বাংলার নবজাগরণ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
InternetArchiveBot (আলোচনা | অবদান)
১টি উৎস উদ্ধার করা হল ও ০টি অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হল। #IABot (v2.0beta15)
NahidSultanBot (আলোচনা | অবদান)
বট নিবন্ধ পরিষ্কার করেছে। কোন সমস্যায় এর পরিচালককে জানান।
২৫ নং লাইন:
== পটভূমিকা ==
 
বাংলার নবজাগরণ অনেক আধুনিক পণ্ডিতের মতে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, আবার অনেকের মতে গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ চলে যাকে যথার্থই ইউরোপীয় ধারার নবজাগরণ বলা যায়। তাঁরাতারা বিশ্বাস করেন, [[ব্রিটিশ শাসন|ব্রিটিশ শাসনের]] প্রভাবে বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় জীবন ও বিশ্বাসের নানা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে এবং প্রশ্ন তুলতে শেখে। বলা হয়, এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার সমসাময়িক জীবনধারাকে বস্তুতান্ত্রিকভাবে সবিশেষ প্রভাবিত করে। বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক আন্দোলন, নানা সংগঠন, সমাজ ও সমিতি গঠন, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, নতুন শৈলীর বাংলা সাহিত্যের আবির্ভাব, রাজনৈতিক চেতনা এবং আরও উদীয়মান অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় এক নবজাগরণরই ইতিবাচক লক্ষণ বলে যুক্তি দেখানো হয়। নবজাগরণ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, এসব বিষয়ের মূলে ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে নবার্জিত ইউরোপীয় জ্ঞান (বিশেষ করে, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্য)। এ কথিত নবজাগরণ কেবলমাত্র বাংলার হিন্দু সমাজের উঁচু স্তরের সামান্য অংশকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করলেও শেষাবধি তা মুসলিম সমাজ (অনেকটাই অংশত) ও অন্যদের মাঝেও প্রসার লাভ করে। নবজাগরণ ছড়িয়ে যায় ঐ শতকের শেষপাদে উপমহাদেশের অন্যসব অংশেও।
 
== সভা ও বহু সমিতি ==
নবজাগরণ ভাবাপন্ন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে [[রামমোহন রায়]] , এইচ.এল.ভি ডিরোজিও ও তাঁরতার বিপ্লবী শিষ্যবৃন্দ, [[দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর]] ও তাঁরতার অনুসারীগণ, [[অক্ষয়কুমার দত্ত]] , [[ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর]] , [[মাইকেল মধুসূদন দত্ত]] , [[বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]] , [[স্বামী বিবেকানন্দ]] প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রেসেসাঁর এ নিবেদিত মনীষীবর্গ যেসব পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন তা ছিল [[যুক্তিবাদ]], [[মানবতাবাদ]], [[উপযোগবাদ]], বিজ্ঞানবাদ, ব্যক্তিবাদ, দৃষ্টবাদ, ডারউইনবাদ, সমাজবাদ ও [[জাতীয়তাবাদ]]। পুনরুজ্জীবিত বাংলার চিন্তাবিদগণ [[ফ্রান্সিস বেকন]] (১৫৬১-১৬২৬), [[আইজ্যাক নিউটন]] (১৬৪২-১৭২৭), [[জেরেমি বেনথাম]] (১৭৪৮-১৮৩২), [[টমাস পেইন]] (১৭৩৭-১৮০৯), [[অগুস্ত কোঁত]] (১৭৯৮-১৮৫৭), [[চার্লস ডারউইন]] (১৮০৯-৮২) ও [[জন স্টুয়ার্ট মিল]]-এর (১৬০৬-৭৩) মতো পাশ্চাত্যের আরও অনেক আধুনিক চিন্তাবিদ ও মনীষীর গুণগ্রাহী ও অনুসারী হয়ে ওঠেন। [[এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা)|এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল]] (প্রতিষ্ঠিত, ১৭৮৪), শ্রীরামপুরের [[ব্যাপটিস্ট মিশন]] (১৮০০), [[ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ]] (১৮০০), [[হিন্দু কলেজ]] (১৮১৭), [[ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি]] (১৮১৭), [[কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ]] (১৮৩৫), [[কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়]]-এর (১৮৫৭) মতো প্রতিষ্ঠানগুলি বাংলার নবজাগরণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে।
 
বাংলার নবজাগরণ দুই ধারায় প্রসার লাভ করে যথা, (১) ঐ সময়ে বহু সংখ্যক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হয় এবং (২) বহু সমিতি, সংগঠন ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলি পর্যায়ক্রমে নবজাগরণর দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন সংলাপ ও বিতর্কের মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। তবে নবজাগরণের সবচেয়ে দর্শনীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটে কতকগুলি সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এসব আন্দোলন ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক। নবজাগরণর আরও বড় ধরনের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় যুক্তিভিত্তিক মুক্তচিন্তার সপক্ষে পরিচালিত ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ধ্যান-ধারণার প্রসার ও বিভিন্নমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানানুসন্ধান এ সবই ছিল নবজাগরণর সুফল। বাংলার নবজাগরণ বা নবজাগরণের ফলে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয় এবং পরবর্তী সময়ে এ জাতীয়তাবাদ দেশের পরাধীনতার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
 
রামমোহন রায় একাধারে [[সংস্কৃত]], [[আরবি]], [[ফার্সি]] ভাষায় সুপণ্ডিত এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিবাদে তুহফাত-উল-মুওয়াহহিদিন [একেশ্বরবাদীদের উপহার] নামে এক যুক্তিবাদী পুস্তিকা (১৮০৩-০৪) প্রকাশ করেন। পরবর্তীসময়ে তিনি সেমেটিক একেশ্বরবাদের ধারায় উপযোগবাদের সাথে যুক্তিবাদ সংযুক্ত এবং সামাজিক অন্যায় ও বুদ্ধিবৃত্তিক কূপমণ্ডূকতা দূর করার লক্ষ্যে একটি কার্যক্রম গ্রহণ করেন। [[হিন্দু]] ও খ্রিষ্টানদের সঙ্গে দীর্ঘ পনেরো বছরের (১৮১৫-৩০) এক বিতর্কে তিনি তাঁরতার ব্রাহ্ম একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে বাহ্যত বহুঈশ্বরবাদ ও ত্রিত্ববাদকে পরাভূত করেন। তিনি সমাজিক বিচার, বিশেষ করে হিন্দু নারীমুক্তির জন্য সুদীর্ঘ শতাব্দীকালের সংগ্রামেরও সূচনা করেন। গভর্নর জেনারেল উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক এর ঔপনিবেশিক সরকার ১৮২৯ সালে স্বামীর সাথে হিন্দু নারীর সহমরণ তথা [[সতীদাহ প্রথা]] বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। রামমোহন রায় এ বিষয়ে সরকারের আইন পাসে সহায়তা করেন। রামমোহন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা নীতি প্রবর্তনের সুপারিশ করেন।
 
== নব্য বঙ্গ আন্দোলন ==
মুক্ত চিন্তার অধিকারী [[হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও|হেনরি ডিরোজিও]] হিন্দু কলেজে (১৮২৬-৩১) ইতিহাস ও সাহিত্য পড়াতেন। তিনি তাঁরতার প্রায় ডজনখানেক অনুসারীকে মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তানুশীলনে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁরাতারা ছিলেন বিখ্যাত টমাস পেইন-এর এজ অব দ্য রিজনস ও রাইটস অব ম্যান-এর অত্যন্ত আগ্রহী পাঠক। তাঁরাতারা সকলে সম্মিলিতভাবে [[ইয়ং বেঙ্গল]] নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁরাতারা আনুমানিক ১৫ বছরের কাল পরিসরে (১৮২৮-৪৩) ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮২৮) নামের একটি সমিতির মাধ্যমে তাঁদেরতাদের বিপ্লবী ধ্যান-ধারণার প্রচার করেন। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা কমপক্ষে ছয়টি সাময়িকীর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। পত্রিকাগুলির নাম পার্থিনন (১৮৩০), ইস্ট ইন্ডিয়া (১৮৩১), ইনকুয়্যারার (১৮৩১-৩৪), জ্ঞানাম্বেষণ (১৮৩১-৪০), হিন্দু পাইওনিয়ার (১৮৩৫-৪০) ও বেঙ্গল প্সেক্টেটর (১৮৪২-৪৩)। প্রথম কয়েক বছর তাঁদেরতাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল সনাতন হিন্দুধর্মীয় মতবাদের অসার চিন্তাধারা। পরবর্তীকালে ইয়ং বেঙ্গল চিন্তাধারার অনুসারীরা তাঁদেরতাদের দৃষ্টি ও মনোযোগ ঔপনিবেশিক সরকারের নানা ব্যর্থতায়ই বেশি করে নিবদ্ধ করেন। রামমোহন ও তাঁরতার অনুসারীদের সাথে তাঁদেরতাদের পার্থক্য ছিল এইখানে যে, তাঁরাতারা আধ্যাত্মিকতা নয়, [[যুক্তিবাদ|বিশুদ্ধ যুক্তিতে]] বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরাতারা রামমোহনবাদীদেরকে ‘আধা-উদারবাদী’ বলে অভিহিত করতেন। ডিরোজিও ও রামমোহনপন্থীদের এই সংঘাত ১৮৪০-এর দশকের শেষ দিকে সবচেয়ে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ঐ সময়ে ব্রাহ্ম সমাজ এর অন্যতম নেতা [[দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর]] ও বিজ্ঞানপন্থী [[অক্ষয়কুমার দত্ত|অক্ষয়কুমার দত্তের]] মধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থের অভ্রান্ততা প্রশ্নে তীব্র সংঘাত দেখা দেয়। বস্তুত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহনের আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকারী হন, আর দত্ত অনুপ্রাণিত হন রামমোহনের যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্কতায়। অক্ষয়কুমার দত্ত ব্রাহ্মবাদকে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদে (ফবরংস) রূপান্তরিত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানাম্বেষাকে ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের তথা অলৌকিকতার স্থলবর্তী করতে চেয়েছিলেন। ১৮৫০-এর দশকে এ সংঘাতে তৃতীয় আরেক মাত্রার যোগ ঘটে। ত্রিমাত্রিক সংঘাতের এ তৃতীয় বাহুর প্রতিনিধি ছিলেন মানবতাবাদী [[ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর]]। দত্তের বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিবাদের সাথে বিদ্যাসাগরের মানবতাবাদের সুসমম্বয় ঘটলেও একই কারণে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আধ্যাত্মিকতাবাদ তাঁদেরতাদের পরম বৈরী হয়ে ওঠে।
 
== যুক্তিবাদ ==
ফলত [[ব্রাহ্মসমাজ|ব্রাহ্ম সমাজ]] বলয় থেকে দত্তের বহিস্কারের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যময় এ সংঘাতের অবসান ঘটে। [[অজ্ঞেয়বাদ|অজ্ঞেয়বাদী]] হয়ে ওঠার পর [[অক্ষয়কুমার দত্ত]] যুক্তিবাদ, বস্তুনিষ্ঠতা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রয়াস পান। উনিশ শতকের বাংলায় নবজাগৃতির অধিকারী বহু সুধীব্যক্তির জীবন ও কর্মে এ লক্ষণসমূহ ফুটে ওঠে। তবে বিদ্যাসাগর অজ্ঞেয়তাবাদী (একধরনের [[নাস্তিক্যবাদ|নাস্তিকও]] বলা যায়) থেকে যান এবং তাঁরতার সফল হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলনের (১৮৫৫-৫৬) ফলে ১৮৫৬ সালে প্রণীত আইনের (যা হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহকে বৈধ করে) পরে তিনি ষাটের দশকে কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আরও একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ ক্ষেত্রে এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রসারেও তাঁরতার প্রচেষ্টার সাফল্য শুধু উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল মহল দ্বারাই বিঘ্নিত হয় নি, বরং এর পেছনে আরও কাজ করেছে ঔপনিবেশিক সরকারের সহযোগিতা না করার দৃষ্টিভঙ্গি। ডিরোজিও ও তাঁরতার অনুসারিগণ এবং অক্ষয় কুমার ও বিদ্যাসাগর সকলে মিলে যে সংশয়বাদী-অজ্ঞেয়তাবাদী-নাস্তিক্যবাদী ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিলেন, তার পরিণত রূপ দেন প্রত্যক্ষবাদী নাস্তিক [[কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য]] (১৮৪০-১৯৩২)। ইতিহাসের পটভূমিকায় বিচার করলে এ ঘটনাপ্রবাহের তাৎপর্য অনেক। কারণ, খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের নাস্তিক চিন্তাবিদ জয়রাশি ভট্টের সুদীর্ঘকাল পরে এই প্রতিবাদীরাই প্রথমবারের মতো ভারতীয় বস্তুবাদের ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন।
 
বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দুজনে মিলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতবর্গ, শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট চার্চের কোন কোন মিশনারি এবং রামমোহন রায় ও তাঁরতার বিরোধীদের গড়া ভিত্তির ওপর আধুনিক বাংলা গদ্যের সৌধ গড়ে তোলেন। তারপর সেই গদ্য প্যারীচাঁদ মিত্র , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে নানা আকারে বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়। কাব্য ও নাটকে প্রতিমা-পূজা বিরোধী এবং ভাবের দিক থেকে ডিরোজিওপন্থী মাইকেল মধুসূদন দত্ত রীতি ভেঙে [[অমিত্রাক্ষর ছন্দ]], [[চতুর্দশপদী|চতুর্দশপদী বা সনেট]], ব্যক্তিবাদ, জড়পার্থিবতা, দেশপ্রেমিকতা, নারীচরিত্রের প্রাধান্য ও নাটকে তীক্ষ্ম, তীব্র সংঘাতের উপাদানের প্রবর্তন করেন। তাঁরতার রীতির অনুসরণে অচিরেই বহু নাট্যকার ও অপেক্ষাকৃত নিম্ন মানের কবির আবির্ভাব ঘটে। সাহিত্য পরিমণ্ডলের কথা ছেড়ে দিলেও বিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন মধুসূদন গুপ্ত,[[মহেন্দ্রলাল সরকার]] ,[[জগদীশ চন্দ্র বসু]] , [[প্রফুল্ল চন্দ্র রায়|প্রফুল্লচন্দ্র রায়]] , রাজেন্দ্রলাল মিত্র , [[রমেশচন্দ্র দত্ত]] , [[দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর]] ও কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্য। মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন প্রথম হিন্দু যিনি শবব্যবচ্ছেদ করেন। ভাই [[গিরিশ চন্দ্র সেন|গিরিশচন্দ্র সেন]] ইসলামি বিষয়ে জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত হন। তিনি ইসলামি ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বহু সংখ্যক গ্রন্থ ও জীবনী রচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরতার সবচেয়ে গৌরবময় জীবনকর্ম হলো পবিত্র কুরআনের সটীক বাংলা অনুবাদ (১৮৮৬)। বাংলা ভাষায় এ ধরনের কাজ তিনিই প্রথম করেন। নবজাগরণর আরেক বৈশিষ্ট্যময় চরিত্র হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। ফরাসি বুদ্ধিবৃত্তিক নবজাগরণ যুগের দার্শনিকদের মতো বাংলার নবজাগরণয় তিনি ও অন্যান্য বিদ্বৎজন ছিলেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শৌখিন অনুসন্ধানী, ঠিক জ্ঞানের কোন সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে একান্তভাবে নিবেদিত বিশারদ নন। তাঁরাতারা বস্তুত জ্ঞানচর্চার নানা ক্ষেত্রে এভাবেই কাজ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বিবিধার্থসংগ্রহ (১৮৫০-এর দশক) ও রহস্যসন্দর্ভ (১৮৬০-এর দশক) এবং বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন (১৮৭০-এর দশক) আর সেই সাথে এ ধরনের আরও অনেক কাজ উল্লিখিত অভিমত বা পর্যবেক্ষণেরই সাক্ষ্য।
 
প্রকৃতপক্ষে বাংলার নবজাগরণ যুগের স্থিতিকাল ছিল উনিশ শতকের প্রথম ছয় দশক। এ কালপরিক্রমায় মূল চালিকাশক্তি বা প্রেরণা হিসেবে কাজ করে যুক্তিবাদ আর এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সংস্কার। সংস্কারকদের সাধারণ লক্ষ্য ছিল হিন্দুত্বের কতকগুলি বিষয়। নবজাগরণর শেষ চার দশক জুড়ে প্রাধান্য ছিল জাতীয়তাবাদের, উদ্দেশ্য ছিল পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করা এবং নির্ধারিত বিপক্ষ ছিল কায়েমি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ। যুক্তিবাদীরা তখন থেকে পরাধীনতা ও আধিপত্যের বিষয়টির প্রতি নীরব থাকতে পারেন নি। কালো আইন পাস (আদালতের ভারতীয় বিচারকগণ মামলায় শ্বেতাঙ্গ বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করতে পারতেন না, এ বৈষম্যমূলক রীতি অবসানের জন্য ঐ সময়ে এক আইনের প্রস্তাব করা হয়) সংক্রান্ত বিতর্ক, সিপাহি বিপ্লব (১৮৫৭-৫৮) ও নীলবিদ্রোহের (১৮৫৯-৬০) মতো ঘটনাপ্রবাহ চিন্তাশীল বাঙালি মানসকে জাতীয়তাবাদী পথে পরিচালিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। ষাটের দশকে এ ধরনের চিন্তাধারায় যাঁরা প্রথম আকৃষ্ট হন তাঁদেরতাদের মধ্যে ছিলেন নবগোপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁরতার পুত্রকন্যাগণের মতো ব্রাহ্ম সমাজের কিছু লোক, যাঁরা হিন্দু মেলা (১৮৬৭-৮১) ও ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ (১৮৭২) শীর্ষক আলোচনাসভার মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন। তাঁদেরতাদের এ প্রয়াসের ফলে নব্যহিন্দুত্ববাদ নামে পরিচিত এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল চিরায়ত হিন্দু রচনাগুলির পুনঃসমালোচনাধর্মী পর্যালোচনা-মূল্যায়ন এবং সেই সাথে ইউরোপীয় বিজ্ঞানের উপলব্ধির মাধ্যমে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন। এ নব্য হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তারা হলেন [[ভূদেব মুখোপাধ্যায়]], [[বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]], [[স্বামী বিবেকানন্দ]] ও [[ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়]]। ব্রাহ্ম ও খ্রিষ্টান একেশ্বরবাদকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নব্য হিন্দুত্ববাদী তাত্ত্বিকেরা সর্বেশ্বরবাদী যুক্তির অবতারণা করে হিন্দুধর্মের সামাজিক সংস্কারবাদ প্রত্যাখ্যান করেন আর তার পরিবর্তে তাঁরাতারা শিক্ষা, সমাজ সেবা, আর্থ-রাজনৈতিক তৎপরতা ও সেই সাথে নানারকমের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে হিন্দুধর্মের সনাতন ও মৌলিক ধ্যান-ধারণা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন তথা বিকাশের আদর্শ সমর্থনে এগিয়ে আসেন। তাঁরাতারা সাধারণভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ধারণায় উৎসাহ জোগান এবং মাতৃভূমিকে মাতৃদেবীরূপে কল্পনা করেন। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ পরবর্তীকালে অধিকতর যুক্তিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্য পথ ছেড়ে দেয়। আর এই ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ তার আকার নেয় ইন্ডিয়া লীগ (১৮৫৭), [[ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন]] (১৮৭৬), ন্যাশনাল কনফারেন্স (১৮৮৩) ও [[ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস]]-এর(১৮৮৫) মাধ্যমে।
 
নব্যহিন্দু ও জাতীয়তাবাদী আবেগের অস্তিত্ব সত্ত্বেও নবজাগরণর মূল প্রেরণা বিলুপ্ত হয় নি। বরং এ প্রেরণা নতুন এক ভিত্তিভূমি লাভ করে মুসলিম আর্থ-সামাজিক সমস্যার বিষয়ে যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার দেলোয়ার হোসায়েন , সামাজিক বিষয়ের সমালোচক মীর মোশাররফ হোসেন এবং লেখক, শিক্ষাবিদ ও মুসলিম নারীমুক্তির জন্য সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর মতো মুসলিম পথিকৃৎ মনীষীদের মাঝে। এ শতকের শেষ নাগাদ এই পুনরুজ্জীবিত চেতনার প্রেরণা উপমহাদেশের আরও বহুস্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
 
বহু আধুনিক কালোত্তর বিদ্বৎজনের মতে বাংলার প্রেক্ষাপটে ‘নবজাগরণ’ এ পারিভাষিক শব্দটির প্রয়োগ যথার্থ হয় নি। এর সমর্থনে তাঁরাতারা যুক্তি দেখান যে, এর উদ্ভব ঘটে তৎকালীন ঔপনিবেশিক সরকারের প্রশাসনিক ও শিক্ষা সম্পর্কিত কিছু উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে। সকল ব্যবস্থা অত্যন্ত সচেতন ও পরিকল্পিতভাবেই নেওয়া হয় যাতে এক বিশেষ সমাজ গড়ে ওঠে, যা ঐ উনিশ শতকেই লক্ষ্য করা গেছে। অবশ্য এ শ্রেণীর আকার-আয়তন ছিল খুবই ছোট আর তা ছিল শহুরে উঁচুতলার হিন্দুদের মাঝেই সীমিত। এ শ্রেণীর চিন্তা-ভাবনা ও কার্যকলাপ বাংলার বৃহত্তর জনসমাজে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি, এমনকি বলতে গেলে কোন প্রভাবই পড়ে নি। মুসলিম সমাজ এর প্রভাব থেকে পুরোপুরি বাইরেই থেকে যায়। আর পল্লীজনপদের হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা বলা চলে।
 
== ইউরোপের নবজাগরণের থেকে পার্থক্য ==