মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ড
মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ড ২০১৬ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সংঘটিত একটি বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ড।[১][২] এটি ২০১৬ সালের ৫ই জুন একজন বাংলাদেশ পুলিশের সুপারিন্টেনডেন্ট বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু তার অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে চট্টগ্রামের ব্যস্ত রাস্তায় তিন সন্দেহভাজন দ্বারা ছুরিকাঘাত প্রাপ্ত হন এবং শরীরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি খুন হওয়ার সময় তার ছয় বছরে ছেলে তার সাথে সেখানে উপস্থিত ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার, মামলা ও তদন্ত আদালতে চলমান।[৩] যদিও তিনি সেকুলার বা নাস্তিক ছিলেন না, তারপরও প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হয়েছিল তিনি জঙ্গি সম্প্রদায় দ্বারা হত্যার শিকার হতে পারে।[৪] কারণ তার স্বামী বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে জঙ্গী দমনে জড়িত ছিলেন এবং তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কারও পেয়েছিলেন।[৫][৬][৭] যাইহোক, এই খুনের দায় ভারতীয় আল কায়েদার উপশাখা আনসার-আল-ইসলাম স্বীকার করেছে।[৮] তবে ২০১৭ সালে মিতুর পিতা মুহম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন যে, অবস্থাগত প্রমাণ (এটি চূড়ান্ত প্রমান নয়[ক]) থেকে তার মনে এখন এটাই হচ্ছে যে, যে বাবুল আক্তার নিজেই তার স্ত্রীকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করিয়েছেন।[৯][১০] এই অভিযোগ করার সাথে সাথে আরো একটা বিষয়কে জড়ানো হয়, স্পেশাল ব্রাঞ্চের উপ-পুলিশ অফিসার আকরাম হুসেইন লিটনের স্ত্রী বনানী বিনতে বন্নীর সাথে বাবুল আক্তারের সম্পর্ক ছিল।[৯]
বাবুল পুলিশের দ্বারা সময়ে সময়ে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদের স্বীকার হন।[৮] ২০১৭ এর ফেব্রুয়ারি থেকে পুলিশ তালিকাভুক্ত অপরাধী কামরুল ইসলাম মুসাকে খুজছে। অভিযুক্ত মুসা বাবুল আক্তার এবং তার সঙ্গী নবির ইনফর্মার ছিল।[৯] যদিও কামরুল ইসলাম মুসার দাবী করেছে, এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই পুলিশ-পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।[১১]
প্রেক্ষাপট
সম্পাদনা২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। ওই সময় মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার কর্মক্ষেত্রে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, তার জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতে পারেন।[১২]
এই মামলার দুইজন আসামি রাশেদ ও নবী পুলিশের হাতে আটক ছিল। পুলিশি হেফাজতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছিলো। ২০১৬ সালের ৫ জুলাইয়ে এই দুইজনকে নিয়ে অন্যান্য আসামিদের ধরতে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়কের ঠাণ্ডাছড়ি নামক এলাকায় গেলে সেখানে বন্দুকযুদ্ধ হয় এবং অভিযুক্ত দুইজন মৃত্যবরন করেন। তবে এই বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে গণমাধ্যম সন্দেহ প্রকাশ করেছে।[১৩]
অভিযুক্ত বাবুল আক্তার
সম্পাদনাএই হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পর ২৪ জুন ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ বাবুল আক্তারকে ১৫ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে ২ মাস পরে পুলিশ থেকে জানানো হয় বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।[১৪] কিন্তু বাবুল দাবি করেন তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি, এমনকি তার এই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এই আবেদন গ্রহণ করেননি।[১২] বাবুল আক্তার পুলিশের চাকরি ছেড়ে প্রথমে আদ–দ্বীন হাসপাতালে যোগ দেন। পরবর্তীতে চীন থেকে পানি পরিশোধনকারী যন্ত্র এনে বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন।এরপরে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি দেখা যায়নি।[১২]
তদন্ত
সম্পাদনাবাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন ও শাশুড়ি সাহেদা মোশাররফ অব্যাহতভাবে হত্যাকাণ্ডের জন্য বাবুল আক্তারকে দায়ী করে থাকেন। তবে পুলিশের তরফ থেকে কখনোই এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। বাদীর দিক থেকেও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে কোনো তাগাদা ছিল না। শুরু থেকে চট্টগ্রামের ডিবি পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে। তারা প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালত মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইকে দেয়।
সমালোচনা
সম্পাদনাবাংলাদেশের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইন গত ৩ সেপ্টেম্বর ‘স্ত্রী খুন, স্বামী জেলে, খুনি পেয়েছেন তদন্তের দায়িত্ব’ শিরোনামে একটি ভিডিও কনটেন্ট ইউটিউবে প্রকাশ করেন, যেখানে মিতু হত্যা, বাংলাদেশ পুলিশ, পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার ও সাম্প্রদায়িক ইস্যুসহ বেশ কিছু বিষয় দেখানো হয়। বনোজ কুমার ভিডিওটিকে আপত্তিকর এবং অসত্য দাবি করে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন এবং মামলার আবেদনে ভিডিওতে উপস্থাপিত তথ্যগুলোর প্রতিউত্তর হিসেবে তার বক্তব্য 'যুক্তি খণ্ডন' হিসেবে প্রদান করেন।[১৫]
আরও দেখুন
সম্পাদনাটীকা
সম্পাদনা- ↑ অবস্থাগত প্রমান (ইংরেজি: Circumstantial evidence) হলো প্রামাণিকের এমন একটা অবস্থা, যেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে না, তবে বেশ কয়েকটি খণ্ড খণ্ড সূত্র থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "চট্টগ্রামে এসপির স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা"। বিবিসি বাংলা। ২০১৬-০৬-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১১।
- ↑ "পুলিশের স্ত্রী হত্যা- অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই"। বিবিসি বাংলা। ২০১৬-০৬-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১১।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "পিবিআইয়ের প্রধানসহ ৬ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন বাবুলের"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১১।
- ↑ "এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যা: কেন এই হামলা?"। বিবিসি বাংলা। ২০১৬-০৬-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১১।
- ↑ "Top Bangladesh policeman's wife killed"। BBC News। ৫ জুন ২০১৬।
- ↑ "Bangladeshi Christian hacked to death"। The Hindu। ২০১৬-০৬-০৫। আইএসএসএন 0971-751X। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৬-০৭।
- ↑ "Cop courageous"। দ্য ডেইলি স্টার। ২০১৬-০৬-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৬-০৭।
- ↑ ক খ "SP Babul Akter freed after 'interrogation'"। দ্য ডেইলি স্টার। ১৫ জুন ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
- ↑ ক খ গ Rabbi, Arifur Rahman (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। "Mitu's father suspects Babul"। ঢাকা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
- ↑ "মিতু হত্যায় সন্দেহের স্পটলাইট যে কারণে স্বামী বাবুল আক্তারের দিকে"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১১।
- ↑ "চট্টগ্রামে 'মুসা'তেই আটকে আছে এসপি বাবুলের স্ত্রী হত্যার রহস্য"। দৈনিক ইত্তেফাক। ২৯ অক্টোবর ২০১৬। ১৩ মে ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মে ২০১৮।
- ↑ ক খ গ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "মিতু হত্যায় বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০২১।
- ↑ "বাংলাদেশে পুলিশের স্ত্রী হত্যার দুই আসামী 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত"। বিবিসি বাংলা। ২০১৬-০৭-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১১।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "বাবুলের চিকিৎসার বিষয়ে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১৩।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "ইলিয়াস হোসাইনের ভিডিও: মামলার এজাহারে যা বলেছেন বনজ কুমার"। Bangla Tribune। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২। ৫ অক্টোবর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০২২।