বেগুনিয়া (বাংলার মন্দির স্থাপত্য)
বরাকরে দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে চারটি মন্দির একত্রে বেগুনিয়া নামে পরিচিত। সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যের নিদর্শন এই মন্দিরগুলি। আগে মোট ৫টি মন্দির ছিল। বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল অবশিষ্ট, এদের একত্রে সিদ্ধেশ্বর মন্দির বলা হয়। তৃতীয় মন্দিরটি পশ্চিমমুখী, বাকিগুলো সব পূর্বমুখী। চতুর্থ মন্দিরটি বাংলার সর্বপ্রাচীন দেউল স্থাপত্য।[১]
নামকরণসম্পাদনা
বেগুনিয়া নামটি একটু অদ্ভুত। এই মন্দিরগুলির শিখরের আকৃতির সঙ্গে অনেকাংশে আধকাটা বেগুনের সাদৃশ্য আছে বলে এই জায়গার নাম বেগুনিয়ার মন্দির।
প্রাচীনত্বসম্পাদনা
বাংলার প্রাচীনতম পাথরের দেউল সামনের দিক থেকে শেষ বা চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতম মন্দিরটি। জোসেফ ডেভিড বেগেলার সাহেব পঞ্চম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের বিবরণ দিয়েছেন[২], এখন সেই পঞ্চম মন্দিরের চিহ্ন মাত্র নেই। এছাড়াও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে সামনের বাঁ দিকের মন্দির গাত্রের শিলালিপিটি।
বিনয় ঘোষের লেখা থেকে জানা যায় যে ১৩৮২ শকাব্দে (বা ৭৮ যোগ করে ১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দে) ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষে অষ্টমী তিথিতে জনৈক রাজা হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রী হরিপ্রিয়া তাদের ইস্টদেবতা শিবের উদ্দেশ্যে এই মন্দির নির্মাণ করেন। তৃতীয় মন্দিরের শিলালিপি অনুসারে ১৪৬৮ শকাব্দে (১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে) জনৈক ব্রাহ্মণ নন্দ এবং তার স্ত্রী এই মন্দিরটি সংস্কার করেছেন। অর্থাৎ মন্দিরটি আরো আগে নির্মিত।[৩]
অধিষ্ঠিত দেবদেবীসম্পাদনা
প্রথম মন্দিরে তিনটি শিবলিঙ্গ ও কালী মূর্তি, দ্বিতীয় টিতে তিনটি শিবলিঙ্গ ও গনেশ মূর্তি, তৃতীয় মন্দিরটিতে পাঁচটি শিবলিঙ্গ ও একটি পাথরের মাছ দেখা যায়। মাছ বা মীন সম্ভবত নারী শক্তির প্রতীক। জোসেফ ডেভিড বেগেলার সাহেব লিখেছেন-
“ | The sculpture represents a fish 5 ft.9 inches long from snout to the tip of the tail, 2ft.3 inches wide at the swell below the head and 1ft. 9inches at the junction of the tail. The tail itself is 9 inches long by 2 feet 1 inch wide at its extremity. | ” |
চতুর্থ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা সিদ্ধেশ্বর শিবের নামেই এই মন্দিররাজির নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।এই ছোট মন্দিরটি বাংলার সর্বপ্রথম দেউল এবং সম্ভবত অষ্টম শতকে নির্মিত।
স্থাপত্যরীতিসম্পাদনা
পাথরের তৈরি দেউল মন্দির পশ্চিমবঙ্গে বিরল। অলংকরণ, আকার, নান্দনিকতা দিয়ে বিচার করলে একমাত্র পুরুলিয়ার বান্দার দেউল এর সঙ্গেই বেগুনিয়ার মন্দিরের তুলনা করা যায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] চতুর্থ মন্দিরটি রেখা বা শিখর দেউলের সর্ব প্রাচীন উদাহরণ। নিচু ভিতের ওপর উঁচু গর্ভগৃহ। গোড়া থেকেই শিখরের ক্রমবক্র রেখা উপরে উঠে গেছে। শিখরের পগ রেখাগুলি যেন অসংখ্য লোহার পাতের মতন মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে। শিখরের উপর একটি বৃহৎ আমলক শিলা(গোল চাকতির মতন খাঁজ কাটা)।
উড়িয়া শিল্পরীতির সাথে পার্থক্যসম্পাদনা
স্থাপত্যের দিক দিয়ে এই মন্দিরটি ভুবনেশ্বর এর পরশুরামেস্বর মন্দিরের সমকালীন, অর্থাৎ অষ্টম শতকে তৈরি।[৩] পরশুরামেস্বর মন্দিরে বিমানের সঙ্গে যুক্ত আছে জগমোহন, যা এই মন্দিরে নেই। এছাড়া ওড়িশার রেখা দেউল এর মন্দির গুলির আমলক গুলি উত্তল, কিন্তু বরাকর মন্দিরের আমলক গুলি অবতল। [৫]
ভাস্কর্যসম্পাদনা
প্রতিটি মন্দির গাত্রে অসম্ভব সুন্দর পাথরের মূর্তি- যেমন উড়ন্ত সিংহ, মকর, রাক্ষসের মতন কীর্তিমুখ (যা শিব মন্দিরের বিশেষত্ব)।স্কন্ধ পুরাণে বলা হয়েছে, শিবের আদেশে জলন্ধর রাক্ষস নিজের শরীরকে নিজে গিলে ফেললে, শিব তার নাম নাম দেন- কীর্তিমুখ বা face of glory। এছাড়াও বিভিন্ন দেবদেবী, অনন্তসজ্জায় বিষ্ণু, অসংখ্য মৎসকন্যা আছে মন্দির জুড়ে।
সমস্যাসম্পাদনা
রেখা দেউল বা শিখর রীতিতে তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর দেউল গুলি কালের করাল গ্রাস জয় করে এখনো টিঁকে আছে। এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। কিন্তু বাঙালি জাতির চরম ঔদাসীন্য, ঠুঁটো জগন্নাথ কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় অতি উৎসাহী ভক্তদের তান্ডবে কতদিন আর টিঁকবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। ASI সংরক্ষিত স্থান হলেও, সারাদিন ধরে ভক্তদের ফুল, বেলপাতা, সিঁদুর লেপা এবং ঘড়া ঘড়া জল শিবলিঙ্গের ওপর ঢালা, এত ধর্মের আতিশয্যে, একটি মন্দির বহু আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ "Sthapatya" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৭-১০-৩১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১২-১২।
- ↑ জিডি বেগলারের রিপোর্ট অফ আ টুর থ্রু দ্য বেঙ্গল প্রভিন্সেস
- ↑ ক খ মন্দির স্থাপত্য-১৪, শিল্পকলা, বাংলা লাইব্রেরি।
- ↑ জিডি বেগলারের রিপোর্ট অফ আ টুর থ্রু দ্য বেঙ্গল প্রভিন্সেস
- ↑ বিনয় ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি