মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (নাট্যকার)

ভারতীয় অভিনেতা ও নাট্যকার


মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (২৬ জানুয়ারি, ১৮৮৯ —২০ জানুয়ারি ১৯৫৪) ছিলেন বাংলার প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার। [১]

মহর্ষি

মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
জন্ম(১৮৮৯-০১-২৬)২৬ জানুয়ারি ১৮৮৯
কামারখাড়া-বিক্রমপুর, ঢাকা , বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, বৃটিশ ভারত
মৃত্যু২০ জানুয়ারি ১৯৫৪(1954-01-20) (বয়স ৩০)
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাঅভিনেতা ও নাট্যকার
পিতা-মাতানবীনচন্দ্র ভট্টাচার্য (পিতা)
স্বর্ণময়ী দেবী (মাতা)

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের কামারখাড়া গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। পিতা নবীনচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং মাতা স্বর্ণময়ী দেবী ছিলেন সরলা ও ভক্তিপরায়না গৃহকর্ত্রী। মনোরঞ্জনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কামারখাড়া গ্রামে। তার বিদ্যারম্ভ পিতার কাছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কালীমোহন দেব পাঠশালায়। ১৯০৬ ,খ্রিস্টাব্দে তিনি গ্রামের রাধানাথ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে বৃত্তি লাভ করেন। বাল্যকাল থেকেই তার তীব্র জাতীয়তাবোধ ছিল।[২] ছাত্রবস্থায় ঢাকায় গুপ্ত বিপ্লবী দলে যোগ দেন এবং পরে কলকাতার ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজে; কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ওই কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ভর্তি হন সিটি কলেজে। সেখান থেকে আইএসসি পাশের পর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজ থেকে গণিতে সম্মান নিয়ে স্নাতক হন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দেই এম এসসি পড়ার সময় প্রথমে চট্টগ্রামের কুতুবদিয়া ও পরে হুগলি জেলার বদনগঞ্জে অন্তরীণ থাকেন। শেষে স্বগৃহে দেড় বৎসর অন্তরীণ থাকার পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পেয়ে পড়াশোনার চেষ্টা করেন, কিন্তু সংসারের চাপে পড়াশোনা বন্ধ করে বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দেন। অবসর সময়ে তিনি দেশবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিবের কাজ করতেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে চার মাসের কারাদণ্ড ভোগ করেন। এইসময়ে বহু রাজনৈতিক কর্মী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীর রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের ডা দুর্গাপদ ঘোষের মাধ্যমে তার পরিচয় ঘটে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে।[১]

অভিনয় জীবন সম্পাদনা

শিশিরকুমার ভাদুড়ীর আহ্বানে তিনি কলকাতার থিয়েটার দলে যোগ দেন। বাল্যকালে গ্রামের 'নেপচুন থিয়েটার', পরে 'শ্যামসুন্দর থিয়েটার পার্টি'সহ বিভিন্ন নাট্যদলের অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি তার এক সুপ্ত আগ্রহ ছিলই।[২] ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কলকাতার পেশাদারি নাট্যমঞ্চে অভিনয় জীবন শুরু করেন। শিশিরকুমার ভাদুড়ীর পরিচালনায় মনোমোহন থিয়েটারে "সীতা" নাটকে বাল্মিকী'র চরিত্রে তার সংযত ও সাবলীল অভিনয় দেখে দর্শকরা অভিভূত হন। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার তার নির্মল চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে মহর্ষি আখ্যায় ভূষিত করেন। তখন থেকেই মনোরঞ্জন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শুধু নাট্যজীবনে নয়, কর্মজীবনে "মহর্ষি" নামে পরিচিত হন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পেশাদার রঙ্গমঞ্চে শতাধিক চরিত্রে অভিনয় করে নিজের সেই সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছেন।

চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন। প্রথম অভিনয় ছিল ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাডান কোম্পানির নির্বাক ছবি রজনী'-তে শচীন্দ্রনাথ চরিত্রে। বাংলা চলচ্চিত্রের পঞ্চাশটির বেশি ছবিতে অভিনয় নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।।[১]উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বাংলা ছায়াছবি হল-

খ্রিস্টাব্দ ছায়াছবি চরিত্র মন্তব্য
১৯৩২ চণ্ডী দাস আচার্য
১৯৩৪ রূপলেখা মহেশ্বর
১৯৩৫ দেবদাস
১৯৩৮ অভিঞ্জান জহরলাল চৌধুরী
১৯৩৯ বামনাবতার শুক্রাচার্য
১৯৩৯ পথিক ক্যাশিয়ার

[৩]

তবে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য পেশাদার নাট্যমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও অপেশাদার প্রগতিমূলক নাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বই ছিলেন। প্রথম প্রগতিশীল নাটক "নবান্ন" মঞ্চস্থ করার সময় তার উপদেশে মঞ্চে চটের দৃশ্যসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতার বহুরূপী নাট্যসংস্থার ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন এবং সভাপতি পদে থেকে সংস্থাটিকে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ করেন।

মঞ্চাভিনেতা হিসাবে সফল ব্যক্তিত্ব মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য নাট্য রচনাতেও পারদর্শী ছিলেন। তার রচিত নাটক গুলি হল-

  • চক্রব্যুহ
  • ব্রতচারিণী
  • বন্দনার বিয়ে
  • দেশবন্ধু
  • হোমিওপ্যাথী

নাট্য রচনার পাশাপাশি তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এবং সেগুলি তৎকালীন অরণি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার প্রবন্ধ সংকলন থিয়েটার প্রসঙ্গ নামে প্রকাশিত হয়।

তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর দলের সভ্য হয়ে আমেরিকায় অভিনয় করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে ওই দেশে যান।

ছাত্রবস্থায় ও জীবনের প্রথমদিকে তিনি জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, জীবনের শেষদিকে তাকে সাম্যবাদীর ভূমিকায় দেখা গেছে। মুম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।।[১]

মৃত্যু সম্পাদনা

মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬ পৃষ্ঠা ৫৪৭,৫৪৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. রহমত আলী। মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য জীবন ও নাটক। কবি প্রকাশনী, ঢাকা। 
  3. "Manoranjan Bhattacharya"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-২৫