ব্যবহারকারী:Ferdous/উইকিভিজ্ঞতা

উইকিপিডিয়ার সাথে আমার পরিচয় অনেক আগে থেকে। ছাত্রজীবনে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য ইংরেজী উইকিতে ঢু মারতাম প্রতিদিন। যাই দরকার গুগলে সার্চ দিলে গুগল মামু উইকিতে পাঠিয়ে দিতো। উইকি সম্পর্কে তখন খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতাম। ভাবতাম খুব জ্ঞানী মানুষেরা এগুলো লিখে থাকেন। ফোর্থ ইয়ারের প্রজেক্টে কাজ করার সময় ইংরেজী উইকি থেকে প্রচুর কপি করেছিলাম। স্যার রিপোর্ট পেপারের খসড়া দেখে রেগে মেগে আমার মুখে উপর ছুড়ে মারলেন। উইকির তথ্য যে কেউ লিখতে পারে। যা খুশী লিখতে পারে। তাই ভূলে ভরা উইকি। আমি আগ্রহ নিয়ে ২০১০ সালে রেজিস্ট্রেশান করে ফেললাম বাংলা উইকিতে।নিয়ম কানুন কিছু বুঝলাম। কিন্তু কেন জানিনা খুব দুর্বোধ্য মনে হলো। হারিয়ে গেলাম ব্লগের দুনিয়ায় যেখানে যা খুশী লেখা যায়।

অতঃপর কেটে গেলো অনেক গুলো দিন। ২০১৩ এর শেষের দিকে সামু ছেড়ে টেকটিউনসে লেখালেখি শুরু করেছি বিজ্ঞানের খাতা। উইকিতে প্রয়োজনে আসতেই হতো। বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্যের জন্য আবারও উইকিতে আসার মাত্রা বাড়াতে হলো। একদিন মনে হলো বিজ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধগুলো বাংলায় থাকলে মন্দ হতো না। ২০১৪ তে ফিরে এলাম অথবা যোগ দিলাম বাংলা উইকিতে। দ্রুত নিয়মাবলী আত্মস্থ করলাম। অনেকগুলো নিবন্ধ তৈরী করলাম। তবে শুরুতে অন্য সবার মত আমিও আমার গ্রাম নিয়ে আর্টিকেল লিখলাম। তথ্যের তুলনায় আবেগে ভারী এক নিবন্ধ। পাষানহৃদয় কোন এক এডমিন তা মুছে দিলো। খুব কষ্ট পেলাম। এরই সুত্র ধরে পরিচয় হলো আফতাবের সাথে। বয়সে অনেক ছোট হলেও খুবই হেল্পফুল মানসিকতার একজন ছেলে। আফতাবের সহায়তায় ছোট ছোট বিষয়গুলো ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হতে লাগলো। এরই মধ্যে বোধিসত্ব আমার সাতটা নিবন্ধে অপসারণের ট্যাগ লাগিয়ে দিলো কপি করার অপরাধে। সব যে কপি করেছিলাম তা নয়। কয়েক লাইন লিখেছি আর কয়েক লাইন কপি করেছি এই আর কি। অপসারণ ট্যাগ পাওয়ার পর একটা জিদ ধরে গেলো। সারা রাত ধরে বসে নিবন্ধগুলো পূনঃলিখন করলাম। আস্তে আস্তে পরিচিত হলাম মাসুম ইবনে মুসা, শরীফ উদ্দিন এদের সাথে। তৈরী হলো সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। বেলায়েত ভাইয়ের সহায়তা নিয়ে ইউজার নেম পরিবর্তন করলাম। এরপর সুখে দুঃখে কেটে গেলো এক বছর।

২৯ মে ২০১৫। সকালের শিফটে ডিউটি করে বাস ধরলাম। বাংলা উইকিপিডিয়ার দশম বর্ষপূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছি। অনেক দিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। চেনা বৃত্তের অচেনা মানুষগুলোর সাথে অবশেষে দেখা হতে যাচ্ছে। এতদিন যাদের নামগুলোর সাথেই শুধু পরিচিত ছিলাম। কয়েকদিন আগে আমার এন্ড্রয়েড ফোনটা অতিরিক্ত গরমের কারণে বালতির জলে স্নান করতে নেমে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে তাকে দিয়ে আর কাজ করানো যাচ্ছে না। নাহিদ সুলতানের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে কাগজে টুকে নিয়ে এসেছি। তবু গুগল ম্যাপের উপর আজকাল এতটাই নির্ভশীল হয়ে পড়েছি যে YWCA খুঁজে পেতে খুব কষ্ট পেতে হলো না।

রিসিপশান থেকে চাবি নেওয়ার সময় না জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম আমার সাথে রুম শেয়ার করবে সুব্রত রায়। মনে মনে আতঙ্কিত বোধ করলাম। কয়েকদিন আগেই তার এক নিবন্ধে অপসারণের ট্যাগ মেরেছিলাম। এবং সে আলোচনা ব্যতীত ট্যাগ অপসারণ করায় আমি তাকে আলাপ পাতায় আলোচনা করতে বাধ্য করেছিলাম। সো দেখা হলে বিতর্ক একটা বকেয়া তো থাকেই। ফ্রেশ হয়ে শুয়েছি সবে মাত্র এমন সময়ে রুমের দরজায় নক হলো। দরজা খুললাম। আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সুব্রত রয়। সুব্রত দা সবসময় ক্রিকেট নিয়ে লেখেন। আমার ধারণা ছিলো কলেজ পড়ুয়া কেউ হবে। এখন দেখি আমার থেকেও সিনিয়র। তার হাসিটাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুললো। দুই মিনিটের মাথায় সুব্রতদার সাথে তর্ক শুরু হয়ে গেলো। যুক্তি প্রতিযুক্তিতে আমরা কেহ কারে নাহি ছাড়ে। তবে শিক্ষিত লোকের সাথে তর্কের একটা মজা আছে। অশিক্ষিত লোকের সাথে হয় তর্ক আর বিদ্যাধরী জনের সাথে হয় বিতর্ক।

মাসুম ইবনে মুসা, শরীফকে ফোন দেওয়ার দুই মিনিটেই রুমে এসে হাজির। গল্প আড্ডায় ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে লাগলো। আড্ডার মাত্রা এত বেড়ে গেলো যে রুম সার্ভিস দিদি এসে আস্তে কথা বলতে অনুরোধ জানিয়ে গেলো। পরিচয় হলো ইন্তেখাব, বেঞ্জামিনের সাথে। লাঞ্চের সময় যে কখন বয়ে গেলো টের পেলাম না। আসার আগে বেশ কনফিউজড ছিলাম। বারো জায়গার তেরো মানুষ। কে কেমন হবে কি জানি। এমনিতেই আমি সবার সাথে ফ্রি হতে পারি না। শুধু যারা ফ্রি হয় তাদের সাথেই ফ্রি হতে পারি। সুব্রতদার মিশুক স্বভাব আমারও নিজেকের খোলসের বাইরে বের হতে সাহায্য করলো। সবাই মিলে শেষ বিকেলে নাস্তা করতে গেলাম। সুব্রত দা, মাসুম, বেঞ্জামিন, ইন্তেখাব, শরীফ এবং আমি। সন্ধ্যায় মাসুম, বেঞ্জামিন, ইন্তেখাবকে সাথে নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনে ঘুরে এলাম। সুব্রত দা ফার্মগেট গেলেন। একজনের মাথায় কাকে হাগু করে দিলো, কিন্তু তার নাম সবার সাথে বলতে মানা। ফিরে ডিনার সেরে আবার আড্ডা। আগমনের ভিত্তিতে পরিচিত হলাম মাসুম আল হাসান, তানভীর, রাহাত, রিয়াদ, আশিক শাওন, অনুপ সাদি, ইকবালদের সাথে। সব চেনা নাম। চেহারাগুলোই শুধু অচেনা এই যা। কিন্তু সবার ব্যবহার কত আন্তরিক! সবাইকে খুব আপন মনে হতে লাগলো। মধ্যরাতে ঘুমাতে গেলাম।

সকালে উঠে গুছিয়ে নিলাম। গন্তব্য ড্যাফোডিল ইন্ট্যারন্যশানাল ইউনিভার্সিটি শুক্রাবাদ ক্যাম্পাস। আমাদের সবার কাছেই অচেনা। সাথে আছে ভারত থেকে আসা বিশ্বরূপ দা, রঙ্গন দা। অনুপ সাদির নেভিগেশানে সাত মিনিটের পথ সাইত্রিশ মিনিট হেঁটে আমরা অবশেষে পৌঁছলাম। ঘেমে নেয়ে অস্থির। সব অপরিচিত মুখ। চেনা নামের মানুষগুলোকে খুঁজছি মনে মনে। ভেতরে বসতেই ডায়াসে দেখতে পেলাম হাছিব ভাইকে। সঞ্চালনা আলোচনায় অনুষ্ঠান এগিয়ে যেতে থাকলো। সুন্দর একটা চেহারার ছেলে এসে পরিচয় দিলো ফেরদৌস ভাই আমি মেরাজ। আমিও অবাক হয়ে বললাম তুমিই মেরাজ! মেরাজকে আমি ট্যাগ মেরাজ হিসেবেই জানতাম। আমার কোন পোস্টে ট্যাগ না লাগালেও একটা সময়ে দেখতাম যত্রতত্র ট্যাগ লাগাতে। মেরাজের সাথে প্রথম পরিচয় হতেই আমি অনুরোধ জানিয়ে রাখলাম সদয় হয়ে ট্যাগের ব্যবহার করতে। সাদাদ মোস্তফা ভাইয়ের ভাষার ব্যবহার এবং হিউমার মুগ্ধ করলো। তারভীর মোর্শেদকে মৃদুভাষী মনে হলো।

ছাত্রজীবনে কোন আলোচনা অনুষ্ঠানে গেলে আমি স্টেজে রাখা চেয়ার গুনতাম যে কতজন বক্তৃতা দেবে। এখন আর সেই সুযোগ নেই। চেয়ার চারখানা থাকলেও বক্তা অনেক থাকে। নিচ থেকে ওঠে আর নামে। আগেভাগে অনুমান করার উপায়ই থাকেনা যে কতজন বক্তব্য রাখবেন। আমার দৃষ্টিতে দশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান আলোচনা প্রধানই হয়ে গেছে। নাচ গান ছাড়া সেলিব্রেশান হয় নাকি! বাঙালি হয়ে বাঙালি মানসিকতার বাইরে তো আর যেতে পারি না। তবে সব শেষে আমার অন্যতম প্রিয় লেখক আনিসুল হককে সামনা সামনি দেখতে পেয়ে এবং তার রসালো বক্তব্য শুনে মনটা চনমনে হয়ে গেলো। ভালো লাগার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে আমার বেশ কিছু প্রিয় মুখ পুরষ্কার পাওয়ায় খুব আনন্দিত হলাম। তবে মনে হয় ভবিষ্যতে যদি এরকম কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলে অনলাইন এবং অফলাইন অবদান ক্যাটাগরি আলাদা রাখলে ভালো হবে। এক ফাঁকে খুঁদে উইকিপিডিয়ান প্রত্যয় এবং অঙ্কনের সাথে আলাপ করলাম।

সব শেষে ছোট একটা আলোচনা সেশান। কোনার দিকে একটা চেয়ার ফাঁকা পেয়ে বসে পড়লাম। আমি যার পিছে বসেছি প্রথমে তো বুঝতেই পারিনি ইনিই মুনির ভাই। দিনের শুরুতে ওনার পরিচয় যখন দেয়া হয়েছিলো তখন আমি ঘামে ভিজে অস্থির ছিলাম। তিনি সবার কাছে মতামত জানতে চাইছেন উইকিপিডিয়ার মানোন্নয়নে কি কি করা উচিত। সেশানে আসার কিছু আগে আমি তন্ময় ভাইয়ের সাথে আলোচনা করছিলাম যে নতুন নিবন্ধ তৈরী করার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০০ থেকে ৫০০ কেবির তথ্য সংযোজন করতে হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা দেয়া যায় কিনা! মনে মনে ভাবছিলাম বলবো কিনা। অনেকেই অনেক যুক্তি দিচ্ছে। এক পর্যায়ে মুনির ভাই ফিচার আর্টিকেলের কথা বললে আমি সাহস করে বললাম, ভাই আমার মনে হয় ১০০ ফিচার আর্টিকেলের জন্য ১০০ বিষয় ঠিক করলে আমরা নিয়মিত অবদান কারীরা বসে লিখে ফেলতে পারি। কারণ নতুনদের দিয়ে তো ফিচার আর্টিকেল লেখা সচরাচর হয়ে ওঠে না। আর প্রতিদিনই অনেক নতুন ব্যবহারকারী উইকিপিডিয়ায় যোগ দিচ্ছে কিন্তু দিন শেষে অবঃশেষ হয়ে আমরা কয়েকজনা রয়ে যাই। মনির ভাই সবার সাথে আলোচনা করলেন বিষয়টা। ভালো লাগলো।

বেশ টায়ার্ড। ভেবেছিলাম অনুষ্ঠান শেষ হলে ফেরার পথ ধরবো। কিন্তু আড্ডার লোভে রয়ে গেলাম। রুমে ফিরে গোছল করে একটু ঘুমিয়ে নেবো এমন সময়ে শরীফ এসে জানালো তন্ময় ভাই এসেছেন। আবার আড্ডা। রাত নয়টা পর্যন্ত আড্ডা। তন্ময় ভাইকে অনুরোধ করলাম শীত বর্ষা যে কোন উপলক্ষ্যে উইকি পিকনিকের আয়োজন করতে। অন্তত একটা মিলনমেলায় উপলক্ষ্য তো তৈরী হবে। ডিনার শেষে রুমে ফিরে আবার আড্ডা। রাত দুটো পর্যন্ত চললো।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো মেরাজকে বিদায় দিয়ে। একে একে সবাই যে যার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। আমাকেও যেতে হবে। নিজেকে দিয়েই জানি সবার কতটুকু ফেরার আগ্রহ হচ্ছে! কিন্তু ফিরতে তো হবেই। সবাই আবার ফিরে যাচ্ছি নিজেদের ল্যাপটপ কি ডেস্কটপের পিছে। যেটা শুধু আমাদেরই রাজত্বে। কাজ করবো বাংলা উইকিপিডিয়ায় সম্প্রসারণে। বাবা মায়ের দৃষ্টিতে এরকম কাজ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত হলেও এটাই আমাদের ভালো লাগার এক উৎসভূমি!

রিয়্যাকশান সম্পাদনা

যেহেতু আমার উইকিভিজ্ঞতায় আমি অনেকের নাম ব্যবহার করেছি। সবার কাছ থেকে অনুমতি নেয়া সম্ভব না। কারো কোন অংশ নিয়ে আপত্তি থাকলে জানাবেন। কোন মন্তব্য থাকলেও করতে পারেন।