মুলাদি হত্যাকাণ্ড

বাংলাদেশের বরিশালে সংঘটিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা

মুলাদি হত্যাকাণ্ড ছিল আনসার ও পুলিশের সক্রিয় যোগসাজশে বন্দুকধারী সশস্ত্র জনতা কর্তৃক ১৯৫০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যে মুলাদি নদী বন্দরে নিরস্ত্র হিন্দু ও খ্রিস্টান পুরুষ ও বৃদ্ধ মহিলাদের গণহত্যার একটি ধারাবাহিক ঘটনা।

মুলাদি হত্যাকাণ্ড
মুলাদি হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
মুলাদি হত্যাকাণ্ড
স্থানমুলাদি, বরিশাল, পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান অধিরাজ্য
তারিখ১৯৫০ সালের ১৭ই-২০ই ফেব্রুয়ারি (ইউ.টি.সি +৬:০০)
লক্ষ্যবাঙালি হিন্দুখ্রিস্টান
হামলার ধরনগণহত্যা, হত্যাকাণ্ড
ব্যবহৃত অস্ত্রতলোয়ার, চাপাতি
নিহত১০০০+
হামলাকারী দলমুসলিম জনতা, আনসার, পুলিশ

ঘটনাপ্রবাহ সম্পাদনা

ঢাকা গনহত্যার সংবাদ বরিশাল জেলায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দাঙ্গা উত্তেজনা বাড়তে থাকে। জিন্নাহ ক্লাবে ১৪ই ফেব্রুয়ারি একটি শান্তি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মুসলিম নেতারা হিন্দু ও খ্রিস্টানদের সুরক্ষার আশ্বাস দেন। আশ্বাস সত্ত্বেও ১৫ই ফেব্রুয়ারি কাজীরচর ও কাশেরহাটে আক্রমণ করা হয়। ১৬ তারিখ রাতে সাতানি গ্রামে আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। একজন সচ্ছল হিন্দু মদন নন্দী ও তাঁর ভাইকে হত্যা করে। ডাক্তার প্রফুল্ল গায়েন ও ডাক্তার কল্লোল বন্দ্যোপাধ্যায়ও আক্রমণের শিকার হন। যখন হিন্দু গ্রামবাসীরা মুলাদি থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গ্রামবাসীদের মৃতদের দাহ করতে বলেন এবং তাদের পরিবারকে বলেন যে তারা রোগের কারণে মারা গেছে। ওসির অসংবেদনশীল ও নির্লিপ্ত মনোভাব গ্রামবাসীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চারণ ঘটায়।[১]

১৭ই ফেব্রুয়ারি সম্পাদনা

১৬ই ফেব্রুয়ারি রাত থেকে, আল্লাহ হো আকবরকাফেরদের হত্যা করুন চিৎকার দূর থেকে শোনা যায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৭ই ফেব্রুয়ারি সকালে, আতঙ্কিত হিন্দু ও খ্রিস্টানরা মুলাদী থানার দিকে ছুটতে শুরু করে। তবে ও.সি. আতঙ্কিত মানুষকে কোনো আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। বিকেল ৩ টার দিকে, ৩,০০০ জন থেকে ৪,০০০ জন শক্তিশালী জনতা মুলাদী বন্দরের গুদামগুলিতে হামলা ও লুটপাট করে। হিন্দু/খ্রিস্টানরা বিশৃঙ্খলভাবে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল এবং সশস্ত্র জনতা তাদের উপর আঘাত করেছিল। তারা পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করে এবং প্রকাশ্যে দিনের আলোতে মহিলাদের সন্মানহানি করে। লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে, এর পরে তারা লুট করা সম্পদ ও অপহৃত মহিলাদের নিয়ে চলে যায়। খ্রিস্টান গীর্জাগুলো ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। রাস্তাঘাট, ঘাট ও নদী ছিল মৃতদেহ দ্বারা পরিপূর্ণ। এক হিন্দুর সুপারি বাগানে ৩০০ টিরও বেশি মৃতদেহ পাওয়া যায়।[১]

১৮ই ফেব্রুয়ারি সম্পাদনা

১৮ই ফেব্রুয়ারি শনিবার সকালে, অনেক হিন্দু ও খ্রিস্টান তাদের লুট করা, ধ্বংস করা ও পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলিতে ফিরে আসে। সন্ধ্যায়, তারা আবার থানায় সমবেত হয়। এবার তাদের নগদ টাকা ও গহনার বদলে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। এরই মধ্যে আনসাররা মুলাদিতে লাউডস্পিকারে ঘোষণা করে হিন্দুদের মুলাদি থানায় জড়ো হতে বলে। হিন্দু ও খ্রিস্টানদের একত্রিত হওয়ার পর শত শত অমুসলিম পুরুষকে থানার প্রান্তে হত্যা করা হয়।[২] ও.সি. তিনি নিজেই হিন্দু মহিলাদের সিঁদুর ও শাঁখা (শঙ্খের চুড়ি) ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এবং তাদের কলমা পাঠ করতে বাধ্য করেছিলেন। পরে তিনি দলের নেতাদের মধ্যে মহিলাদের বিতরণ করেন।[১]

২০ই ফেব্রুয়ারি সম্পাদনা

মুলাদী ও আশেপাশের গ্রামগুলির বেঁচে থাকা লোকেরা গত দু'টি রাত আকাশের নীচে, জঙ্গলে ও অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া বাড়িতে কাটিয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে ঘোষণা করেন, যে বন্দর এলাকায় একটি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে।[৩] তিনি থানায় জড়ো হওয়া হিন্দুদের কাছ থেকে সমস্ত নগদ টাকা ও গহনা জব্দ করে তাদের বন্দরের দিকে নিয়ে যান। বন্দরে হিন্দুদের পঞ্চ তাহবিলের তিনটি গুদামে রাখার জন্য তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হয়েছিল, যার মধ্যে একটি গুদাম মাধবলাল কুন্ডু ও সুখময় কুণ্ডুর ছিল।

ওসির সংকেতে দুপুর ১২ টার দিকে ৩,০০০ জন শক্তিশালী সশস্ত্র মুসলিম জনতা গুদামে হামলা চালায়। ৭০০ জনেরও বেশি পুরুষ ও বয়স্ক মহিলাদের গণহত্যা করা হয়েছিল এবং তাদের মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। অবশিষ্ট মহিলাদের মুক্তেশ্বর সাহার একটি শেডে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কলমা পাঠ করতে বাধ্য করা হয়। এর পর দলের নেতাদের মধ্যে ৫০ জন মহিলাকে বিতরণ করা হয়।[১]

আঞ্চলিক প্রক্রিয়াকরণ নিয়ন্ত্রক সিরাজুল হক বিকালে বরিশাল থেকে সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে একটি লঞ্চের মাধ্যমে এসেছিলেন। তত সময়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। জীবিত পুরুষ ও অবশিষ্ট মহিলাদের বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Sinha, Dinesh Chandra, সম্পাদক (২০১২)। ১৯৫০: রক্তরঞ্জিত ঢাকা বরিশাল এবং [1950: Bloodstained Dhaka Barisal and.. more] (Bengali ভাষায়)। Kolkata: Codex। পৃষ্ঠা 43–45। 
  2. Kamra, A.J. (২০০০)। The Prolonged Partition and its Pogroms: Testimonies on Violence Against Hindus in East Bengal 1946-64। New Delhi: Voice of India। পৃষ্ঠা 63। আইএসবিএন 81-85990-63-8 
  3. Kundu, Ratan। "An Endless Tale"। Human Rights Congress for Bangladesh Minorities of Dallas/Fort Worth। ১৭ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ অক্টোবর ২০২১