অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী ‘আজ বিজ্ঞানের জয়জয়কার সর্বত্র। এই বিজ্ঞান যদি মানুষের মননশীলতার দান হয়ে থাকে তা হলে ধর্ম দর্শনও মানুষের চিন্তা চেতনারই আবদান। তাই আজ মানুষ সম্পূর্ন নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে তার অতীতকে বিশ্লেষণ করছে। ধর্ম দর্শনে তার মননশীলতার যে বিরাট ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে, তার স্বরূপ উদঘাটন করছে। এর ফলে মানুষ আজ সর্ম্পূন দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করতে পারছে যে, সে এই জীবজগতেরই অন্তর্গত ছিলো পৃথিবীর সকল জড় ও জীবের সাথেই রয়েছে তার আত্নীয়তা। এদের মধ্যেই বিধৃত রয়েছে তার জীবন ও জীবিকার সকল উপকরণ। তাই তার মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা কোনো অলৌকিক আদর্শের বাহন নয়; বরং তার শ্রমেরই সকল নিদর্শন। তাই এই শ্রমের ব্যাপারটিকে একটু তলিয়ে দেখতে হবে। কারণ এর মাধ্যমেই আমরা যথার্থ মনুষ্যত্বের সন্ধান পাবো। শ্রম বলতে আমরা মানুষের সক্রিয়তাকে বুঝি। এক দিক থেকে সমগ্র জড় ও জীব জগতেও এই সক্রিয়তা বিদ্যমান। কিন্তু মানুষের মতো তা মননশীলতা সমৃদ্ধ নয়। বস্তুত এই মননশীলতা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বেরও পরিচয় বহন করে। নতুবা মাকড়শা, পিপীলিকা, মৌমাছি, ইত্যাদির চাইতে সে শ্রেষ্টতর জীব হিসাবে পরিগনিত হতো না। কিন্ত তাই বলে শুধু মনন চিন্তন তাকে এই পর্যায়ে আনতে পারতো না। যদি না সে তদনুসারে পরিশ্রমী হতো। সুতরাং এই মনন সমৃদ্ধ শ্রমই মানুষকে মানুষ করে তুলেছে এবং এর মধ্যেই তার পরিচয় বিদ্যমান। সুতরাং শ্রম বলতে শুধু গাধার মতো জীবনের বোঝা বওয়াকে বুঝায়না; বরং সেই জীবনের উৎপত্তি, তার বিকাশ ও পরিনতি সম্যক রূপে উপলব্ধি করে এক মহান উত্তরাধীকারের দায়িত্ব নিয়ে তার কর্তব্য পালন করাকে বুঝায়। কারণ আমার অস্তিত্বেও বহু পূর্বে মানুষের এই সমাজ গঠিত হয়েছে। যে পরিবেশে আমরা জন্ম নিয়েছি, যতো সামান্যই হোক, তাও গড়ে উঠতে কোটি কোটি মানুষের উদ্দেশ্য পূর্ণ মননশীল শ্রমের প্রয়োজন হয়েছে। কতো রক্ত কতো ঘামের পরিবর্তে মানুষ এমনি এক পরিবেশের সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে, তা যদি আমাদের উপলব্ধিতে না থাকে, তাহলে কখনোই আমরা মনুষত্ব নামক এই উত্তরাধিকারের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে বহন করতে পারবো না। সুতরাং আমাদেরকে বুঝে শুনে পরিশ্রম করতে হবে। তবেই আমাদের পরিশ্রম সমাজ প্রগতির বাহক হয়ে আমাদের মনুষ্য জন্মকে ধন্য করবে। কাজেই এমনি এক শ্রমের মাপকাঠি দিয়েই আমরা আদর্শ মানুষের অনুসন্ধান করতে পারি। যিনি যে পরিমানে এই যথার্থ শ্রমের শ্রমিক, তিনিই ততো খানি আদর্শ মনুষ্য পদবাচ্য। যারা সমাজ প্রগতির ধারাবাহী এই শ্রমকে এড়িয়ে উপাসনা বা প্রতারণার দ্বারা মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা শুধু সমাজকে প্রতারিত করেন না, বরং নিজেরাও প্রতারিত হন। অপরের শ্রমের ফসল ভোগ করে তারা যে কোনো পদবীই গ্রহন করুন না কেনো, জীবন যাপনে তারা যতো ঐশ্বর্যের অধিকারীই হোন না কেনো, মানুষ হিসাবে তারা অবশ্যই নিকৃষ্ট। তাদের চাইতে সেই একজন শ্রমিক শ্রেষ্ঠতর - মনুষ্যত্বের অধিকারী, যে তার ক্ষমতা ও চেতনা অনুসারে জীবনের দায়িত্ব পালন করছে। হয়তো তার দেহে স্বাস্থ্যে চাকচিক্য নেই, হয়তো পরনে পোশাকের জৌলুস নেই, কিন্তু মানুষ হিসাবে সে শ্রেষ্ঠ’-- গোলাম সামদানী কোরায়শী। অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী’র জন্ম ১৯২৯ সালের ৫ এপ্রিল। বর্তমান নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার কাউরাট গ্রামে। বাবা মৌলভী বাবু শেখ আবু আছল মোঃ আঃ করিম কোরায়শী। মা আলতাফুন্নেসা। তাঁর পূর্বপুরুষের ছিল ময়মনসিংহ গৌরীপুরের বীর আহাম্মদপুর। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর ঘাটুরকোণা প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাঠালিয়া মধ্য ইংরেজী স্কুল থেকে ১৯৩৫-৩৬ সালে প্রাইমারী পড়াশুনা শেষ করেন। এরপর ১৯৩৭--৪১ সাল পর্যন্ত ভর্তি হন নেত্রকোণার চন্দ্রনাথ হাই স্কুল ও বীর আহাম্মদপুর হাই স্কুলে পড়েন। এরপর ১৯৪৫-৫০ সাল পর্যন্ত বাস্তা জুনিয়র মাদ্রাসা(নেত্রকোণা) ও কাতলাসেন মাদ্রাসায় পড়েন(ময়মনসিংহ)। কাতলাসেন মাদ্রাসা থেকে ১৯৫০ সালে আলিম ১ম শ্রেণীতে ৮ম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫২ সালে জামাতে উলা (ফাজেল) ১ম শ্রেণীতে ৩য় স্থান ও ১৯৫৪ সালে এম. এ (কামিল) ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করেন। ১৯৫৫-৫৬সালে তিনি নাসিরাবাদ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (ময়মনসিংহ) থেকে আই. আই. এ ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করে বাংলায় ভর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে বাংলায় (অনার্স) ২য় শ্রেণীতে ৫ম ও ১৯৬০ সালে এম. এ. বাংলা - ২য় শ্রেণীতে ২য় স্থান অর্জন করেন। সামরিক শিক্ষা (ইউ ও টি সি) ২০ দিনের মিলিটারী ট্রেনিং, এ্যানুয়েল ক্যাম্প, ময়নামতি, কুমিল্লা (১৯৫৩) হাই মাদ্রাসা শিক্ষা অংক ও ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা (১৯৫৫)দেন। গোলাম সামদানী কোরায়শী’র কর্ম জীবন এক বহুমুখী বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার। আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে রাখাল তিনি ৩ বছর ধরে রাখাল(১৯৪২-৪৫) ছিলেন। তারপর ধানীখোলা বাজার, ঈদগাহ্‌ মাঠ মসজিদের ইমাম ছিলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে ধানীখোলা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। এরপর তিনি ড. মুঃ শহীদুল্লার সম্পাদনা সহকারী, পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্প ও পান্ডুলিপি ও সংকলন বিভাগ, বাংলা একাডেমীতে (১৯৬১-৬৮) কাজ করেন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নাসিরাবাদ কলেজ, ময়মনসিংহ (১৯৬৮-৯১)যুক্ত ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী’র সাহিত্য কর্ম বিশাল। তাঁর এই সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর বিচিত্র বৈচিত্রের সাহিত্য দর্শন যে কোনো সাহিত্য প্রেমিককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। তাঁর মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ ও সম্পাদনার পরিমান বিশাল। প্রবন্ধঃ আরবী সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (বাংলাএকাডেমী), সাহিত্য ও ঐতিহ্য (মুক্তধারা), ইসলাম ও আমেরিকা (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী), আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম, আসামীর কাঠগড়ায়্‌; পিতৃভাষা, ঐতিহ্য অন্বেষা। এছাড়া সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ হলোঃ আজকের বাংলাদেশ (অক্টোবর’৮৫ - জুন’৮৬), সপ্তাহে ৪টি, স্বনামে ও ছদ্মনামে, সাপ্তাহিক ময়মনসিংহ বার্তা, জেলা বোর্ড (১৯৭৮-৮৮)। এছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ অগ্রন্থিত আকারে পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশিত এবং অসংখ্য অপ্রকাশিত অরক্ষিত রয়েছে। জীবনী ও আত্মজীবিনীঃ ছোটদের দুদুমিয়া, ছোটদের বঙ্গবন্ধু(শিশু একাডেমী১৯৯০)। যখন একাকী, দিনলিপি (১লা জৈষ্ঠ্য ১০ চৈত্র ১৩৮০), সিন্ধুর এক বিন্দু, শিক্ষা ও কর্ম জীবন, দুই খন্ড (১৯৮৩-৯০)। উপন্যাসঃ ষষ্ঠীমায়া (সেমেটিক মিথলজী ভিত্তিক রচনা, শুরু ১৯৭৯ অসম্পূর্ণ) স্বর্গীয় অশ্রু(১৩৮০), পুত্রোৎসর্গ(১৩৮১), মহাপ্লাবন, চন্দ্রাতপ(১৩৮৩) এগুলো তাঁর সেমেটিক মিথলজী ভিত্তিক রচনা। গল্প ও গল্প সংকলনঃ শ্রী গোলের আত্মকাহিনী প্রথম গদ্য রচনা (১৯৪৩), লেখার দোকান, কালকেতু উপাখ্যান, কারূণের উট, শাদ্দাদের বেহেস্ত, কাল নাগিনী, কোরবাণী, দুর্ভিক্ষ, কল্পনা ও বাস্তব, এক যে ছিল কুল গাছ, একুশের কড়চা, কান্না, শয়তানের দোকন, জ্ঞানের ঘাট, বাঁশী, জায়দার বাপের বেহেস্ত, হজ্জ্ব, অভিনেত্রী, ভাগ্যরেখা, রক্ত চোষার ফরিয়াদ, থার্ড ক্লাশ, বিসমিল্লাহ, বিশ্বাসঘাতকতা, সাধু, দাদা ইত্যাদি। গল্প সংকলনঃ আদি, অভিসার, নরম গরম, দুই ভাই, দুই বোন, দুই মা, দুই বন্ধু, গল্প শুনো, মেঘলা রাতের কাব্য, বুড়া ঘুমালো পাড়া জুরালো, তিন দিন তিন রাত প্রভৃতি। নাটকঃ টুপিচোর, আমাদের দেশ (নাটিকা), গাধার কলজে, সাতটি নক্‌শা, সাপের ছোবল, উটের মাংস, আরও ৪টি। শিয়ালের সাফাই, নাটিকা, সবুজ পাতা(এ তিনটি শিশুতোষ নাটক) ক্ষুধিত সিংহাসন, হেমলক (নাটিকা), উপন্যাসঃ ‘প্রদীপের নীচে’ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক (রচনা শুরু ১৯৮৩ - অসম্পূর্ণ) ‘দেব না জানন্তি’ নাগরিক উপন্যাস (১৯৮৫), ‘রূপ ও রূপা’ পারিবারিক উপন্যাস (অসম্পূর্ণ)। এছাড়া ‘সংলাপ’ সম্পূর্ণ সংলাপে রচিত (১৯৯১) ও ‘কামিনী’ উপাখ্যান। কবিতা ও কবিতা সংকলনঃ খেয়ালের ঝুলি, দূর্ঘটনা, উটকোর জিভ, বাদশাজাদা ও গল্পিকা (কিশোর কবিতা সংকলন), মানুষ (১২টি সনেটের সংকলন)। ছড়াঃ গোবদা সাধুর কোর্তা(৩৮টি ছড়ার সংকলন), ওলোট পালট, আগডুম বাগডুম (ছড়া সংকলন) (১৩৯৭)। গানঃ গান(২৫টি গানের সংকলন), গানের খাতা(৪০টি গানের সংকলন)। অনুবাদঃ কালিলা ও দিমনা (বাংলা একাডেমী-১৯৬৫), হেজাজের সওগাত, মুঝে ভি শেকায়েত নেহী (জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, ঢাকা-১৯৬৫), ‘ভেজাল’নাটক (নাসিরাবাদ কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত-১৯৭৮), আল-মুকাদ্দিমা(দুই খন্ডে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত১৯৮১-৮২), তারিখ-ই-ফিরোজশাহী (বাংলা একাডেমী প্রকাশিত১৯৮২), তোহ্‌ফা, ফতেহাবাদের আউলিয়া কাহিনী, অশাস্ত্রীয় পুরাণ, শব্দার্শ অধ্যায়ন, আমার অভিযোগ এগুলো বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত প্রকাশিত হয়। এছাড়া চাটনী, ফিরনী, করিমা, রূপকথা, ‘দোলনা থেকে কবর ও পথের সাথী’ হাদিস সংকলন, ইসলামের গৌরব ও লজ্জা, ‘দ্বিপদ’ ১০১টি কবিতার সংকলন, অজানা দ্বীপের কাহিনী(অসম্পূর্ণ)। সম্পাদনাঃ পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্প (১৯৬১-৬৮), পদ্মাবতী, আওয়াল, বাংলা একাডেমী (১৯৬৫), তোহফা, আওয়াল, বাংলা একাডেমী (১৯৭৫) ও সাপ্তাহিক ময়মনসিংহ বার্তা সম্পাদনা করেন। অন্যান্যঃ নেংটির সংসার সদা সত্য কথা বলিব, মীরজাফর, বিড়ালের ডাক, গরুর শিং এগুলো তাঁর রস রচনা সংকলন। ‘সবুজ ঘাসের দেশে’(টি.ভি. কাহিনী চিত্র), লেখার খাতা(বিবিধ বিষয়ের সংকলন) ফার্সী - বাংলা অভিধান(অসম্পূর্ণ)। অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে তিনি সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ময়মনসিংহ সাহিত্য পরিষদ, আকুয়া জুনিয়র হাই স্কুল কমিটি, আকুয়া প্রাইমারী স্কুল ম্যানেজিং কমিটি, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ময়মনসিংহ শাখা (১৯৮৪-৯১) উজিরাবাদ সমবায় সমিতি, আকুয়া পৌর কবরখানা, ময়মনসিংহ ও সহ-সভাপতি হিসেবে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী (ময়মনসিংহ) এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাদ্রাসায়ে আলীয়া, বাংলা সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮), বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (১৯৮৪-৯১) দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সংগঠনের আহ্বায়ক, উপদেষ্টা ও সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিনেট(১৯৮২-৮৫, ১৯৮৭-৮৮)সদস্য, বাংলা একাডেমীর(নং ৪৪৫) আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের ১১ অক্টোবর মারা যান। সম্পাদনায়ঃ শেখ রফিক