মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল ট্রাজেডি

দিনাজপুরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দূর্ঘটনা

বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রাণপণ প্রচেষ্টায় এবং ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের চির আকাঙ্খিত বিজয় অর্জিত হয়। ঐতিহাসিক সেই দিনে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সময় বিকেল ৪ টায় রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন নব্বই হাজারেরও বেশি সেনা সদস্য নিয়ে পূর্বাঞ্চলের সেনানায়ক জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন ভারতের লেফটেনেন্ট জেনারেল জগজিত সিং অরোরা এবং পাকবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজি। এরপর আনন্দে আত্মহারা হয় সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ।

মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল ট্রাজেডি
স্মৃতিফলকে মাইন বিস্ফোরণে নিহত ও আহত যুদ্ধজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের নামের তালিকা।
তারিখ৬ জানুয়ারি ১৯৭২ (1972-01-06)
সময়আনুমা‌নিক বিকাল ০৪:৩০
অবস্থানমহারাজা গিরিজানাথ স্কুল, দিনাজপুর
কারণমাইন বিস্ফোরণ
মৃত৫০০ - ৬০০ (সরাসরি)

পটভূমি সম্পাদনা

বিজয় দিবসের ঠিক ২১ দিন পর দিনাজপুর শহরে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনা। সেটি হচ্ছে মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল ট্রাজেডি। বিজয় দিবসের পর দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওপঞ্চগড়ের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পুতে রাখা, ফেলে রাখা এবং ছেড়ে যাওয়া মাইন, বোমা, এন্টি ট্যাংক মাইন, এন্টি পারসোনাল মাইন, জ্যাম্পিং মানি, মর্টারের দুই-তিন ইঞ্চি শেল, গ্রেনেড প্রভৃতি সংগ্রহ কর ছিল এই ক্যাম্পের অন্যতম প্রধান কাজ। এই ক্যাম্পের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন লে. ক. শাহরিয়ার (বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত)।

দূর্ঘটনা সম্পাদনা

অদ্যাবধি সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বিভিন্ন সুত্রে এবং বেঁচে যাওয়া কিছু মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দি থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে জানা যায় যে, ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি গোলাবারুদ ও মাইন ভর্তি দুটি ট্রাক (কারো মতে তিনটি ট্রাক) মহারাজা স্কুলের মাঠে প্রবেশ করে।[১] ট্রাক থেকে অস্ত্র খালাসের কাজ শুরু হয় বিকাল ৪ টায়। বাংকার থেকে ট্রাকের দুরত্ব ছিল ১০০ গজ। কমান্ডারের বাঁশির শব্দে কিছু মুক্তিযোদ্ধা ট্রাক থেকে অস্ত্র নামানোর কাজ শুরু করেন। তারা হাত বদলের মাধ্যমে ঐ ১০০ গজ দূরত্বের বাংকারে মাইনসহ অন্যান্য অস্ত্রগুলি পৌঁছাতে থাকেন। এই হাতবদলের সময় জনৈক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়ে যায়। সাথে সাথে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। তার সাথে বাংকারটি বিস্ফোরিত হয়ে যায়। সাথে সাথে মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল ভবনটি যেন আকাশে উড়ে যায়। স্কুলটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে সেখানকার মাটি পর্যন্ত উড়ে গিয়ে প্রকান্ড এক পুকুরের সৃষ্টি হয় এবং ভেতরে থেকে পানি বের হতে থাকে। বিস্ফোরণের শব্দে দিনাজপুরের মাটি কেঁপে ওঠে। চতুর্দিক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। প্রায় একশত মাইল দুর থেকেও এই শব্দ শোনা গিয়েছিল।

হতাহত ও উদ্ধার তৎপরতা সম্পাদনা

দূর্ঘটনার পরপরই দিনাজপুর শহরের হিতৈষী জনগণ উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী উদ্ধার কাজে যোগ দেন। অন্ধকার ক্রমান্বয়ে ঘনিয়ে আসে। কোনদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তদুপরি বিষাক্ত গ্যাস আর ধোঁয়ায় পরিবেশ যেন নরককুন্ডে পরিণত হয়েছিল। আহত-অর্ধমৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আর্তনাদ, মুমূর্ষদের চিৎকার আর কান্নাকাটিতে মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল প্রাঙ্গণ যেন মুহুর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ স্কুল বিল্ডিং এর ইট আর লোহা লক্করের সাথে মিশে উড়ে গিয়েছিল পশ্চিম আর উত্তর দক্ষিণে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে আর পূর্ব দিকে সুবিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত, ঝাড়, জঙ্গল, ডোবা-নালা, পুকুর আর খাল বিলে। ২৬ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত সেই স্কুলের মাঠে সেদিন রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। নতুন সৃষ্ট পুকুরটি রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। খন্ড খন্ড দেহাংশ, দলা দলা মাংস, কোথাও মাথা, কোথাও দেহ, কোথাও হাত, পা অন্ধকারে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল।

ঘটনার দিন সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের রোল কল করা হয়েছিল। তখন সর্বোমোট ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। এরপর অনেকেই ২/১ দিনের ছুটি নিয়ে বাবা-মা-স্ত্রী-পুত্রের সাথে দেখা করার জন্য চলে যান। আর কেউ কেউ শহরে ঘুরতে চলে যান। তাই দুর্ঘটনার সময় কতজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব ছিল না। ধারণা করা হয় আনুমানিক ৫০০ থেকে ৬০০ মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। ঘন অন্ধকারে গাড়ীর লাইট জ্বালিয়ে, টর্চ লাইট, হ্যাচাক লাইট ও লন্ঠনের আলোয় রাতভর উদ্ধার কাজে সেদিন শহর ও গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

পরদিন প্রথমে ৮৬ জনের লাশ,পরে আরো ২১ জনের লাশ দিনাজপুর শহরের উত্তরে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। লাশগুলোর অধিকাংশই ছিন্ন ভিন্ন ছিল। কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা জোড়া লাগিয়ে এক একটি লাশের আদল দেওয়া হয়েছিল। কোন যাচাই বাছাই করা মোটেই সম্ভব ছিল না। তাই হয়তো কোনো লাশের দুটা হাতই ছিল ডান হাত অথবা দুটা পা ছিল বাম পা। একজনের মাথা আর একজনের শরীরে লাগিয়ে লাশের আকৃতি করা হয়েছিল। হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের আর্তনাদে বাতাস সেদিন ভারি হয়ে গিয়েছিল। সব লাশকেই যে মস্তক বা হাত-পা দেওয়া হয়েছিল হয়তো সেটাও নয়। মহারাজা স্কুল মাঠ থেকে প্রায় ৫০ মণ দলা দলা মাংস উদ্ধার করা হয়েছিল। শহরের দালানের ছাদ, রাস্তা-ঘাট, ধান ক্ষেত, ডোবা-নালা থেকে লাশের খন্ডিত অংশ সংগ্রহ করতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিল। এতে করে দেহের বিভিন্ন অংশে পচন ধরায় দুর্গন্ধে আকাশ বাতাসসহ পরিবেশ ভীষণভাবে দূষিত ও ভারি হয়ে গিয়েছিল।

দূর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনের স্মৃতিকথা সম্পাদনা

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারীর সেই দূর্ঘটনায় আহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ (পিতা- মাহাতাব উদ্দীন,গ্রাম- বলঞ্চা,থানা- রাণীশংকৈল,জেলা- ঠাকুরগাঁও) স্মৃতি চারণ করে লিখেছেন,“১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করি রাণীশংকৈল থানার নেকমরদে। এখান থেকে দিনাজপুরে একত্র হওয়ার নির্দেশ পেয়ে আমরা ১৫ সদস্যের একটি গ্রুপ ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুর মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে গিয়ে হাজির হই এবং ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার এর কাছে আমাদের হাতিয়ার জমা দিয়ে অবস্থান গ্রহণ করি। স্কুলের মাঝের কক্ষটিতে আমরা বিছানা করে নেই। আমাদের গ্রুপের কারো থালা বাসন ছিল না। অন্যের থালায় খাবার খেয়ে যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ি। কয়েকদিন আগে থেকেই আমার জ্বর এবং শরীর ও মাথা ব্যথা ছিল। সুতরাং খাওয়ার পর বাইরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা হলো না। ৬ জানুয়ারী আমি ও সিরেন চন্দ্র মধ্যাহ্নভোজনের পর বিছানায় বসে বসে নিজেদের বাড়ির গল্প করছিলাম। ৫ জানুয়ারী বুধবার আমার সাথী ও প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল, বিরেন্দ্রনাথ ও আমার এক চাচা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। আমিও ছুটি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার ছুটি মঞ্জুর হয় নি। আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে সিরেন চন্দ্রের সঙ্গে এক বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। বিকেল ৫ টার দিকে সৈয়দপুর থেকে মাইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য বোঝাই দুটি ট্রাক আসে। সবাইকে সেগুলো নামানোর কাজে অংশ নেয়ার জন্য হুইসেল দেয়া হয়। আমি অসুস্থতার কারণে বের না হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার পাশে সিরেন চন্দ্রও শুয়ে পড়ে। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ট্রাক থেকে মাইন নামানো শুরু হলো। ছোট ছোট বিস্ফোরকগুলো আমাদের পাশের রুমে এবং বড় ধরনের মাইনগুলো এক গর্তে রাখা হচ্ছিল। পাশেই একটি মসজিদে আযান শুরু হলো। আযান শেষ না হতেই হঠাৎ একটা বিদ্যুতের চমক এবং প্রকম্পিত বিকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপরে কী হলো আমি আর কিছুই বলতে পারি না। পরের দিন সকাল ৯টায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম সদর হাসপাতালের বিছানায়। জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালে আরো অনেককে দেখতে পেলাম বেহাল অবস্থায়। জানতে পারলাম যে,আমার সাথী সিরেন বেঁচে নেই।”

পরবর্তী ঘটনা সম্পাদনা

দিনাজপুরের সাবেক সাংসদ এম আব্দুর রহিম, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আখতার এবং সাংবাদিক আজহারুল আজাদ জুয়েলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১২ জন নিহত এবং ৪৪ জন আহত মুক্তিযোদ্ধার নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। আহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগৃহীত নামের তালিকা নিয়ে সাবেক সাংসদ জনাব আব্দুর রহিমের চেষ্টায় মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলের মাঠে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয় ২০০০ সালের ৬ জানুয়ারী। বিডিআর-এর তৎকালীন মহাপরিচালক আ ন ম ফজলুর রহমান এটি উদ্বোধন করেন। চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধির সৌধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট একটি স্মৃতিফলক দেয়। স্থানীয় জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধির সামনে একটি ছোট শহীদ মিনার তৈরি করেন। মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়টির ভগ্নাবশেষ ভেঙ্গে ফেলা হয়। পরে সেখানে একটি সাধারণ স্কুল ভবন (একতলা) তৈরি করা হয়। এরপর স্কুল মাঠের উত্তর প্রান্তে একটি সুবৃহৎ চারতলা ভবন তৈরি করা হয়। প্রতিবছর ৬ জানুয়ারি মহারাজা স্কুলমাঠে গণজমায়েত, শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক প্রদান ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "দিনাজপুরে ঐতিহাসিক মহারাজা ট্রাজেডি দিবস পালিত"বাংলাদেশ প্রতিদিন। ঢাকা। ২০১৭-০১-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২৯