মুগা
মুগা হচ্ছে Antheraea assamensis প্ৰজাতির পোকা থেকে সৃষ্টি করা একধরনের রেশম (silk)। মুগা পৃথিবীর মধ্যে কেবল অসমেই পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আসামের জলবায়ু মূগা পোকার জন্যে উপযোগী। সোম গাছ (Machilus bombycina) এবং য়য়ালো গাছের (Litsea polyantha) পাতা খাদ্য হিসেবে গ্ৰহণ করা মুগা পোকা স্বভাবে খুবই আলসে হয়। খুব বেশি তাপমাত্ৰার পরিবর্তন ও এরা সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া যেকোনো ধরনের দূষণেও মুগা পোকার জীবন চক্ৰে বাধার সৃষ্টি করেতে পারে।
ইতিহাস
সম্পাদনাঅসমে মুগা পোকার পালন প্ৰথম কোথা থেকে প্ৰচলন হয়েছিল বা কোথায় আরম্ভ করেছিল সেই কথা বলা কঠিন যদিও কৌতিল্যর 'অৰ্থশাস্ত্ৰ'তে মুগা বিষয়ে প্ৰথম উল্লেখ পাওয়া যায় (অৰ্থশাস্ত্ৰ, দ্বিতীয় গ্রন্থ, ১১তম অধ্যায়, ১০৪নং শ্লোক)। এটি ৩২১ খৃষ্টপূৰ্বের কথা। পরে সাময়িক স্মৃতিতে অসমের মুগার প্ৰচলন দেখা যায়, যা অতীত থেকে চলে আসতে দেখা যায়। আহোম যুগে মূগার প্ৰচলন অনেক বৃদ্ধি পায় যার ফলে মুগা সূতায় বোনা কিংখাপ, চোলা ইত্যাদি সেই সময়ের অহোম রাজ্যে এবং তাদের পরিবারবৰ্গের মধ্যে অনেক জনপ্ৰিয় ছিল। এবং সেই সময় থেকে আজ পৰ্যন্ত মুগা হচ্ছে অসমের অৰ্থনৈতিক সম্পদের মধ্যে সৰ্বোত্তম। ১৬৬২ সালে ফরাসি ভ্ৰমণকারী জিন জোসেফ টাভিৰ্নিয়ার (Jean Joseph Tavernier) সৰ্বপ্ৰথম মুগাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন। এরপর মুগার প্ৰথম সৰ্ববৃহত রপ্তানি হয় ১৭৯৩ সালে ইংল্যান্ডএ ব্ৰিটিশ ইষ্ট ইন্দিয়া কোম্পানিয়ে ২২৪ মণ (১ মণ = ৩৭.৩২৪ কেজি) মুগা সূতা স্বৰ্গীয় গৌরিনাথ সিংহের শাসন কালে রপ্তানি করে।
বাণিজ্য
সম্পাদনা১৭৯৩ সালে ২২৪ মণ মুগা সূতা দাম দেয়া হয়েছিল ৫৩,৮৯৯ টাকা। এর থেকেই মূগার মূল্য অনুমান করা যায়। বৰ্তমান সময়ে ১ কেজি মুগা সূতার বাজার দাম ৩২০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা পৰ্যন্ত হতে পারে। মূগার বাণিজ্যের সাথে জড়িত সকলের বাণিজ্যিক স্বাৰ্থ রাক্ষা করার লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ২০ জুলাই মূগাকে GI (Geographical Indication- ভৌগোলিক স্বীকৃতি) প্ৰদান করা হয়। এই GI চিহ্ন প্ৰদান করার পর মুগা থেকে বানানো যেকোনো বস্ত্ৰ-সামগ্ৰী ইত্যাদিতে বহন করতে পারে নিজ চিহ্ন যা প্ৰমাণ করে এর বিশুদ্ধতা। তাছাড়া মূগাকে যেকোনো ধরনের অনুমোদিত নকলের (Bio piracy) থেকেও সুরক্ষা প্ৰদান করে এই GI চিহ্ন। যেহেতু অসম বিশ্বের মধ্যে মূগা উৎপাদন করা একমাত্ৰ প্ৰান্ত সেকারণে মূগাকে GI দেয়ার জন্য মূগার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার সাথে, মুগার সৃষ্টি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অসমের একাধিপত্য প্ৰতিষ্ঠা করা যার দ্বারা সবাই উপকৃত হতে পারে।
বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মুগা থেকে অসমে ৪০ কোটি টাকা বাৰ্ষিক আয় হয় (মরোয়া বাজার তথ্য মতে)। অসমের প্ৰায় ২৩,৫৪৩টা পরিবার মুগা বয়নশিল্পের (২০০৪) সাথে জড়িত এবং ২০০১-২০০৩ সালে অসমে ৯২ মিলিয়ন টন মুগা পণ্য উৎপাদন করা হয় (Directorate of Sericulture, Government of Assam)। এছাড়া মুগা সূতা এবং কাপড়ের রপ্তানি থেকে অসমে বাৰ্ষিক ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকা উপাৰ্জন করা হয়।
উৎপাদন
সম্পাদনাউৎপাদনের দিক থেকে অসমের ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকাতে যোরহাট,শিবসাগর, ডিব্রুগড় এবং কামরুপ জেলাতে মুগার সৰ্বাধিক উৎপাদন হয়। এর ভিতর কামরুপ জেলার শুয়ালকুছি হচ্ছে বিশ্বের সৰ্ববৃহত রেশম উৎপাদনকারী গাঁ এবং মুগা উৎপাদনের ক্ষেত্ৰে এটি বিশ্বের সৰ্ববৃহত গাঁ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১১ শতকে রাজা ধৰ্মপালের নিৰ্দেশনায় ২৬ শিপিনী পরিবার নিয়ে প্ৰথম স্থাপন হয়েছিল শুয়ালকুছি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শুয়ালকুছির বাসিন্দারা নিজেরা এই বস্ত্ৰশিল্পের সাথে এবং গাঁয়ের ৫০,০০০ জনগণের প্ৰায় ২৫,০০০ জন ব্যক্তি এই বয়নশিল্পের সাথে জড়িত। সেজন্যে শুয়ালকুছিকে পূর্বের মানচেষ্টার আখ্যা দেয়া হয়েছে।
আসামের সমাজে মুগা
সম্পাদনাসুন্দর সোনালী বর্ণ এবং স্থায়িত্বের জন্যে মুগা জনসাধারণের কাছে জনপ্ৰিয়। মুগা কাপড়ের আয়ু প্ৰায় ৫০ বছর বা তাতোধিক হতে পারে। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য (যেমন সালফিউরিক এসিড) মূগার ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু যেহেতু মুগা সূতার উৎপাদনের জন্যে অত্যধিক মাত্ৰায় মুগা রেশমের প্ৰয়োজন সেজন্যে মূগার দাম বৰ্তমান বাজারে অনেক বেশি। কিন্তু তথাপিও মূগার চাহিদা বাজারে হ্ৰাস পায় নাই, বরঞ্চ বেড়েছে। বিশেষ করে অসমীয়া কলা-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মূগাই অতি সাধারন থেকে অসমীয়া সমাজে সমাদর পেয়েছে। প্ৰতি অসমীয়া যুবক-যুবতীর কাছে মুগার সাজে সাঁজা গৌরবের কথা।যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে মুগা কাপড় পরিধান সৌন্দৰ্যত বৃদ্ধি করে এবং তাদের জাকজমক করে তোলে। এবং বৰ্তমান ফ্যাশনের যুগে মুগা সূতার প্ৰয়োগ কেবল মেখেলা-চাদর বা চোলা বোয়াতে সীমিত না থেকে শাড়ী, চুরিদার, বিছানাচাদর, পৰ্দা ইত্যাদি নানা ধরনের সামগ্ৰী উৎপাদনের জন্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফ্যাশনের উইলসে (Wills lifestyle, Lakme Fashion Week, London Fashion Week) মুগায় তৈরি নানা বস্ত্ৰ রাইজর মধ্যে বহু সমাদর লাভ করেছে। কিন্তু এসবের পরও অসমে মুগার ব্যবসায়ের যেমন বিকাশ হওয়ার কথা ছিল সে রকম হয় নাই।মুগা ব্যবসায় এখনও কুটিরশিল্পের মতোই চলে আসছে কিন্তু মুগা ব্যবসায়ক এক অতি উচ্চ পৰ্যায়ের বাণিজ্যিক স্বীকৃতি দেয়ার প্ৰয়োজন। ছোট ছোট নিজস্ব ব্যবসার বা আত্মসহায়ক গোষ্ঠী দ্বারা মুগা উৎপাদিত হওয়ার বিপরীতে যদি এই মুগা ব্যবসায়ীরা সবাই এক জোট হয়ে সরকারী সাহায্য যেমন আধুনিক মিল, সূতা কাটা যন্ত্ৰ, মুগা পোকা পালন কেন্দ্ৰ, যন্ত্ৰ চালিত তাঁত (power loom), ইত্যাদি প্ৰদান করা হয়, তবে মুগা উৎপাদন বৰ্তমান থেকে বহুগুণ বেশি বৃদ্ধি করা যেত। বৰ্তমানে মুগার যা বাণিজ্যিক সম্ভাবনা আছে তাকে যেন সঠিক ভাবে অসমে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাছাড়া কম দামের তসর রেশম এবং চীন দেশের কৃত্ৰিম রেশমে অসমের মুগাকে অন্তরাষ্ট্ৰীয় বাজারে কিছু পরিমাণে প্ৰতিযোগিতা করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। এছাড়া বৰ্ধিত দূষণেও মুগা পোকার জীবন চক্ৰে কিছু বাধার সৃষ্টি করে মুগা উৎপাদনে কিছু বিঘ্নের সৃষ্টি করছে। [১][২]
তথ্য সূত্ৰ
সম্পাদনা- ↑ দেৱযানী বড়া,মুগা - অসমৰ এক সোণালী সম্পদ, বৰ্হমথুৰি (এন আই টি শিলচৰৰ বসন্ত আলোচনী) https://docs.google.com/file/d/0B4ZC6NF4m4DvRnZYaEZ6NlNaTlE/edit[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ KisHor Goswami,Impact of Globalisation on Silk Industry in Northeast India: an Assesment from Gender Perspectives, https://www.google.co.in/search?q=KisHor+Goswami%2CImpact+of+Globalisation+on+Silk+Industry+in+Northeast+India%3A+an+Assesment+from+Gender+Perspectives&oq=KisHor+Goswami%2CImpact+of+Globalisation+on+Silk+Industry+in+Northeast+India%3A+an+Assesment+from+Gender+Perspectives&aqs=chrome..69i57.1171j0j1&sourceid=chrome&es_sm=122&ie=UTF-8 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে