সাধারণত আন্তর্জাতিক আইন বলতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট আইন, যা এক রাষ্ট্র বা জাতির সাথে অন্য রাষ্ট্র বা জাতির সম্পর্ক নির্ধারণ করে।[১][২] আন্তর্জাতিক আইন কোন একক রাষ্ট্রের সৃষ্টি নয়। এ আইন বিভিন্ন রাষ্ট্রের ঐকমত্য ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং তা প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অন্য রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সৃষ্ট। প্রত্যেক রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন শ্রদ্ধার সাথে মেনে চলতে দায়বদ্ধ। প্রধানত দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের স্বার্থে সৃষ্ট সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে এ আইনের সৃষ্টি। চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলো এ আইন মেনে চলতে বাধ্য। তবে অনেকক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় আইন থেকে আন্তর্জাতিক আইন চারিত্রিক দিক থেকে পৃথক; এ আইন জনগণের জন্য নয়, (তবে তা দুলভ কিছু ক্ষেত্রে প্রায়োগ করা হয়) রাষ্ট্রের জন্য ঘোষিত। আন্তর্জাতিক আইন নিশ্চিত করার জন্য বেশ কয়েকটি সংস্থা গঠিত হয়েছে এবং কয়েকটি ঘোষণা ও কনভেনশন ঘোষিত হয়েছে।

আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের পেছনে জাতিসংঘের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস সম্পাদনা

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস দুই রকম: বস্তুগত ও অবস্তুগত। একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাধারণ সম্মতি সৃষ্টি হয়। এ সাধারণ সম্মতি আন্তর্জাতিক আইনের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রসমূহের এ সাধারণ সম্মতি আন্তর্জাতিক আইনকে বৈধতা দান করে। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন পালনের মূলসূত্র হিসেবে সাধারণ সম্মতিকে ধরে নিয়ে "জনগণের ইচ্ছা" যা রাষ্ট্রসমূহের সমন্বিত ইচ্ছা দ্বরা প্রতিফলিত হচ্ছে, তাকে আন্তর্জাতিক আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস বলা হয়। আবার যেসব বিষয় বা বস্তু আন্তর্জাতিক আইনের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয় অর্থাৎ যে প্রকৃত উৎস থেকে আইন তার শক্তি আহরণ করে, তাকে বস্তুগত উৎস বলে। আন্তর্জাতিক চুক্তি, প্রথা, আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত বা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবাবলী বস্তুগত উৎসের অন্তর্গত। আন্তর্জাতিক আইন মূলত প্রথাভিত্তিক আইনের একটি অন্যতম উৎস হিসেবে স্বীকৃত। প্রথাই আন্তর্জাতিক আইনের প্রাথমিক উৎস এবং অনেকাংশে প্রথাসমূহই ক্রমান্বয়ে চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ন্যায়পরায়ণতাকে বিবেচনায় আনা হয়।

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস নির্ণয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ৩৮ (১) ধারা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।[৩] এ ধারা অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালত যে আইন প্রয়োগ করবে তা হল:

  1. বিভিন্ন বিধি-বিধান সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা চুক্তি যা বিরোধপক্ষসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত;
  2. আন্তর্জাতিক প্রথা যা আইন হিসেবে সাধারণভাবে স্বীকৃত;
  3. আইনের সাধারণ নীতিমালা যা সভ্য জাতিসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত;
  4. বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত; এবং
  5. বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতবাদ যা আইনের বিধান নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা পালনে সক্ষম।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মতে আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ধারা ৩৮-এর প্রথম অনুচ্ছেদে যে সমস্ত উৎসের কথা বলা হয়েছে সেগুলো মৌলিক এবং গুরুত্বের অণুক্রমিক অনুসারে সাজানো হয়েছে।[৪]

আন্তর্জাতিক আইনের বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

  1. আন্তর্জাতিক আইন বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ও সংগঠনের সম্পর্ক নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করে।
  2. রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংগঠন এর বিষয়বস্তু।
  3. পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিদের সম্মতিতে এ আইন প্রণীত হয় এবং রাষ্ট্রসমূহের সম্মতিতে তার প্রতিফলন ঘটে।
  4. রাষ্ট্রীয় আইনের মত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী কোন সংস্থা নেই। রাষ্ট্রসমূহকে স্থায়ী ব্যবস্থায় কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হয়। এ পদক্ষেপ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক পদক্ষেপ হতে পারে।

আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি সম্পাদনা

আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। আকাশসীমা, জলসীমা, স্থলসীমা এমনকি তার বাইরেও আন্তর্জাতিক আইনের বিচরণ রয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি হল:

  1. রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংগঠন ও ব্যক্তি।
  2. রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের সাথে আন্তর্জাতিক সংগঠন বা আন্তর্জাতিক সংগঠন ও রাষ্ট্র হতে ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ও বিষয়ে।
  3. অর্থ,বাণিজ্য, কর ও শুল্ক সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী।
  4. আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা।
  5. আন্তর্জাতিক নদী ও সমুদ্র এবং তার তলদেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনা।
  6. আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট, যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব্ব নিরসন ও শান্তি।
  7. মানবাধিকার বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন।
  8. বিরোধ মীমাংসায় আন্তর্জাতিক আদালত ও সালিশী আদালত।
  9. আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ, যেমন- সার্ক, আসিয়ান, ন্যাটো ইত্যাদি।
  10. আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সেবাসংস্থাসমূহ, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রসমূহ।
  11. আন্তর্জাতিক সাংবিধানিক আইন।
  12. পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার ও রোধ।
  13. আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান।
  14. আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত অমান্যের প্রতিকার।
  15. গোষ্ঠীগত অধিকার, নারী ও শিশু অধিকার আদিবাসী অধিকার ইত্যাদি।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "The Free Dictionary Definition of Human Rights"। The American Heritage® Dictionary of the English Language, Fourth Edition copyright ©2000 by Houghton Mifflin Company. Updated in 2009.। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  2. ১৭৮০ সালে আন্তর্জাতিক আইন কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন জেরেমি বেন্থাম। দেখুন, Bentham, Jeremy (১৭৮৯), An Introduction to the Principles of Morals and Legislation, London: T. Payne, পৃষ্ঠা 6, সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১২-০৫ 
  3. "আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ধারা ৩৮ (১)"। ২৯ জুন ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০১৩ 
  4. Slomanson, William (২০১১)। Fundamental Perspectives on International Law। Boston, USA: Wadsworth। পৃষ্ঠা 26–27। 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা