বেগুন রাজকন্যা

ভারতীয় লোককথা

প্রিন্সেস অবার্গিন বা বেগুন রাজকন্যা হল পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে উৎসারিত একটি ভারতীয় লোককথা যা ফ্লোরা অ্যানি স্টিল দ্বারা বিশেষভাবে সংগৃহীত হয়েছিল। এই লোককাহিনী একটি রাজকন্যাকে কেন্দ্র করে যার জীবনশক্তি একটি নেকলেস বা কন্ঠহারের সাথে বাঁধা। এই কন্ঠহার একবার এক ক্ষতিকর শত্রুর হাতে পড়ার সাথে সাথে রাজকন্যা মৃতের ন্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। ইউরোপীয় রূপকথার স্নো হোয়াইট এবং স্লিপিং বিউটির সাথে এই গল্পের প্রধান নারী চরিত্রের বিশেষ মিল দেখা যায়।[১] ভারতে এই গল্পের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন সংস্করণ বিদ্যমান। কোন সংস্করণে একজন নায়িকা এবং একজন নায়কের কথা বলা হয় যাদের জীবন একটি মায়াবী কন্ঠহারের সাথে সংযুক্ত।

উৎস সম্পাদনা

রিচার্ড কার্নাক টেম্পল লাহোরের কাছে কাসুরে পুর্বিয়া বংশোদ্ভূত এক বৃদ্ধ মহিলার কাছ থেকে গল্পটি পেয়েছিলেন।[২]

সারসংক্ষেপ সম্পাদনা

একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ এবং তার স্ত্রী দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করত। তারা খাওয়ার জন্য শিকড় এবং ভেষজ সংগ্রহ করত। একদিন ব্রাহ্মণ একটি বেগুন গাছ খুঁজে পায় এবং তা রোপণের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসে। তিনি এবং তার স্ত্রী এটিতে জল দেয় এবং বড় হওয়ার পর এই গাছটি একটি বড় বেগুনি ফল দেয়। ব্রাহ্মণের স্ত্রী বাগানের বড় বেগুনটি কাটতে একটি ছুরি নিয়ে বাগানে যায়। যখন সে বড় ফলটিকে ছুরিকাঘাত করে, তখন নিচুস্বরে একটি আর্তনাদ শোনা যায়। স্ত্রী আবার ছুরিকাঘাত করে এবং বেগুনের ভিতর থেকে একটি কণ্ঠস্বর মহিলাকে সাবধানে আঘাত করার জন্য অনুরোধ করে। বউ বেগুনটিকে কেটে ফেলে এবং দেখতে পায় যে তার ভেতরে সাদা আর বেগুনি জামা পরা একটা মেয়ে রয়েছে। ব্রাহ্মণ এবং তার স্ত্রী মেয়েটিকে তাদের কন্যা হিসাবে দত্তক নেয় এবং তার নাম বেগুন রাজকন্যা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্রাহ্মণের কুঁড়েঘরের পাশেই একজন রাজা তার রানি এবং সাত পুত্রকে নিয়ে প্রাসাদে থাকত। একদিন, প্রাসাদ থেকে একটি দাসী কিছু প্রয়োজনীয় বস্তু চাইতে ব্রাহ্মণের কুঁড়েঘরে যায়, এবং বেগুন রাজকন্যাকে দেখতে পায়। সে এতই সুন্দর যে দাসীটি তার সম্পর্কে রানীকে বলার জন্য সেইমুহুর্তে প্রাসাদে ফিরে আসে। রানি, নিজে সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও, তাকে বলা হয় যে ব্রাহ্মণের কন্যা তার চেয়েও সুন্দর। এতে তার ভয় হয় যে রাজা হয়তো তার বদলে বেগুন রাজকন্যাকে রানী করবে।

তাই রানি একটি পরিকল্পনা তৈরি করে: সে বেগুন রাজকন্যাকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানায় এবং মেয়েটিকে সেখানে রানির বোন হিসাবে তার সাথে থাকতে রাজি করায়। সময় চলে যায়। যাদুবিদ্যায় পারদর্শী রানি তার ক্ষমতার মাধ্যমে জানতে পারে যে বেগুন রাজকন্যা আসলে একজন পরী। যখন সেই পরী ঘুমিয়ে থাকবে তখন তার তার উপর মন্ত্র পড়ে তার জীবনশক্তির অবস্থান সম্পর্কে জানা যেতে পারে। রানি বেগুন রাজুকন্যাকে মন্ত্রের মাধ্যমে ঘুম পাড়িয়ে দেন এবং রাজকুমারী ঘুমের মধ্যে বলে দেয় যে তার প্রাণশক্তি রানির প্রথম পুত্রের মধ্যে রয়েছে। রানী ঠিক করে যে সন্তানকে হত্যা করে, সে বেগুন রাজকন্যাকে হত্যা করবে।

রানি তার প্রথম পুত্রকে হত্যা করে এবং এক দাসীকে বেগুন রাজকন্যাকে দেখতে পাঠায়। সে গিয়ে দেখে যে বেগুন রাজকন্যা তখনও বেঁচে আছে। রাজকুমারীকে হত্যা করার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে, রানি আবার তার গোপন কথা প্রকাশ করার জন্য মেয়েটির উপর মন্ত্রের প্রয়োগ করতে ফিরে যায়। রাজকুমারী বলতে থাকে যে তার জীবনশক্তি রানির অন্য ছেলেদের প্রত্যেকের মধ্যে রয়েছে। যার ফলস্বরূপ রানীর প্রত্যেক সন্তানই নিহত হয়।

সমস্ত ছেলেদের হত্যা করার পরেও যখন বেগুন রাজকন্যা জীবিত থাকে তখন রানি, ক্রোধে উন্মত্ত হয়। তার জীবনশক্তির অবস্থান প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে আরও শক্তিশালী মন্ত্র দিয়ে রানি বেগুন রাজকন্যাকে আচ্ছন্ন করে এবং সেবার সে জানতে পারে যে একটি নয়-লক্ষ কন্ঠহারের মধ্যে তার জীবনী শক্তি আবদ্ধ। সেই কন্ঠহার একটি ভ্রমরের মধ্যে একটি ছোট বাক্সের মধ্যে আছে এবং সেই বাক্স আছে একটি লাল-সবুজ মাছের ভিতরে, যে দূরে কোথাও একটি নদীতে বাস করে।

রানি তার স্বামী রাজাকে রাজি করায় নয় লাখ টাকার কন্ঠহারটি নিয়ে আসার জন্য, ছেলেদের আকস্মিক হারানোর পীড়া থেকে এই হার তাকে সামান্য স্বস্তি দেবে। রানি বলেছিল তার সন্তানরা একটি রহস্যময় অসুস্থতার কারণে মারা গেছে। রাজা মাছটি নিয়ে আসে এবং রানি গল্পের কন্ঠহারটি খুঁজে পায়। এদিকে বেগুন রাজকন্যা অনুভাব করে যে তার মৃত্যু সন্নিকটে। সে তার দত্তক পিতামাতার কুঁড়েঘরে ফিরে যায়। সে ব্রাহ্মণকে তার বিশ্রামের স্থান প্রস্তুত করতে বলে। তারা যেন তাকে মাটিতে সামাধিস্থ না করে, পরিবর্তে তাকে যেন তার বিছানায় শুইয়ে এক প্রান্তরের গভীরে ফুল দিয়ে ঘিরে রাখা হয় এবং এর চারপাশে একটি মাটির প্রাচীর তৈরি করা হয়।

ব্রাহ্মণ এবং তার স্ত্রী বেগুন রাজকন্যার নির্দেশ অনুসরণ করে, এবং রানির দাসী ফিরে গিয়ে রানিকে খবর দেয় যে বেগুন রাজকন্যাকে সমাধি দেওয়া হয়নি বরং খোলা জায়গায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। রানির কাছে তখনও কন্ঠহারটি থাকার জন্য সে এই সামান্য জয়ে সন্তুষ্ট হয়।

একদিন, রাজা তার সাত ছেলেকে হারানোর যন্ত্রনা ভোলার জন্য শিকারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রানি তাকে সতর্ক করে যেন সে উত্তরে শিকার করতে না যায়। রাজা পূর্বে, পশ্চিমে এবং দক্ষিণে শিকার করে এবং রানির কথা না শুনে উত্তরেও শিকার শুরু করে। রাজা বেগুন রাজকন্যারর দেহকে ঘিরে থাকা দেয়াল এবং ফুলের বিছানা দেখতে পায়। রাজা তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার মৃতদেহের দীর্ঘ, গোপন নজরদারি শুরু করে। এক বছর পর, মেয়েটির মৃতদেহের পাশে একটি ছেলে উপস্থিত হয়, এবং কিছু সময় পরে, ছেলেটি রাজাকে জানায় তার মা, সেই মেয়েটি, তার যত্ন নেওয়ার জন্য রাতে জীবিত হয়ে ফিরে আসে এবং সকালে পুনরায় মৃত হয়ে যায়।

রাজা তখন ছেলেটিকে তার পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে এবং ছেলেটি উত্তর দেয় যে সে রাজার পুত্র এবং বেগুন রাজকন্যা তার মা। রানির হাতে রাজার সাত পুত্রের মৃত্যুর পর তাকে সান্ত্বনা দিতে পাঠানো হয়েছিল। ছেলেটি আরও প্রকাশ করে যে রানির গলায় নয় লাখের যে হারটি আছে তাকে পুনরুদ্ধার করে বেগুন রাজকন্যাকে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।

রাজা ছেলেটিকে সাথে করে প্রাসাদে নিয়ে আসে। রানি, ছেলেটিকে দেখে এবং তাকে বিষযুক্ত খাবার দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু খেলার জন্য রানির গলার হার ছেলেটিকে না দেওয়া পর্যন্ত সে খাবার স্পর্শ করতে অস্বীকার করে। রানি ছেলেটিকে খাবার খাওয়ানোর জন্য তাকে নেকলেস দেয় এবং ছেলেটি তার মা বেগুন রাজকুমারীকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য হার নিয়ে চলে যায়।

তার মা, বেগুন রাজকুমারীর কাছে কন্ঠহারটি রাখার পরে, সে জেগে ওঠে। রাজা তার কাছে যায় এবং তাকে তার বধূ হিসাবে তার সাথে প্রাসাদে আসার জন্য বলে, কিন্তু বেগুন রাজকন্যা তা প্রত্যাখ্যান করে। সে দাবী করে যে যতক্ষণ না রাজা একটি খাদ খনন করে সেটি সাপ ও বিছে দিয়ে পূর্ণ করবে এবং রানিকে তার ভিতরে ফেলে দেবে, ততক্ষন সে রাজার কোন দাবী মানবেনা। রাজা তার আদেশ পালন করার জন্য কিছু চাকরকে আদেশ দেয়। রানির আপত্তি সত্ত্বেও, রক্ষীরা বলপূর্বক রানিকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে বেঁধে খাদে ফেলে দেওয়া হয় এবং জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয়। বেগুন রাজকন্যা এবং তার ছেলে রাজার সাথে প্রাসাদে থাকতে আসে।[৩][৪][৫]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Tatar, Maria. The Fairest of Them All: Snow White and 21 Tales of Mothers and Daughters. Cambridge, MA and London, England: Harvard University Press, 2020. pp. 94-101. ডিওআই:10.4159/9780674245822-008
  2. Steel, Flora Annie. "Baingan Bádsháhzádí - Prince Aubergine". In: Indian antiquary v. 9, 1880. p. 302 (Note 1).
  3. Steel, Flora Annie. "Baingan Bádsháhzádí - Prince Aubergine". In: Indian antiquary v. 9, 1880. pp. 302-304.
  4. Steel, F. Annie Webster; Temple, R. Carnac. (1884). Wide-awake stories: a collection of tales told by little children, between sunset and sunrise, in the Panjab and Kashmir. Bombay: Education Society's Press, 1884. pp. 79-88.
  5. Steel, F. Annie Webster; Kipling, J. Lockwood. (1894). Tales of the Punjab told by the people. London: Macmillan, 1894. pp. 71-79.