মাহমুদ পাশা

উসমানীয় সাম্রাজ্যের ১৩তম উজিরে আজম (১৪৫৬–১৪৬৬, ১৪৭২–১৪৭৪)

মাহমুদ পাশা (সার্বীয়: Махмуд-паша Анђеловић/Mahmud-paša Anđelović; তুর্কি: Veli Mahmud Paşa; ১৪২০–১৪৭৪) ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের একজন উজিরে আজম। তিনি ১৪৫৬ থেকে ১৪৬৬ এবং ১৪৭২ থেকে ১৪৭৪ সাল পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্যের উজিরে আজম ছিলেন।[]

মাহমুদ
উসমানীয় সাম্রাজ্যের ১৩তম উজিরে আজম
কাজের মেয়াদ
১৪৭২ – ১৪৭৪
সার্বভৌম শাসকমুহাম্মাদ ফাতিহ
পূর্বসূরীইসহাক পাশা
উত্তরসূরীগেদিক আহমেদ পাশা
কাজের মেয়াদ
১৪৫৬ – ১৪৬৬
সার্বভৌম শাসকমুহাম্মাদ ফাতিহ
পূর্বসূরীজাগানোস পাশা
উত্তরসূরীরুম মুহাম্মাদ পাশা
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম১৪২০
নভো ব্রডো, সার্বীয় স্বৈরশাসক
(বর্তমানে কসোভো)
মৃত্যু১৪৭৪ (বয়স ৫৩–৫৪)
জাতীয়তাউসমানীয়
দাম্পত্য সঙ্গীসেলজুক হাতুন
সন্তানআলী বে
হেতিজা হাতুন
সামরিক পরিষেবা
ডাকনামআদনি
আনুগত্যউসমানীয় সাম্রাজ্য
শাখাউসমানীয় নৌবাহিনী
পদকাপুদান পাশা (প্রধান অ্যাডমিরাল)
যুদ্ধ

তিনি সার্বিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অ্যাঞ্জেলোস পরিবারের বংশধর ছিলেন। ইতিহাসবিদের মতে, উসমানীয়রা তাকে শৈশবে দেবশিরমে নিয়োগ করেছিল।[] তিনি একজন দক্ষ সৈনিক ছিলেন এবং এদির্নে বড় হয়েছিলেন। তিনি জাগানোস পাশার এক কন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ১৪৫৬ সালে বেলগ্রেড অবরোধের পর তার শ্বশুর জাগানোস পাশার স্থলাভিষিক্ত হয়ে তিনি উজিরে আজম হয়েছিলেন।

উৎপত্তি ও প্রারম্ভিক জীবন

সম্পাদনা

১৩৯৪ সালে উসমানীয়দের থেসালি বিজয়ের পর ক্ষমতাসীন অ্যাঞ্জেলোস[][] ফিলানথ্রোপেনোস পরিবারে আশ্রয় নেয়। অ্যালেক্সিওস অ্যাঞ্জেলোস ফিলানথ্রোপেনোস বা ম্যানুয়েল অ্যাঞ্জেলোস ফিলানথ্রোপেনোস এর নাতি-নাতনিরা ছিলেন মাহমুদ পাশা এবং তার ভাই মাইকেল অ্যাঞ্জেলোভিচ

ধারণা করা হয়, মাহমুদের জন্ম ১৪২০-এর দশকের প্রথম দিকে।[] বেশিরভাগ ঐতিহাসিক স্বীকার করেন যে, মাহমুদ সার্বীয় স্বৈরশাসকের নোভো ব্রডোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর পিতা ছিলেন মিহাইলোস।[] তার পিতা সম্পর্কে একমাত্র তথ্য হলো, তিনি ১৪২০ এর দশকে সার্বিয়ায় থাকতেন।[] তাঁর মায়ের বংশপরিচয় বিতর্কিত। মাহমুদের এক ভাই ছিল মাইকেল অ্যাঞ্জেলোভিচ। তিনি তুর্কি বিজয়ের পরে একজন বিশিষ্ট সার্বীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন।[][]

তাহসিন ইয়াজিসির মতে, মাহমুদ "একটি গ্রীক বা সার্বীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন"।[] দেজান জোকিচ বলেন যে, মাহমুদ "একজন সার্বীয় মা এবং একজন গ্রীক শরণার্থী পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন"।[১০]

চালকোকোন্ডাইলস উল্লেখ করেছেন যে, মাহমুদ তার মায়ের সাথে নোভো ব্রডো থেকে স্মেদেরেভো (সার্বিয়ার রাজধানী) যাওয়ার পথে উসমানীয় ঘোড়সওয়ারদের হাতে ধরা পড়েন এবং উসমানীয় দরবারে নিয়ে যান।[১১] আরও ধারণা করা হয় যে, ১৪২৭ সালে উসমানীয়রা সার্বিয়া আক্রমণ করলে ঘটনাটি ঘটেছিল।[১২] ইসলাম গ্রহণের পর তার নাম মাহমুদ দেওয়া হয়।

১৪৫৩ সালের আগে তার কার্যক্রম সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। টি. স্টাভ্রিডসের মতে, মাহমুদ এবং তার সঙ্গীরা প্রাসাদে শিক্ষিত হয়েছিলেন এবং পরে মুহাম্মাদ ফাতিহের সেবা করেছিলেন।[১৩] তিনি প্রাসাদে কোন পদে ছিলেন তা নিয়ে বিতর্কিত রয়েছে।[১৪]

 
গোলুবাক দুর্গের শহরে মাহমুদ পাশার দেহাবশেষ।

মাহমুদ পাশা একজন দক্ষ সৈনিক ছিলেন। ১৪৫৬ সালে বেলগ্রেড অবরোধে পর তিনি জাগানোস পাশার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পুরস্কার হিসাবে উজিরে আজম পদে উন্নীত হন।[১৫] এরপর থেকে তিনি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং মুহাম্মাদ ফাতিহের সাথে বিভিন্ন অভিযানে গিয়েছিলেন।[১৬]

১৪৫৮ সালে সার্বিয়ান স্বৈরশাসক লাজার ব্র্যাঙ্কোভিচ মারা যান। মাহমুদের ভাই মিহাইলো একটি যৌথ রাজত্বের সদস্য হয়েছিলেন কিন্তু সার্বীয় আদালতে উসমানীয় বিরোধী এবং হাঙ্গেরিয়ানপন্থী দল তাকে পদচ্যুত করেছিল। এর ফলে মাহমুদ তার ভাইয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাদের উপর আক্রমণ করে এবং দখল করে স্মেদেরেভো দুর্গ। যদিও দুর্গটি ভালোভাবে দখল করতে পারে নি এবং এর আশেপাশে কিছু অতিরিক্ত দুর্গ দখল করেছিল। সম্ভবত হাঙ্গেরীয় হস্তক্ষেপের হুমকির মুখে তিনি দক্ষিণে সরে যেতে এবং স্কপিয়েতে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহের বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হন।[১৭] ১৪৬১ সালে তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের টিকে থাকা অংশ ট্রেবিজন্ড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে মুহাম্মাদ ফাতিহের সাথে ছিলেন। মাহমুদ প্রোটোভেস্টিয়ারিওসের সাথে ট্রেবিজন্ড শহরের আত্মসমর্পণের বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং তার সাথে পণ্ডিত জর্জ আমিরুটজেস ছিলেন। জর্জ আমিরুটজেস মাহমুদের চাচাতো ভাই ছিলেন।[১৮]

১৪৬৩ সালে মাহমুদ বসনিয়া রাজ্য আক্রমণ ও বিজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যদিও বসনিয়া ও উসমানীয়দের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি সবেমাত্র পুনর্নবীকরণ করা হয়েছিল। তিনি বসনিয়ার রাজা স্টিফেন তোমাসেভিচকে বন্দী করেন এবং তার কাছ থেকে সাম্রাজ্যের কাছে দেশের হস্তান্তর লাভ করেন।[১৭]

১৪৬৭ সালের গ্রীষ্মে মুহাম্মাদ ফাতিহ যখন আলবেনিয়া ভেনেটা আক্রমণ করেন এবং ভূমি ধ্বংস করেন তখন মাহমুদ তার সাথে ছিলেন। ১৫ দিন ধরে তিনি সেকেন্দার বেগকে তাড়া করেছিলেন। সেকেন্দার বেগ সেই সময় ভেনিসের মিত্র ছিলেন কিন্তু তাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। কারণ সেকেন্দার বেগ পাহাড়ে পিছু হটে এবং তারপরে উপকূলে পালিয়ে যায়।[১৯] তুরসুন বেগ এবং ইবনে কামালের মতে, মাহমুদ বুনা সাগরের উপর দিয়ে গিয়ে ভেনিসীয়-নিয়ন্ত্রিত শকোডার আক্রমণ করেছিলেন এবং আশেপাশের অঞ্চল লুণ্ঠন করেছিলেন।[২০]

তার উত্তরসূরি রুম মুহাম্মাদ পাশার ষড়যন্ত্রের কারণে ১৪৬৮ সালে মাহমুদকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।[২১] ১৪৭২ সালে তাকে পুনর্বহাল করা হয় কিন্তু সুলতানের সাথে তার সম্পর্ক তখন তিক্ত হয়ে পড়ে। ১৪৭৪ সালে মাহমুদকে বরখাস্ত করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কারণ ছিল সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহের প্রিয় পুত্র শাহজাদা মুস্তাফার আকস্মিক মৃত্যুর সাথে তিনি জড়িত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। কথিত আছে যে, শাহজাদা মুস্তাফার সাথে মাহমুদের স্ত্রী সেলজুক হাতুনের (মুহাম্মাদ ফাতিহের কনিষ্ঠ স্ত্রী হেতিজা হাতুনের বোন) সাথে সম্পর্ক ছিল এবং এর জন্য মাহমুদ তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। মাহমুদ তা অস্বীকার করলেও প্রমাণ ছাড়াই মুহাম্মাদ ফাতিহ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[২২]

সাহিত্য

সম্পাদনা

মাহমুদ পাশা ফার্সিতুর্কি ভাষায় লেখতেন এবং তার ছদ্মনাম ছিল "আদনি"।[] তিনি যে দিওয়ানটি রচনা করেছিলেন তাতে ফার্সি ভাষায় ৪৫টি গজল এবং ২১টি মোফরাদ রয়েছে। পাশাপাশি জহিরুদ্দিন ফারিয়াবী এবং হাফেজের গজলের কিছু নাজিরা রয়েছে।[] তাহসিন ইয়াজিসি বলেন যে, মাহমুদ পাশা "ফার্সি ভাষায়ও বেশ কয়েকটি সরকারী চিঠি লিখেছিলেন"।[]

পরিবার

সম্পাদনা

তার প্রথম স্ত্রী ছিল সেলজুক হাতুন। যিনি সিত্তি নেফিসে হাতুন ও জাগানোস পাশার কন্যা ছিলেন। তাদের আলী বে নামে একটি ছেলে এবং হেতিজা হাতুন নামে একটি মেয়ে ছিল। তার স্ত্রী সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহের পুত্র শাহজাদা মুস্তাফার প্রেমিকা ছিলেন। এ কারণে মুস্তাফার মৃত্যুর সঙ্গে মাহমুদের জড়িত থাকার সন্দেহ করা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Stavrides 2001, পৃ. 311।
  2. H. Erdem Cipa; Emine Fetvaci, সম্পাদকগণ (২০১৩)। Writing History at the Ottoman Court: Editing the Past, Fashioning the Future। Indiana University Press। পৃষ্ঠা 68আইএসবিএন 9780253008749 
  3. Stavrides 2001, পৃ. 311 "Mahmud Pasha's Pseudonym – According to all indications, the pseudonym (mahlas) used by Mahmud Pasha when writing poetry was Adni (the Eden-like) and this is indicated by most sources, most particularly Asik Celebi and Sehi Beg, who ..."
  4. Babinger 1992, পৃ. 476 "With the possible exception of the grand vizier Mahmud Pasha, who under the pseudonym of Adni wrote Persian and Ottoman Turkish rhymes, the period offers no further poets of above-average quality. Among the poets it seems fitting to mention as ..."
  5. Stavrides 2001, পৃ. 77।
  6. Stavrides 2001, পৃ. 73–74, 76–77।
  7. Stavrides 2001, পৃ. 78–93।
  8. Stavrides 2001, পৃ. 93–100।
  9. Yazici 1983, পৃ. 470।
  10. Djokić, Dejan (২০২৩)। A Concise History of Serbia (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 158। আইএসবিএন 978-1-107-02838-8 
  11. Stavrides 2001, পৃ. 107।
  12. Stavrides 2001, পৃ. 108।
  13. Stavrides 2001, পৃ. 110।
  14. Stavrides 2001, পৃ. 111–112।
  15. Finkel 2006, পৃ. 78
  16. Finkel 2006, পৃ. 78–79, 559, 560।
  17. Finkel 2006, পৃ. 60।
  18. Finkel 2006, পৃ. 62
  19. Stavrides 2001, পৃ. 163, 164।
  20. Stavrides 2001, পৃ. 164।
  21. Finkel 2006, পৃ. 78–79।
  22. Finkel 2006, পৃ. 79
  • Finkel, Caroline (২০০৬)। Osman's Dream: The Story of the Ottoman Empire 1300–1923। London: John Murray। আইএসবিএন 978-0-7195-6112-2 
  • Stavrides, Théoharis (২০০১)। The Sultan of Vezirs: The Life and Times of the Ottoman Grand Vezir Mahmud Pasha Angelovic (1453–1474)। Brill। আইএসবিএন 978-90-04-12106-5 
  • Tekindağ, Şehabeddin (২০০৩)। "Mahmud Paşa" (পিডিএফ)İslâm Ansiklopedisi, Vol. 27 (Kütahya Mevlevihânesi – Manisa) (তুর্কি ভাষায়)। পৃষ্ঠা 376–378। 
  • Yazici, T. (১৯৮৩)। "ʿADNĪ, MAḤMŪD PĀŠĀ"Yarshater, EhsanEncyclopædia Iranica, Volume I/5: Adat–Afghanistan। London and New York: Routledge & Kegan Paul। পৃষ্ঠা 470। আইএসবিএন 978-0-71009-094-2 
রাজনৈতিক দপ্তর
পূর্বসূরী
জাগানোস পাশা
উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধান উজির
১৪৫৬–১৪৬৬
উত্তরসূরী
রুম মুহাম্মাদ পাশা
পূর্বসূরী
ইসহাক পাশা
উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধান উজির
১৪৭২–১৪৭৪
উত্তরসূরী
গেদিক আহমেদ পাশা