমনকি রাষ্ট্রপতির সাথেও দেখা করেছিলেন।[৮] অবশেষে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে আদালত তাঁকে বাড়িটি ফিরিয়ে দেয়।[২৩]

তিনি ২০১৩ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি তারিখে ৯০ বছর বয়সে নতুন দিল্লিতে মারা যান।[৬]

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

  • ব্রিগালিয়া এইচ. ব্যামের সাথে নিউ পারস্পেক্টিভ ফর থার্ড ওয়ার্ল্ড উইমেন (ইভি ম্যাথিউ স্মারক বক্তৃতা) ব্রিগালিয়া এইচ বামের সঙ্গে। ক্রিশ্চিয়ান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ রিলিজিয়ন অ্যাণ্ড সোসাইটি, ১৯৭৯।
  • ন্যাশনাল পলিসিস অ্যাণ্ড লিগ্যাল রিফর্ম: ইমপ্যাক্ট অন উইমেন, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ, প্রোগ্রাম অফ উইমেনস স্টাডিজ, ১৯৮০।
  • কনস্টিটিউশনাল গ্যারান্টিস: দ্য আনইক্যুয়াল সেক্স সেন্টার ফর উইমেন'স ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ১৯৮৬।
  • ন্যাশানাল স্পেশালাইজড এজেন্সিস অ্যাণ্ড উইমেন'স ইক্যুয়ালিটি: ল কমিশন অফ ইণ্ডিয়া । সেন্টার ফর উইমেন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ১৯৮৮।
  • লেজিসলেটিভ মেজারস অ্যাণ্ড পলিসি ডিরেকশনস ফর ইম্প্রুভিং দ্য লট অফ ফার্ম উইমেন বীণা মজুমদার, কুমুদ সরমার সঙ্গে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ।
  • হ্যাণ্ডবুক অন উইমেন অ্যান্ড ল, খণ্ড ১। লিগ্যাল লিটারেসি প্রজেক্ট, ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাডাল্ট কন্টিনিউয়িং এডুকেশন অ্যাণ্ড এক্সটেনশন, দিল্লি ইউনিভার্সিটি, ১৯৯০।
  • উইমেন'স মুভমেন্ট অ্যান্ড দ্য লিগ্যাল প্রসেস, সেন্টার ফর উইমেনস ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ১৯৯৫।
  • এনজেণ্ডারিং ল: এসেজ ইন অনার অফ লতিকা সরকার, সম্পাদক- অমিতা ধান্দা, অর্চনা পরাশর। ইস্টার্ন বুক কোম্পানি, ২০০৫। আইএসবিএন 8170129540

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Few saw her in last two years"The Times of India। ১৪ জানুয়ারি ২০০৯। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 
  2. Indu Agnihotri (১৮ মে ২০১৩)। "Remembering Lotika Sarkar (1923–2013)"Economic and Political Weekly। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৩ 
  3. "In Remembrance: Professor Lotika Sarkar (1923–2013)"। Bar and Bench। ৮ এপ্রিল ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০১৩ 
  4. "In memoriam: Lotika Sarkar 1923 – 2013"। feministsindia.com। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 
  5. Malini Chib (১১ জানুয়ারি ২০১১)। One Little Finger। SAGE Publications। পৃষ্ঠা 7। আইএসবিএন 978-81-321-0671-5 
  6. "Latika Sarkar, former head of DU law faculty, no more"The Times of India। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ১৫ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৩ 
  7. "Lawyer Here From India"The Age, Australia। ২৬ জুলাই ১৯৬১। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 
  8. "Lotika's friends meet Prez to seek justice"The Times of India। ২৭ মার্চ ২০০৯। ২৯ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 
  9. Agrawal, p. 61
  10. Agrawal, p. 62
  11. Urvashi Butalia (৩১ মে ২০১৩)। "Rolling stone who anchored the women's movement"The Hindu। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৩ 
  12. Khullar, p. 132
  13. "The Mind And Heart of Lotika Sarkar, Legal Radical, Friend, Feminist"। MSN News India। ৭ মার্চ ২০১৩। ১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০১৩ 
  14. Indira, Jaising (২০ জানুয়ারি ১৯৯৯)। "Slamming the doors of justice on women"The Indian Express। ৯ জুলাই ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ জুন ২০১৩ 
  15. Nagarajan, Rema (৮ মার্চ ২০১০)। "Educated middle class women are selfish"The Times of India। ১১ আগস্ট ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  16. "Founding Members"। Indian Association for Women's Studies। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০১৩ 
  17. "Chanchal Sarkar dead"The Hindu। ১১ অক্টোবর ২০০৫। ২৯ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৩ 
  18. "OBITUARY: Chanchal Sarkar (1926–2005)"The Telegraph। Kolkota। ১৭ অক্টোবর ২০০৫। ১৭ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০১৩ 
  19. "Latika hasn't run out of options"The Times of India। ১৫ জানুয়ারি ২০০৯। ৭ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 
  20. "Owner's pride now friend, help's envy: catfight over house in Hauz Khas"The Indian Express। ১৪ জানুয়ারি ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০১৩ 
  21. "150 notables demand justice for Lotika Sarkar"The Times of India। ১৭ মার্চ ২০০৯। ২৯ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 
  22. "Demand to transfer Lotika's property back to her"The Hindu। ১৭ মার্চ ২০০৯। ২৯ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩a pioneer in the field of women's studies and human rights,.. 
  23. "Lotika Sarkar gets her house back after all"The Hindu। ২৭ নভেম্বর ২০০৯। ৩০ নভেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০১৩ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা