মেঘালয়ের মাতৃবংশীয় সমাজ

উত্তর-পূর্ব ভারত-এর মেঘালয় রাজ্যর কয়েক জনগোষ্ঠীতে মাতৃবংশ প্রথার প্রচলন আছে। নারীর উত্তরপুরুষের মাধ্যমে বংশের আভাস পাওয়াকে মাতৃবংশ বলে। এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনো একজন ব্যক্তির মাধ্যমে তাঁর মায়ের বংশের সূচনা হয় এবং সম্পত্তির বা উপাধির উত্তরাধিকার জড়িত থাকে। এমন ব্যবস্থা সাধারণত দেখা পিতৃপ্রধান প্রথা থেকে ভিন্ন যেখানে পরিবারের পরিচয় মূল পুরুষ থেকে আসে। খাসি, গারো এবং মেঘালয়ের অন্য অন্য উপগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অতীত থেকে মাতৃবংশীয় সমাজ ব্যবস্থা চলে আসছে। খাসিদের মাতৃবংশীয় প্রথা পৃথিবীর বৃহৎ মাতৃবংশীয় সংস্কৃতিসমূহের অন্যতম।

খাসি মহিলা

পটভূমি সম্পাদনা

উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য অনেক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেঘালয় রাজ্যের খাসিরাও মাতৃবংশ প্রথা মেনে চলে।[১] ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, আচার-ব্যবহার থাকা কয়েক উপগোষ্ঠীর জন্য খাসি জনগোষ্ঠী শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই সব গোষ্ঠীর উপজাতীয় পরিচয় Ki Hynniew Trep (সাতটা পঁজা) নামে একেই।[২] অন্যদিকে আচিক লোকদের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে গারো নামটির মাধ্যমে বোঝানো হয়।

খাসিদের মাতৃবংশীয় প্রথাকে পৃথিবীর "বর্তে থাকা বৃহৎ মাতৃবংশীয় সংস্কৃতিসমূহের" একটি বলে অভিহিত করা হয়েছে।[৩] খাসি, গারো এবং অন্য অন্য গোষ্ঠীসমূহ মেঘালয়ের সঙ্গে আসাম এবং বাংলাদেশ-এর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাস করেন। পূর্ব এশিয়ার মন-মার লোকদের খাসিদের পূর্বপুরুষ বলে বিশ্বাস করা হয়। খাসি এবং অন্য উপগোষ্ঠীসমূহের মাতৃবংশীয় প্রথা ভারতে অদ্বিতীয়। তাঁদের লোকবিশ্বাস, কিংবদন্তি এবং উৎপত্তির কাহিনীগুলিতে মাতৃবংশের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।[৪] যুদ্ধে যাওয়া খাসি রাজাগণ পরিবারের দায়িত্ব মহিলাদের দিয়ে যেতেন এবং সেইজন্য সমাজে মহিলাদের ভূমিকা অতীত থেকে সম্মানীয় হয়েছে।[১][৫] হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত-এ উল্লিখিত নারী রাজ্যখাসি ও জয়ন্তীয়া পাহাড় এবং মেঘালয়ের মাতৃবংশ প্রথার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে।[৬][৭] ২০০৪ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে মেঘালয়ের উপজাতিসমূহের মাতৃবংশীয় বৈশিষ্ট্য কিছু পরিমাণে কম হয়ে আসছে।[৮]

অধিকার, ভূমিকা এবং দায়িত্ব সম্পাদনা

মেঘালয়ের মাতৃপ্রধান সমাজে নারীর ভূমিকা প্রধান। পরিবারের নুমলীয়া মেয়ে Ka Khadduh সব সম্পত্তির অধিকার পান।[৯] বিবাহের পর জামাই শ্বাশুড়ির গৃহে থাকে। সন্তানগণ মায়ের উপাধি নেয়। কোনো লোকের কন্যা সন্তান জন্ম না হলে তাঁরা একজন মহিলাকে দত্তক নেয় এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাহকে হস্তান্তর করেন। ছেলে সন্তান জন্মের বিপরীতে কন্যা সন্তানের জন্ম উদ্‌যাপন করা হয়।[১] একজন নারী পুনর্বিবাহ করেন বা বিবাহ বহির্ভূত ভাবে সন্তান জন্ম দিলে সামাজিক অপবাদের বলি হয় না। "Khasi Social Custom of Lineage Act" নিয়মে তাঁদের সুরক্ষা দেন। কখনো কোনো নারী অন্য জনগোষ্ঠীর পুরুষকে বিয়ে করে।[৫] খাসি সমাজের সফল মহিলাগণ অনুভব করে যে তাঁদের "সামাজিক ব্যতিক্রম" সফল হওয়ায় সর্বতোপ্রকারে সহায়তা করেন।[৯] প্রায় সব ছোট-বড় ব্যবসায়ের দায়িত্ব মহিলারাই নেয়।[৫]

