[[বিষয়শ্রেণী:হিন্দু ধর্ম]]
[[বিষয়শ্রেণী:দর্শন]]
'''হিন্দুধর্মে দীক্ষা'''
দীক্ষা (দেবনগরী: రిన్లు) হিন্দুধর্মীয় সংস্কারবিশেষ। গুরু কর্তৃক শিষ্যকে বিশেষ কোনো দেবতার মন্ত্র দান, অর্থাৎ সেই দেবতার উপাসনায় উপদেশ দানের নামই দীক্ষা।দীক্ষাদানকারী গুরুকে বলা হয় দীক্ষাগুরু। শক্তি, শিব, বিষ্ণু উদ্দেশ্যে যথাক্রমে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব দীক্ষা প্রচলিত আছে।
দীক্ষা এমন জ্ঞান, যার দ্বারা দীক্ষাগ্রহণকারীর পাপক্ষয় হয়। দীক্ষা প্রধানত দ্বিবিধ- বহির্দীক্ষা ও অন্তর্দীক্ষা। বহির্দীক্ষায় পূজা, হোম প্রভৃতি বাহ্যিক অনুষ্ঠান বিহিত; আর অন্তর্দীক্ষায় মানুষের কুন্ডলিনীশক্তির (আত্মশক্তি) জাগরণ ঘটে। কোনো কোনো তন্ত্রে ত্রিবিধ দীক্ষার কথা বলা হয়েছে, যথা শাম্ভবী, শাক্তী ও মান্ত্রী। তন্ত্রোক্ত আরও নানাবিধ দীক্ষা আছে।
সব বর্ণের হিন্দুরাই দীক্ষা গ্রহণের অধিকারী। কোনো কোনো তন্ত্রমতে দীক্ষাদানে নিজের মা সর্বোত্তম গুরু। দীক্ষাদানকারী গুরুকে কেন্দ্র করে কালক্রমে একেকটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। সম্প্রদায়গুলির নিজস্ব কিছু আচার-আচরণ থাকে যা একটি থেকে অপরটি ভিন্ন। বাংলাদেশে এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়: অনুকূল সম্প্রদায়, মানিক সম্প্রদায়, মতুয়া সম্প্রদায়, জগদ্বন্ধু সম্প্রদায় প্রভৃতি। স্মৃতিনিবন্ধকার রঘুনন্দন বঙ্গদেশে তান্ত্রিক দীক্ষার প্রবর্তন করেন।
*'''বুৎপত্তি'''
সংস্কৃত দীক্ষ্ ধাতু থেকে দী্ক্ষা শব্দের উৎপত্তি। দীক্ষ্ ধাতুর সাথে অ+আ প্রত্যয়ান্ত হয়ে হলো দীক্ষা।
*'''দীক্ষা কি?'''
''দীয়ন্তে জ্ঞানমত্যন্তং ক্ষীয়তে পাপসঞ্চয়ঃ।''
'' তস্মাদ্ দীক্ষেতি সা প্রোক্তা মুনির্ভিস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।''
'' দিব্যজ্ঞানং যতো দদ্যাৎ কৃত্যা পাপস্য সংক্ষয়ম্।''
'' তস্মাদীক্ষেতি সা প্রোক্তা মুনির্ভিস্তত্ত্ববেদিভিঃ।।''
(রুদ্রযামল ও যোগিনী তন্ত্রে)
অনুবাদঃ যে কার্য পাপক্ষয় করিয়া দিব্য জ্ঞান
প্রকাশ করে, তাহাই দীক্ষা। প্রকৃতপক্ষে দীক্ষার অর্থ
বর্ণ বা শব্দ বিশেষ, শ্রবণ করা নহে। বর্ণ বা বর্ণগুলি
শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম বলিয়া পরিকীর্তিত আছে।
