ভারতীয় গিরগিটি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Added
ট্যাগ: পুনর্বহালকৃত মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
২৫ নং লাইন:
 
'''ভারতীয় গিরগিটি''' (''Chamaeleo zeylanicus'')<ref name = "col40449">Laurenti, J. N. (1768) Specimen medicum, exhibens synopsin reptilium emendatam cum experimentis circa venena et antidota reptilium austracorum, quod authoritate et consensu., Vienna, Joan. Thomae, 217 pp.</ref> গিরগিটি প্রজাতির সদস্য, যা প্রধানত [[ভারত]], [[শ্রীলঙ্কা]] ও [[দক্ষিণ এশিয়া|দক্ষিণ এশিয়ার]] অন্যান্য জায়গায় দেখা যায়। অন্যান্য গিরগিটি প্রজাতির মতো এদেরও লম্বা জিভ ও পা আছে। আঁকড়ে ধরতে সক্ষম লেজ ও স্বাধীন সঞ্চারনক্ষম চোখ এদের মধ্যে বিদ্যমান। এরা তাদের গাত্রবর্ণ পরিবর্তন করতে সক্ষম।
 
মন্দিরের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এক বিশেষ শ্রেনীর নর্ত্তকী মেয়েদের নিযুক্তি করা হয়েছিল যাহাদের দেবদাসী বলা হ'ত। দেবদাসী অর্থাৎ দেবতার দাসী। দেবতার প্রসন্নের উদ্দেশ্যে করা দেবদাসীর নৃত্যকে দেবদাসী নৃত্য বলা হয় । কলহেনের রাজতরংগিণী, কৌটিল্যের অর্থশ্রাস্ত্র, দামোদরের কুট্টনীমতম ইত্যাদি গ্রন্থে দেবদাসীর সমন্ধে উল্লেখ করা আছে । সোমনাথ মন্দিরে দেবদাস নৃত্যের কথা জানা যায় । পদ্ম পুরান ও ভয়িষ্য পুরানে ইহার কথা উল্লেখ আছে । কালিদাসের মেঘদুত বধ কাব্যে এই নৃত্যের কথা বর্ণনা করেছিলেন । ভারতের বিভিন্ন স্থানে দেবদাসী নৃত্যের কথা জানা যায় কিন্তু স্থানভেদে নাম বিভিন্ন ।
 
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ এর পেছনে আছে চরম দারিদ্র্য, জাতিভেদ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷ এরপর অন্য কোনো পুরুষ ঐ মেয়েটির স্বামী হতে পারে না৷ খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাঁদের সারা জীবন কাটে কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হয়ে৷ কিংবা সমাজের উচ্চ বর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়৷ মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামন্ত প্রভুদের যোগসাজশে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের ওপর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিকে দেয়া হয় ধর্মীয় শিলমোহর৷ উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের৷
 
সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ' করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে – এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ঐ অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন৷ এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৮ সালে৷ আশা ছিল, এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হবে৷ কিন্তু তা হয়নি৷ এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িষায় এবং গুজরাটে দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজে ব্যবহার করা হয়৷ দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী৷ কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী৷
 
প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে দেবদাসী সাত প্রকারের ছিলো।
 
১/দত্তা - যে মন্দিরে ভক্তিভাবের কারনে স্বেচ্ছায় দেবতার সেবায় নিজেকে অর্পণ করতো তাদের দত্তা বলা হতো। এদেরকে দেবীর মর্যাদা দেয়া হতো।
 
২/বীকৃতা - যে অর্থের পরিবর্তে নিজেকে বিক্রি করে দিত। এরা মন্দির পরিষ্কারের কাজ করতো।
 
৩/ভৃত্যা - যে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য মন্দিরে নৃত্য, গীত পরিবেশন করতো।
 
৪/ভক্তা - এরা নিজের বাড়িতেই থাকতো মন্দিরে কাজের উদ্দেশ্যে যেত।
 
৫/হৃতা - রাজরাজারা এদেরকে অন্য রাজ্য থেকে হরণ করে মন্দিরে দিন করে দিত। এরা প্রকৃত পক্ষেই দাসী ছিলো।
 
৬/অলংকারা - রাজরাজাগণ সর্বগুন সম্পন্ন যেসব নারীগণকে মন্দিরে উপহার দিত তাদের অলংকারা বলা হতো।
 
৭/নগরী - বিধবা এবং আশ্রয়হীন মহিলারা আশ্রয়ের জন্য মন্দিরে নিজেকে অর্পণ করতো। এদেরকে নগরী বলা হতো।
 
দেবদাসীর অর্থ মন্দিরের সেবিকা, বর্ধিত অর্থে মন্দিরাঙ্গনের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা। এই রীতি আসলে "ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি" (Sacred prostitution)-র পর্যায়ে পড়ে। ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ যৌন সংগম করে নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে। এ ধরনের কাজে যে ব্যক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী বা ধর্মীয় পতিতা। দেবদাসীরা ঈশ্বরের সেবিকা। তাদের অতীতে বলা হতো "কলাবন্তী" বা যারা শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। অভিজাত শ্রেণি তাদেরকে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করত। তাদের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মন্দির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, প্রদীপে তেল ঢালা, পূজামন্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান-নৃত্য করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস দেওয়া। অবশ্য এইসবেরও মধ্যে ছিল, পুরোহিতদের শয্যাসঙ্গিনী, যৌন লালসার শিকার হওয়া।গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷
 
দক্ষিণ ভারতে ‘দেবদাসী’ বলা হলেও উত্তরভারতে এই রীতির নাম ছিল ‘মুখি’। এই প্রথা যখন প্রচলিত হয়, তখন প্রথা এবং প্রথার সঙ্গে জড়িত দেবদাসীদের অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হত। তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ, জমি বরাদ্দ থাকত। তারা হয়ে ওঠে মন্দিরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের নাচ-গান ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল দেবতাদের আরাধনা। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ নিজেদের কন্যাকে উৎসর্গ করতেন দেবদাসী হওয়ার জন্য। বয়ঃসন্ধির আগেই করা হত উৎসর্গ। তারা যেন ভালো দেবদাসী হয়ে উঠতে পারে তাই ছোটবেলা থেকেই নিতে হত নাচ গানের কঠোর প্রশিক্ষণ। কন্যা উৎসর্গ করার রীতি দক্ষিণ ভারতে ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ নামে পরিচিত। ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ মানে দেবতার সঙ্গে বিয়ে এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ এর অর্থ নিজেকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা। ইতিহাসখ্যাত নরপতি কৃষ্ণদেব রায়ের বিজয়নগর পরিভ্রমণের বিবরণেও(১৫২০-২২ সাল) উঠে এসেছে দেবদাসীদের বৃত্তান্ত। কৃষ্ণদেব রায় যখন রাইচুর অভিযানে যাত্রা করেন তখন তার বাহিনীতে নাকি সাত লাখ তিন হাজার পদাতিক, বত্ৰিশ হাজার ছয় শ’ অশ্বারোহী ছিল। এই বিরাট বাহিনীর সঙ্গে প্রমোদ-কন্যা দেবদাসীও ছিল প্রায় কুড়ি হাজার। কিন্তু এক ব্যাপারে কৃষ্ণদেব রায় রীতিমত সদাচারী ছিলেন বলা চলে। তার অন্দরে রানীদের বারো হাজার দাসী এবং সহচরী থাকলেও বিজয়নগর অধিপতির পত্নী ছিল মাত্র বারোজন। বলা অনাবশ্যক, তার পূর্বসূরীরা সবাই কিন্তু এমন সদাচারী নরপতি ছিলেন না।
 
তবে, এটি ছিল প্রথম দিকের অবস্থা। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই সম্মানের উৎসর্গ আর এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। বোঝা গেল‚ পাথরের বিগ্রহকে উপেক্ষা করে মানুষই ভোগ করতে পারে ‘দেবদাসীকে’। পুরোহিতদের অবক্ষয় আর যৌন-লালসার কারণে মেয়েদের কেনা বেচা শুরু হল। এমনকি লুঠ করে পর্যন্ত নিয়ে আসা হত। আর এর পেছনে দারিদ্র্যতা মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতো। হতদরিদ্র ও নীচু জাতের মা বাবা’রা তাদের কুমারী মেয়েকে ঋতুবতী হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। সেখানে প্রথমে কুমারী মেয়েদের নামমাত্র মূল্যে নিলাম করা হত। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভগবানকে উৎসর্গের নামে কল্পিত দেবতার সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার থাকত মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। দেবতার সঙ্গে বিয়ের পর গরিব ঘরের সেই মেয়ে হয়ে যায় দেবদাসী বা যোগিনী। আক্ষরিক অর্থে সেবাদাসী বা যৌনদাসী। এরপর সারা জীবন আর অন্য কোনো পুরুষ মেয়েটিকে আর বিবাহ করতে পারত না। নামমাত্র খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরেই কাটাতে হয় তাদের জীবন। যৌন লালসার শিকার হতে হয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে অন্যান্য পুরুষদের। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেবদাসীদের আগমন ঘটায় তাদের মধ্যে তৈরি হয় শ্রেণি। যাকে দেবতার জন্য উৎসর্গ করা হত‚ তিনি "দত্তা", লুঠ করে আনা হলে তিনি "হ্রুতা", কেনাবেচা করা হলে সেই মেয়ে "বিক্রিতা"‚ কেউ নিজেই নিজেকে দেবতার পায়ে উৎসর্গ করলে তিনি "ভক্ত দেবদাসী"‚ অলঙ্কারসহ কাউকে উৎসর্গ করা হলে তিনি "সালঙ্কারা", আর যদি কেউ দেবদাসী হয়ে নিয়মিত পারিশ্রমিক পেতেন‚ তিনি "গোপীকা" বা "রুদ্রাঙ্গিকা"।
 
কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রতেও দেবদাসীদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। কৌটিল্য দেবদাসী প্রথা পর্যবেক্ষণের পর স্পষ্টভাবে বলেন যে, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে বা অব্যাহতি নিয়েছে তাদের এবং সেসঙ্গে বিধবা, পঙ্গু মহিলা, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, শাস্তিপণ পরিশোধে ব্যর্থ মহিলা, গণিকার মা এবং পশম, তুলা, শণ ইত্যাদি বাছাই-এর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত। কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানীর মতে গর্ভধারণ ও পুনঃপ্রজননের দেবীর পূজাকে ভিত্তি করে দেবদাসী শ্রেণির উদ্ভব হয়। মধ্যযুগীয় লৌকিক বিবরণ থেকে জানা যায়, গুজরাটের চার হাজার মন্দিরে দেবদাসী ছিল কুড়ি হাজার,অনেক জায়গায় এদের নাচনি বলা হতো।
 
সে সময়ের রাজারা নিজ স্ত্রী বাদে রক্ষিতা রাখাটা প্রায় নিয়ম করে ফেলে। এসব দেবদাসীদের কাউকে পছন্দ হলে, রাজারা চাইলেই তাকে নিজের করে নিয়ে আসতে পারতেন। নিঃসন্তান কোনো দম্পতির যখন বাচ্চা হত না তখন খোঁজ পড়ত দেবদাসীর। তাদের পছন্দ অনুযায়ী দেবদাসীকে নিঃসন্তান পরিবারে নিয়োজিত করা হতো পরিবার এবং পারিবারিক সম্পত্তি বিলোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক্ষেত্রে মেয়েদের ঈশ্বরের নিকট উৎসর্গ করে তাদেরকে উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য যৌনমিলনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব সন্তানরা পরবর্তীকালে ঠাকুরদাদার নাম ধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।
 
ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার এবং ইউ. এন. ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরীব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী সম্প্রদায়৷ সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে৷ অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে৷ বৌদ্ধমঠগুলোতে সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যে সব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি।
 
ইংরেজ আমলেও ছিল এই প্রথার অস্তিত্ব। ইংরেজ রাজ-পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য তৎকালে চেষ্টার কোন ক্রটি ছিল না। দেশে তখন চলতি প্রবাদ—"খুলক-ই-খুদা, মুলুক-ই-সিরকার, হুকুম-ই-সাহিবান আলিসান" অর্থাৎ নরকুল ঈশ্বরের, মাটি সরকারের, আর ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় তা সব সাহেবদের। ১৭৯১ সনে কর্ণাটকের নবাব মাদ্রাজের লাট-বাহাদুরকে ভোজের পরে নাচ সহযোগে আপ্যায়ন করেছিলেন। সার গ্রান্ট ডাফ-এর সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় ভারতীয় নর্তকীরা ও দেবদাসীরা অতিথির আবাহন করেছিলেন পশ্চিমী গীতবাদ্যে।
 
আধুনিক যুগেও ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভারতের কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের ইয়াল্লামা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে আড়াই লাখ মেয়ে নিয়োগ করা হয়। নেপালে বিশেষ করে দোতি, বাইতাদি এবং দাদেলধুরা জেলাসমূহে দেবদাসীদের এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সনাতন প্রথা হিসেবে অতি প্রচলিত। ঊনবিংশ শতকের সূচনায় ফ্রান্সিস বুকানন নামে এক ইংরেজ অভিযাত্রী দক্ষিণ ভারতে আসেন। তিনি লিখে গেছেন, ‘কাঞ্চিপুরমের মন্দিরে দেবদাসী আছে কমপক্ষে একশ’। বিখ্যাত ভারতশাস্ত্রবিদ স্যার মনিয়ের উইলিয়ামস তাঞ্জোর মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন গত শতকের শেষ দিকে । তখনও সেখানে ছিলেন ১৫জন দেবদাসী।
 
প্রথাটি যে নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর, তা আস্তে আস্তে মানুষ বুঝতে পারে। ১৯০৬ থেকে ৭ সালের দিকে ভারত সরকারকে পতিত মেয়েদের রক্ষা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সনদে সঁই করতে হয়। এই সনদের ফলেই দেবদাসীও আলোচনায় চলে আসে। ১৯১২ সালে পুরানো দিনের ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলে হঠাৎ নতুন ধরনের বিল উত্থাপিত হয়। তাও একটি নয়, পরপর তিনটি। তিনটির আবেদন একই– “দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদ চাই”। ভারত সরকার জনসাধারণের ধর্মানুভূতি নিয়ে তখন বেশ সতর্ক ছিল। তাদের মতামত ছিল এ প্রথার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে জড়িত। তাই কোনো আইন প্রণয়নের আগে সেখানকার অভিমত জানা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত সরকারকে দায়িত্ব দেয়া হল তাদের জনগণের এ ব্যাপারে কি মতামত তা জানতে। তাদের পাঠানো মতামতের ভিত্তিতে ১৯১৩ সনে নিযুক্ত হলো কেন্দ্রীয় সিলেক্ট কমিটি। তারা রিপোর্ট জমা দেয় পরের বছর মার্চে। সেপ্টেম্বরে উত্থাপিত হয় সরকারি বিল কিন্তু ভাগ্য দেবদাসীদের খুব একটা সহায়তা করতে পারেনি। ‘বিল’ ভাল করে জানাজানি হতে না হতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মন্দিরের অঙ্গণের চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র তখন সরকারের জন্য অনেক জরুরি। দেবদাসীকে নাচের আসরে ছেড়ে তারা লড়াইয়ে মনোযোগ দিলেন।
 
কয়েক বছর পরে আবার আলোচনায় আসে দেবদাসী। ডাঃ হরিসিং গৌর মাদ্রাজ বিধানসভায় ১৯২২ সনে তাদের সম্পর্কে আইন দাবি করে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯২৭ সনে কেন্দ্রীয় পরিষদে একই প্রস্তাব পেশ করলেন রামদাস পানতুলু। দু’জনের প্রস্তাবই গৃহীত হলো কিন্তু আইন পাস হলো না কোথাও। সরকার পক্ষ কখনো সংশোধিত প্যানেল কোড দেখালেন তো কখনো সারদা আইনের (১৯২৭) দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তখন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এই প্রথার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করে বলেছিলেন– "কেউ কি দেখাতে পারেন হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রে দেবদাসীর বিধান?" কোনো শাস্ত্রজ্ঞ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। একই প্রশ্ন তুলেছেন গান্ধীজিও, দক্ষিণভারত ভ্রমণে এসে তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। তবে যদিও হিন্দুশাস্ত্রে দেবদাসীর বিধান পাওয়া যায়।[১][২]
 
অবশেষে দেবতার নামে নারীদের ‘উৎসর্গ' করার কুপ্রথা ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয় না। পরবর্তীতে, ২০১৫ সালে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে কর্ণাটক রাজ্যকে এই প্রথা তুলে দিতে নির্দেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এ প্রথা নিয়ে অভিযোগ করে। বর্তমানে ভারতের প্রায় সব রাজ্যই আইন করে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করেছে। এসব আইনের মধ্যে বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, দেবদাসী মাদ্রাজ আইন ১৯৪৭, কর্ণাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২, অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী আইন ১৯৮৮ অন্যতম। তাও সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় আজও রয়েছে অন্ততপক্ষে ৩৫ হাজার দেবদাসী৷ এদের মধ্যে যৌবন-উত্তীর্ণ অনেকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা শোচনীয়৷ এদের অনেকেই আজ রাস্তার ভিখারি৷ রূপ-যৌবন হারানোর পর, এদের যেন কোথাও ঠাঁই নেই – না মন্দিরে, না ধনীদের ঘরে।
 
অর্থাৎ ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির অধঃপতন হতে শুরু করে বুদ্ধ সংস্কৃতির অবসানের পর কারণ বুদ্ধ সংস্কৃতি বা জীবন বোধ ছিল সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির যুক্তিগ্রাহ্য পরিণতি।
 
 
এই সামজিক তথা ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত৷ এর ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক উৎকীর্ণ আছে বিভিন্ন মন্দির গাত্রে৷ গুজরাটে প্রায় চার হাজার মন্দিরে ছিল প্রায় ২০ হাজার দেবদাসী যাঁদের নাচনিও বলা হতো৷ মন্দিরে পূজার কাজ ছাড়াও এদের নাচ গান করতে হত৷ ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার এবং ইউ এন ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরিব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী সম্প্রদায়৷ সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে৷ অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে৷ বৌদ্ধমঠগুলির বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে – তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ কারণ প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র যেমন জাতক, কৌটিল্য কিংবা বাৎসায়নের কামশাস্ত্রে দেবদাসীর উল্লেখ পাওয়া যায় না৷
 
ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যে সব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি৷ এই লজ্জাজনক অমানবিক কুপ্রথা নির্মূল করতে বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়৷ কিন্তু উপযুক্ত সচেতনতা বা মোটিভেশন না থাকায় তা সফল হচ্ছেনা৷ এইচআইভি এবং যৌনবাহিত সংক্রমণ সম্পর্কে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, কী ধরনের চিকিৎসা করাতে হবে সে বিষয়ে সচেতনতা জাগানোর পাশাপাশি দেবদাসীদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করতে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছে কিছু স্বয়ংসেবী সংগঠন৷
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ এর পেছনে আছে চরম দারিদ্র্য, জাতিভেদ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷ এরপর অন্য কোনো পুরুষ ঐ মেয়েটির স্বামী হতে পারে না৷ খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাঁদের সারা জীবন কাটে কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হয়ে৷ কিংবা সমাজের উচ্চ বর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়৷ মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামন্ত প্রভুদের যোগসাজশে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের ওপর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিকে দেয়া হয় ধর্মীয় শিলমোহর৷ উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের৷
 
সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ' করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে – এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ঐ অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন৷ এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৮ সালে৷ আশা ছিল, এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হবে৷ কিন্তু তা হয়নি৷ এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িষায় এবং গুজরাটে দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজে ব্যবহার করা হয়৷ দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী৷ কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী৷
 
প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে দেবদাসী সাত প্রকারের ছিলো।
 
১/দত্তা - যে মন্দিরে ভক্তিভাবের কারনে স্বেচ্ছায় দেবতার সেবায় নিজেকে অর্পণ করতো তাদের দত্তা বলা হতো। এদেরকে দেবীর মর্যাদা দেয়া হতো।
 
২/বীকৃতা - যে অর্থের পরিবর্তে নিজেকে বিক্রি করে দিত। এরা মন্দির পরিষ্কারের কাজ করতো।
 
৩/ভৃত্যা - যে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য মন্দিরে নৃত্য, গীত পরিবেশন করতো।
 
৪/ভক্তা - এরা নিজের বাড়িতেই থাকতো মন্দিরে কাজের উদ্দেশ্যে যেত।
 
৫/হৃতা - রাজরাজারা এদেরকে অন্য রাজ্য থেকে হরণ করে মন্দিরে দিন করে দিত। এরা প্রকৃত পক্ষেই দাসী ছিলো।
 
৬/অলংকারা - রাজরাজাগণ সর্বগুন সম্পন্ন যেসব নারীগণকে মন্দিরে উপহার দিত তাদের অলংকারা বলা হতো।
 
৭/নগরী - বিধবা এবং আশ্রয়হীন মহিলারা আশ্রয়ের জন্য মন্দিরে নিজেকে অর্পণ করতো। এদেরকে নগরী বলা হতো।
 
দেবদাসীর অর্থ মন্দিরের সেবিকা, বর্ধিত অর্থে মন্দিরাঙ্গনের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা। এই রীতি আসলে "ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি" (Sacred prostitution)-র পর্যায়ে পড়ে। ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ যৌন সংগম করে নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে। এ ধরনের কাজে যে ব্যক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী বা ধর্মীয় পতিতা। দেবদাসীরা ঈশ্বরের সেবিকা। তাদের অতীতে বলা হতো "কলাবন্তী" বা যারা শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। অভিজাত শ্রেণি তাদেরকে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করত। তাদের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মন্দির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, প্রদীপে তেল ঢালা, পূজামন্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান-নৃত্য করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস দেওয়া। অবশ্য এইসবেরও মধ্যে ছিল, পুরোহিতদের শয্যাসঙ্গিনী, যৌন লালসার শিকার হওয়া।গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷
 
দক্ষিণ ভারতে ‘দেবদাসী’ বলা হলেও উত্তরভারতে এই রীতির নাম ছিল ‘মুখি’। এই প্রথা যখন প্রচলিত হয়, তখন প্রথা এবং প্রথার সঙ্গে জড়িত দেবদাসীদের অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হত। তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ, জমি বরাদ্দ থাকত। তারা হয়ে ওঠে মন্দিরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের নাচ-গান ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল দেবতাদের আরাধনা। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ নিজেদের কন্যাকে উৎসর্গ করতেন দেবদাসী হওয়ার জন্য। বয়ঃসন্ধির আগেই করা হত উৎসর্গ। তারা যেন ভালো দেবদাসী হয়ে উঠতে পারে তাই ছোটবেলা থেকেই নিতে হত নাচ গানের কঠোর প্রশিক্ষণ। কন্যা উৎসর্গ করার রীতি দক্ষিণ ভারতে ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ নামে পরিচিত। ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ মানে দেবতার সঙ্গে বিয়ে এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ এর অর্থ নিজেকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা। ইতিহাসখ্যাত নরপতি কৃষ্ণদেব রায়ের বিজয়নগর পরিভ্রমণের বিবরণেও(১৫২০-২২ সাল) উঠে এসেছে দেবদাসীদের বৃত্তান্ত। কৃষ্ণদেব রায় যখন রাইচুর অভিযানে যাত্রা করেন তখন তার বাহিনীতে নাকি সাত লাখ তিন হাজার পদাতিক, বত্ৰিশ হাজার ছয় শ’ অশ্বারোহী ছিল। এই বিরাট বাহিনীর সঙ্গে প্রমোদ-কন্যা দেবদাসীও ছিল প্রায় কুড়ি হাজার। কিন্তু এক ব্যাপারে কৃষ্ণদেব রায় রীতিমত সদাচারী ছিলেন বলা চলে। তার অন্দরে রানীদের বারো হাজার দাসী এবং সহচরী থাকলেও বিজয়নগর অধিপতির পত্নী ছিল মাত্র বারোজন। বলা অনাবশ্যক, তার পূর্বসূরীরা সবাই কিন্তু এমন সদাচারী নরপতি ছিলেন না।
 
তবে, এটি ছিল প্রথম দিকের অবস্থা। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই সম্মানের উৎসর্গ আর এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। বোঝা গেল‚ পাথরের বিগ্রহকে উপেক্ষা করে মানুষই ভোগ করতে পারে ‘দেবদাসীকে’। পুরোহিতদের অবক্ষয় আর যৌন-লালসার কারণে মেয়েদের কেনা বেচা শুরু হল। এমনকি লুঠ করে পর্যন্ত নিয়ে আসা হত। আর এর পেছনে দারিদ্র্যতা মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতো। হতদরিদ্র ও নীচু জাতের মা বাবা’রা তাদের কুমারী মেয়েকে ঋতুবতী হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। সেখানে প্রথমে কুমারী মেয়েদের নামমাত্র মূল্যে নিলাম করা হত। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভগবানকে উৎসর্গের নামে কল্পিত দেবতার সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার থাকত মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। দেবতার সঙ্গে বিয়ের পর গরিব ঘরের সেই মেয়ে হয়ে যায় দেবদাসী বা যোগিনী। আক্ষরিক অর্থে সেবাদাসী বা যৌনদাসী। এরপর সারা জীবন আর অন্য কোনো পুরুষ মেয়েটিকে আর বিবাহ করতে পারত না। নামমাত্র খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরেই কাটাতে হয় তাদের জীবন। যৌন লালসার শিকার হতে হয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে অন্যান্য পুরুষদের। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেবদাসীদের আগমন ঘটায় তাদের মধ্যে তৈরি হয় শ্রেণি। যাকে দেবতার জন্য উৎসর্গ করা হত‚ তিনি "দত্তা", লুঠ করে আনা হলে তিনি "হ্রুতা", কেনাবেচা করা হলে সেই মেয়ে "বিক্রিতা"‚ কেউ নিজেই নিজেকে দেবতার পায়ে উৎসর্গ করলে তিনি "ভক্ত দেবদাসী"‚ অলঙ্কারসহ কাউকে উৎসর্গ করা হলে তিনি "সালঙ্কারা", আর যদি কেউ দেবদাসী হয়ে নিয়মিত পারিশ্রমিক পেতেন‚ তিনি "গোপীকা" বা "রুদ্রাঙ্গিকা"।
 
কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রতেও দেবদাসীদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। কৌটিল্য দেবদাসী প্রথা পর্যবেক্ষণের পর স্পষ্টভাবে বলেন যে, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে বা অব্যাহতি নিয়েছে তাদের এবং সেসঙ্গে বিধবা, পঙ্গু মহিলা, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, শাস্তিপণ পরিশোধে ব্যর্থ মহিলা, গণিকার মা এবং পশম, তুলা, শণ ইত্যাদি বাছাই-এর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত। কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানীর মতে গর্ভধারণ ও পুনঃপ্রজননের দেবীর পূজাকে ভিত্তি করে দেবদাসী শ্রেণির উদ্ভব হয়। মধ্যযুগীয় লৌকিক বিবরণ থেকে জানা যায়, গুজরাটের চার হাজার মন্দিরে দেবদাসী ছিল কুড়ি হাজার,অনেক জায়গায় এদের নাচনি বলা হতো।
 
সে সময়ের রাজারা নিজ স্ত্রী বাদে রক্ষিতা রাখাটা প্রায় নিয়ম করে ফেলে। এসব দেবদাসীদের কাউকে পছন্দ হলে, রাজারা চাইলেই তাকে নিজের করে নিয়ে আসতে পারতেন। নিঃসন্তান কোনো দম্পতির যখন বাচ্চা হত না তখন খোঁজ পড়ত দেবদাসীর। তাদের পছন্দ অনুযায়ী দেবদাসীকে নিঃসন্তান পরিবারে নিয়োজিত করা হতো পরিবার এবং পারিবারিক সম্পত্তি বিলোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক্ষেত্রে মেয়েদের ঈশ্বরের নিকট উৎসর্গ করে তাদেরকে উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য যৌনমিলনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব সন্তানরা পরবর্তীকালে ঠাকুরদাদার নাম ধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।
 
ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার এবং ইউ. এন. ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরীব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী সম্প্রদায়৷ সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে৷ অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে৷ বৌদ্ধমঠগুলোতে সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যে সব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি।
 
ইংরেজ আমলেও ছিল এই প্রথার অস্তিত্ব। ইংরেজ রাজ-পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য তৎকালে চেষ্টার কোন ক্রটি ছিল না। দেশে তখন চলতি প্রবাদ—"খুলক-ই-খুদা, মুলুক-ই-সিরকার, হুকুম-ই-সাহিবান আলিসান" অর্থাৎ নরকুল ঈশ্বরের, মাটি সরকারের, আর ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় তা সব সাহেবদের। ১৭৯১ সনে কর্ণাটকের নবাব মাদ্রাজের লাট-বাহাদুরকে ভোজের পরে নাচ সহযোগে আপ্যায়ন করেছিলেন। সার গ্রান্ট ডাফ-এর সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় ভারতীয় নর্তকীরা ও দেবদাসীরা অতিথির আবাহন করেছিলেন পশ্চিমী গীতবাদ্যে।
 
আধুনিক যুগেও ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভারতের কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের ইয়াল্লামা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে আড়াই লাখ মেয়ে নিয়োগ করা হয়। নেপালে বিশেষ করে দোতি, বাইতাদি এবং দাদেলধুরা জেলাসমূহে দেবদাসীদের এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সনাতন প্রথা হিসেবে অতি প্রচলিত। ঊনবিংশ শতকের সূচনায় ফ্রান্সিস বুকানন নামে এক ইংরেজ অভিযাত্রী দক্ষিণ ভারতে আসেন। তিনি লিখে গেছেন, ‘কাঞ্চিপুরমের মন্দিরে দেবদাসী আছে কমপক্ষে একশ’। বিখ্যাত ভারতশাস্ত্রবিদ স্যার মনিয়ের উইলিয়ামস তাঞ্জোর মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন গত শতকের শেষ দিকে । তখনও সেখানে ছিলেন ১৫জন দেবদাসী।
 
প্রথাটি যে নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর, তা আস্তে আস্তে মানুষ বুঝতে পারে। ১৯০৬ থেকে ৭ সালের দিকে ভারত সরকারকে পতিত মেয়েদের রক্ষা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সনদে সঁই করতে হয়। এই সনদের ফলেই দেবদাসীও আলোচনায় চলে আসে। ১৯১২ সালে পুরানো দিনের ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলে হঠাৎ নতুন ধরনের বিল উত্থাপিত হয়। তাও একটি নয়, পরপর তিনটি। তিনটির আবেদন একই– “দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদ চাই”। ভারত সরকার জনসাধারণের ধর্মানুভূতি নিয়ে তখন বেশ সতর্ক ছিল। তাদের মতামত ছিল এ প্রথার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে জড়িত। তাই কোনো আইন প্রণয়নের আগে সেখানকার অভিমত জানা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত সরকারকে দায়িত্ব দেয়া হল তাদের জনগণের এ ব্যাপারে কি মতামত তা জানতে। তাদের পাঠানো মতামতের ভিত্তিতে ১৯১৩ সনে নিযুক্ত হলো কেন্দ্রীয় সিলেক্ট কমিটি। তারা রিপোর্ট জমা দেয় পরের বছর মার্চে। সেপ্টেম্বরে উত্থাপিত হয় সরকারি বিল কিন্তু ভাগ্য দেবদাসীদের খুব একটা সহায়তা করতে পারেনি। ‘বিল’ ভাল করে জানাজানি হতে না হতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মন্দিরের অঙ্গণের চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র তখন সরকারের জন্য অনেক জরুরি। দেবদাসীকে নাচের আসরে ছেড়ে তারা লড়াইয়ে মনোযোগ দিলেন।
 
কয়েক বছর পরে আবার আলোচনায় আসে দেবদাসী। ডাঃ হরিসিং গৌর মাদ্রাজ বিধানসভায় ১৯২২ সনে তাদের সম্পর্কে আইন দাবি করে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯২৭ সনে কেন্দ্রীয় পরিষদে একই প্রস্তাব পেশ করলেন রামদাস পানতুলু। দু’জনের প্রস্তাবই গৃহীত হলো কিন্তু আইন পাস হলো না কোথাও। সরকার পক্ষ কখনো সংশোধিত প্যানেল কোড দেখালেন তো কখনো সারদা আইনের (১৯২৭) দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তখন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এই প্রথার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করে বলেছিলেন– "কেউ কি দেখাতে পারেন হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রে দেবদাসীর বিধান?" কোনো শাস্ত্রজ্ঞ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। একই প্রশ্ন তুলেছেন গান্ধীজিও, দক্ষিণভারত ভ্রমণে এসে তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। তবে যদিও হিন্দুশাস্ত্রে দেবদাসীর বিধান পাওয়া যায়।[১][২]
 
অবশেষে দেবতার নামে নারীদের ‘উৎসর্গ' করার কুপ্রথা ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয় না। পরবর্তীতে, ২০১৫ সালে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে কর্ণাটক রাজ্যকে এই প্রথা তুলে দিতে নির্দেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এ প্রথা নিয়ে অভিযোগ করে। বর্তমানে ভারতের প্রায় সব রাজ্যই আইন করে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করেছে। এসব আইনের মধ্যে বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, দেবদাসী মাদ্রাজ আইন ১৯৪৭, কর্ণাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২, অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী আইন ১৯৮৮ অন্যতম। তাও সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় আজও রয়েছে অন্ততপক্ষে ৩৫ হাজার দেবদাসী৷ এদের মধ্যে যৌবন-উত্তীর্ণ অনেকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা শোচনীয়৷ এদের অনেকেই আজ রাস্তার ভিখারি৷ রূপ-যৌবন হারানোর পর, এদের যেন কোথাও ঠাঁই নেই – না মন্দিরে, না ধনীদের ঘরে।
 
অর্থাৎ ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির অধঃপতন হতে শুরু করে বুদ্ধ সংস্কৃতির অবসানের পর কারণ বুদ্ধ সংস্কৃতি বা জীবন বোধ ছিল সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির যুক্তিগ্রাহ্য পরিণতি।
 
 
এই সামজিক তথা ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত৷ এর ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক উৎকীর্ণ আছে বিভিন্ন মন্দির গাত্রে৷ গুজরাটে প্রায় চার হাজার মন্দিরে ছিল প্রায় ২০ হাজার দেবদাসী যাঁদের নাচনিও বলা হতো৷ মন্দিরে পূজার কাজ ছাড়াও এদের নাচ গান করতে হত৷ ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার এবং ইউ এন ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরিব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী সম্প্রদায়৷ সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে৷ অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে৷ বৌদ্ধমঠগুলির বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে – তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ কারণ প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র যেমন জাতক, কৌটিল্য কিংবা বাৎসায়নের কামশাস্ত্রে দেবদাসীর উল্লেখ পাওয়া যায় না৷
 
ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যে সব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি৷ এই লজ্জাজনক অমানবিক কুপ্রথা নির্মূল করতে বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়৷ কিন্তু উপযুক্ত সচেতনতা বা মোটিভেশন না থাকায় তা সফল হচ্ছেনা৷ এইচআইভি এবং যৌনবাহিত সংক্রমণ সম্পর্কে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, কী ধরনের চিকিৎসা করাতে হবে সে বিষয়ে সচেতনতা জাগানোর পাশাপাশি দেবদাসীদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করতে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছে কিছু স্বয়ংসেবী সংগঠন৷
 
== বাসস্থান ==