১৯৯৪ সালে বীণা আগরবাল গারো এবং খাসিদের বৈশিষ্ট্যর তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি বলেন যে গারোদের মধ্যেও মাতৃবংশীয় উত্তরাধিকার, বিবাহের পর মায়ের বাড়িতে বা কাছে বাসের প্রথা, সম্পর্কিত লোকের মধ্যে বিবাহের পছন্দ, প্রাক্‌-বৈবাহিক যৌনমিলন ইত্যাদির প্রচলন আছে, কিন্তু নারীর ব্যভিচারকে শাস্তি দেওয়া হয়। অন্যদিকে খাসিদের মধ্যে মাতৃবংশীয় উত্তরাধিকার, বিবাহের পর মায়ের বাড়িতে বা কাছে বাসের প্রথা এবং দ্বি-বাসস্থানের (পত্নী মা-বাবার সঙ্গে বাস করে এবং গিরি অন্য বাড়িতে বাস করে) নিয়ম আছে। সম্পর্কিত লোকের মধ্যে বিবাহের বিরূপ ভাব আছে। খাসি নারীরও প্রাক্‌-বৈবাহিক যৌনমিলন মেনে নেওয়া হয় কিন্তু ব্যভিচারকে শাস্তি দেওয়া হয়।[১০]

সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্ব মায়ের বা শ্বাশুড়ির।[১১] সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করা কনিষ্ঠ কন্যাকেও মা-বাবার বৃদ্ধ বয়সে যত্ন নিতে হয় এবং ভাই-বোনদেরও পড়া-শুনা বা অন্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।[১][৫]

কিছু খাসি পুরুষ এমন সমাজে নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক জ্ঞান করেন। তাঁরা পুরুষের সম-অধিকার পেতে Syngkhong Rympei Thymmai[১][৫] এবং Sam Kam Rin Ku Mai (সামাজিক পুনর্গঠন সংঘ)র মত সংস্থা গঠন করেছেন। তাঁরা প্রকাশ করেন যে "খাসি পুরুষের কোনো সুরক্ষা নেই, তাঁদের মাটির অধিকার নেই, তাঁরা পারিবারিক ব্যবসায় চালাতে পারে না এবং কোনো কাজে গ্রহণযোগ্য নয়।”[১]

মেঘালয়ের সমাজ মাতৃবংশীয় হলেও মাতৃপ্রধান নয়। আগেকার রাজার দিনে রাজার নুমলীয়া বোনের পুত্র‌ই রাজ্যের শাসনভার লাভ করত। এখনও মেঘালয় বিধানসভা বা পঞ্চায়েত নারীর অংশগ্রহণ নূন্যতম।[১১] ২০১৩ সালে মেঘালয় বিধানসভার ৬০ জন সদস্যের মাত্র পাঁচজন মহিলা। উপজাতির মুখ্য রাজনৈতিক বিভাগ Dorbar Shnong-এ মহিলাদের কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয় না।[৫] কিন্তু মহিলাগণ অনুভব করেন যে তাঁরা পুরুষদের থেকে টাকা-পয়সার দায়িত্ব ভালমত পালন করেন এবং সেইজন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উপভোগ করেন।[১২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Rimmer, Sandra। "The ancient Indian tribe where the women are in charge and activists lobby for men's rights"। Planet Earth & its Life Forms। ১০ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৬ 
  2. Schweizer ও White 1998
  3. Laird, T.। "A woman's world: Meghalaya, India – matrilineal culture"। ICIMOD। ১০ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৬ 
  4. Sen 2004, পৃ. 48।
  5. Bhaumik, Subir (১৬ অক্টো ২০১৩)। "Meghalaya: Where women call the shots"Aljazeera। ১০ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৬ 
  6. Mann 1996, পৃ. 42-43।
  7. Gupta 1984, পৃ. 7।
  8. Lyndem ও De 2004, পৃ. 280।
  9. Allen, Timothy (১৯ জানুয়ারি ২০১২)। "Meghalaya, India: Where women rule, and men are suffragettes"BBC News। ২২ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৬ 
  10. Agarwal 1994, পৃ. 141।
  11. Bouissou, Julien (১৮ জানুয়ারি ২০১১)। "Where women of India rule the roost and men demand gender equality"The Guardian। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৬ 
  12. Kirkpatrick, Nick (১৭ এপ্রিল ২০১৫)। "Kingdom of girls: Women hold power in this remote Indian village"The Washington Post। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১৬ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা