বেগম বদরুন্নেসা আহমদ (রাজনীতিবিদ)

বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ
(বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

বেগম বদরুন্নেসা আহমদ (৩ মার্চ ১৯২৪ - ২৫ মে ১৯৭৪) ছিলেন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অন্যতম পথিকৃৎ। [১]বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ। রাজনীতিতে তার দৃষ্টান্ত সামনে রেখে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা, শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন। দেশ ও মানুষের সেবায় অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে তাকে মরণোত্তর “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয়।

বেগম বদরুন্নেসা আহমদ
জন্ম(১৯২৪-০৩-০৩)৩ মার্চ ১৯২৪
মৃত্যু২৫ মে ১৯৭৪(1974-05-25) (বয়স ৫০)
পেশাসমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ
দাম্পত্য সঙ্গীনুরুদ্দীন আহমেদ
সন্তান অধ্যাপক ড.নাসরীন আহমাদসহ তিন সন্তান
পিতা-মাতাসৈয়দ মুস্তাদির (পিতা)
সৈয়দা মাহমুদা খাতুন (মাতা)

জন্ম ও শিক্ষা

সম্পাদনা

বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের জন্ম ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে। পিতা সৈয়দ আবদুল মুস্তাদির ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার। মাতা সৈয়দা মাহমুদা খাতুন। বদরুন্নেসা আহমেদ ভগ্নীপতি কাজী গোলাম গাউসের উৎসাহে পড়ালেখায় হাতেখড়ি নেন কলকাতার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে। পরবর্তীকালে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সালে সেখান থেকেই আই.এ পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিলেটের এম.সি. কলেজ থেকে প্রাইভেট বি.এ. পাস করেন। তিনি যথাক্রমে ১৯৬১ এবং ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৩ জুলাই বনবিভাগের সরকারি কর্মকর্তা শিলিগুড়িতে কর্মরত নুরুদ্দীন আহমেদের সাথে তার বিবাহ হয়।[২]

কর্মজীবন

সম্পাদনা

বিবাহ ও দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এসে নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির (আপওয়া)-র সদস্য হন এবং পাকিস্তান উইমেন্স ন্যাশনাল গার্ড-এ যোগ দেন। স্বামীর প্রত্যক্ষ ও সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং শ্বশুরবাড়ির অনুপ্রেরণায় তিনি রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় স্বামীর চাকুরিস্থল সিলেট থেকে সেখানকার সভাসমিতিতে নিয়মিত যোগ দিতেন। ১৯৫৩ সালে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য তিনি 'রাণী এলিজাবেথ করোনেশন মেডেল' লাভ করেন। আর ওই বছরেই তিনি প্রাইভেটে বি.এ পাশ করেন। [১] ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচনে শ্বশুরবাড়ি কুষ্টিয়ার নির্বাচনী এলাকায় তিনি মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে এমএলএ নির্বাচিত হন। কুষ্টিয়ার বস্ত্রকল মোহিনী মিলের শ্রমিকদের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার কারণে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি দেড়মাস কারাবন্দি অবস্থায় থাকেন। বদরুন্নেসা আহমেদ তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬০ সালে তৎকালীন মুসলিম গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর পেশা জীবন শুরু হয়। সে সময় তিনি 'উইমেন্স হেলথ' নামে ইংরাজী ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজের উপ-অধ্যক্ষা হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে তিনি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনৈতিক জীবন

সম্পাদনা

১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পুনরায় এমএনএ নির্বাচিত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাঁর স্বামীকে সাসপেন্ড করে। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড শুরু করলে তিনি আশ্রয়চ্যুত হয়ে কোনোক্রমে সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বামী দেশে ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর বাংলাদেশে ফেরেন। ১৯৭২-৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা-সভানেত্রী ছিলেন। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে শরণার্থী আশ্রম পরিদর্শন শেষে রিপোর্ট পেশ করা, শরণার্থীদের মাঝে চিকিৎসাসহ ত্রাণ সামগ্রীর সুষ্ঠু বিতরণ ও শরণার্থীদের থেকে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পান। যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের পুনর্বাসনে সরকারের নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনেনর পৃষ্ঠপোষক মনোনীত হন। তিনি ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। [৩]

মৃত্যু ও সম্মাননা

সম্পাদনা
 
বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ

বেগম বদরুন্নেসা ১৯৭৪ সালের ২৫ মে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন।[২] তার নামানুসারে ঢাকার বকশীবাজার মহিলা কলেজের নামকরণ করা হয় বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ। রাজনীতি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার”[৪][৫] হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে।[৬] ২০১৭ সালে তার নামে ট্রাস্ট গঠন করা হয়। ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ। ২০১৯ সালের ৮ মার্চ বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ ট্রাস্ট নারী সম্মাননা প্রবর্তন করা হয়।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪৪৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "বেগম বদরুন্নেছা আহমেদ,যার নামে ঢাকার বদরুন্নেছা কলেজ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-১৫ 
  3. "৫০ বছরে লালমাটিয়া মহিলা কলেজ"দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৪ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  4. "স্বাধীনতা পদকের অর্থমূল্য বাড়ছে"কালেরকন্ঠ অনলাইন। ২ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৭ 
  5. "এবার স্বাধীনতা পদক পেলেন ১৬ ব্যক্তি ও সংস্থা"এনটিভি অনলাইন। ২৪ মার্চ ২০১৬। ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৭ 
  6. "স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের তালিকা"মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০১৭