সেই শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্মই বর্ণ। সেই বর্ণই
ভগবানের নাম। নাম এবং নামী অভেদ, কিছুই
প্রভেদ নাই। এইভাবে যেই নাম বা মন্ত্র গ্রহণ করা
হয় তাহাই দীক্ষা। যিনি নামে এবং মন্ত্র এ মন্ত্রের
অভীষ্ট দেবতাকে এক ভাবেন, তিনি প্রকৃত দীক্ষিত।
দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করিলে শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম অভীষ্ট
দেবতার না হয় এবং হৃদয়ে নিজ ইষ্ট দেবতার ভাব
উদ্দীপন না হয়, তবে সেইরূপে মন্ত্র বা দীক্ষা গ্রহণ
করিয়া দীক্ষা বা মন্ত্র গ্রহণ শব্দ প্রয়োগ না করাই
শ্রেয়ঃ। দৃঢ় বিশ্বাস বা ভক্তিই মূল।
*'''দীক্ষা প্রকরণ'''
*''দীক্ষা গ্রহণে যোগ নির্ণয়''
শুভ, সিদ্ধ, আয়ুষ্মান, ধ্রুব, প্রীতি, সৌভাগ্য বৃদ্ধি
এবং হর্ষণযোগ দীক্ষায় প্রশস্ত।
*''দীক্ষা গ্রহণে করণ নির্ণয়''
বব, বলব, কৌলব, তৈতিল ও বণিজকরণ
দীক্ষাকার্য্যে শুভাবহ।
*''দীক্ষা গ্রহণে লগ্ন নির্ণয়''
বৃষ, সিংহ, কন্যা, ধমু ও মীন লগ্নে চন্দ্র ও
তারাশুদ্ধিতে মন্ত্রগ্রহণ করিবে । বিষ্ণুমন্ত্র গ্রহণে
স্থিরলগ্ন অর্থাৎ বৃষ, সিংহ, বৃশ্চিক ও কুম্ভ লগ্ন
প্রশস্ত। শিবমন্ত্রে চরলগ্ন অর্থাৎ মেষ, কর্কট, তুলা ও
মকর এই চারিলগ্ন এবং শক্তিমন্ত্রদীক্ষাতে দ্ব্যাত্মক
লগ্ন অর্থাৎ মিথুন, কন্যা, পক্স ও মীন লগ্ন প্রশস্ত।
অগস্ত্য সংহিতায় লিখিত আছে যে, লগ্নের তৃতীয়,
ষষ্ঠ ও একাদশ স্থানে পাপগ্রহ, এবং লগ্ন, চতুর্থ
সপ্তম, দশম, নবম ও পঞ্চম স্থানে শুভগ্রহ থাকিলে
মন্ত্র গ্রহণে শুভ হয়। কিন্তু দীক্ষাকার্য্যে বক্রগ্রহ
অনিষ্টকারী।
*''দীক্ষা গ্রহণে পক্ষ নির্ণয়''
শুক্লপক্ষে দীক্ষাগ্রহণে শুভ এবং কৃষ্ণপক্ষে পঞ্চমী
পৰ্য্যন্ত দীক্ষা গ্রহণে শুভ ফল হয় ।
অগস্ত্যসংহিতামতে—শুক্ল কৃষ্ণ উভয় পক্ষেই
দীক্ষাকার্য্য প্রশস্ত । কালোত্তরে লিখিত হইয়াছে—
সম্পত্তিকামী জন শুক্ল পক্ষে, যুক্তিকামী ব্যক্তি কৃষ্ণ
পক্ষে মন্ত্র গ্রহণ করিবে । নিষিদ্ধ তিথি এবং নিষিদ্ধ
মাস হইলেও নিম্ন লিপিত মাসের বিশেষ বিশেষ
তিথিগুলিতে মন্ত্র গ্রহণে বিশেষ বিধি
আছে ভাদ্রমাসের ষষ্ঠী, আশ্বিনমাসের কৃষ্ণা
চতুর্দশী, কাত্তিকের শুক্লা নবমী, অগ্রহায়ণের
তৃতীয়া, পৌষের শুক্লা নবমী, মাঘের শুক্লা চতুর্থী,
ফাঞ্জনের শুক্লা নবমী, চৈত্রের কাম চতুর্দশী,
বৈশাখের অক্ষয় তৃতীয়া, জ্যৈষ্ঠের দশহরা,
আষাঢ়ের শুক্ল পঞ্চমী, শ্রাবণের কৃষ্ণ পঞ্চমী-ইহারা
দেবপৰ্ব্ব বলিয়া মন্ত্রগ্রহণে প্রশস্ত । ইহাতে মন্ত্র গ্রহণে
কোটিগুণ ফল হয় এবং তিথিযোগকরণাদি কিছুরই
বিচার আবগুক করে না। অন্ত মতে চৈত্রের শুক্ল
ত্রয়োদশী, বৈশাখের শুক্ল একাদশী, জ্যৈষ্ঠের কৃষ্ণ
চতুর্দশী, আষাঢ়ের নাগপঞ্চমী, শ্রাবণের একাদশী,
ভাজের জন্মাষ্টমী, আশ্বিনের মহাষ্টমী, কাৰ্ত্তিকের
শুক্ল নবমী, অগ্রহায়ণের শুক্লা ষষ্ঠী, পৌষের
চতুর্দশী, মাঘের শুক্লা একাদশী, ফাঙ্কনের শুক্ল ষষ্ঠী-
দীক্ষাকার্য্যে সুপ্ৰশশু । যোগিনী তন্ত্রে লিখিত
হইয়াছে, উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নাদি সংক্রাপ্তি দিন,
চজস্বৰ্য্যগ্রহণ, যুগান্ধাদি তিধি, মন্বত্বরতিথি এবং
মহাপুয়াদিমে দীক্ষাকার্য শুভঙ্গক।
*'''প্রয়োজনীয়তা'''
''অদীক্ষিতাং লোকানাং দোষং শৃনু বরাননে।''
'' অন্নং বিষ্ঠা সমং তস্য জলং মূত্র সমং স্মৃতম্।''
'' যৎ কৃতৎ তস্য শ্রাদ্ধং সর্বং যাতিহ্যধোগতিম্।।১''
'' (তথাহি মৎস্যর্সূক্তে)''
অর্থঃ অদীক্ষিত ব্যক্তি অন্ন বিষ্ঠার সমান, জল
মূত্রতুল্য। তাহারা শ্রাদ্ধাদি কার্য যাহা কিছু করে,
তাহা সমস্তই বৃথা।
''ন দীক্ষিতস্য কার্যং স্যাৎ তপোভির্নিয়মব্রতৈ।''
'' ন তীর্থ গমনে নাপি চ শরীর যন্ত্রণৈঃ।।২''
'' অদীক্ষিতা যো কুর্বন্তি তপো জপ পূজাদিকাঃ।''
'' ন ভবতি ক্রিয়া তেষাং শিলায়ামুপ্ত বীজবৎ।।৩''
অর্থঃ দীক্ষা গ্রহণ না করিলে কোন কার্য করিবার
অধিকার জন্মে না। সেই জন্য জপ, তপ, নিয়ম,
ব্রত, তীর্থ, ভ্রমণ উপবাসাদি শারীরিক কষ্ট দ্বারা
কোন ফল দর্শিবে না।
অদীক্ষিতোহপি মরণে রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।
অদীক্ষিতস্য মরণে পিশাচত্বং ন মুঞ্চতি।।
অদীক্ষিত ব্যক্তিগণ মৃত যদি হয়।
রৌরব নরকে বাস জানিবে নিশ্চয়।।
স্কন্ধ পুরাণেতে তার আছয়ে বর্ণন।
মৃত্যু পরে হবে তার পিশাচে জনম।।
''দীক্ষা মূলং জপং সর্বং দীক্ষা মূলং পরং তপঃ।''
'' দীক্ষামাশ্রিত্য নিবসেৎ কৃত্রশ্রমে বসদ্।।''
জপ, তপ, তন্ত্র, মন্ত্র, দীক্ষা মূল হয়।
দীক্ষা ভিন্ন সর্বকার্য হইবেক ক্ষয়।।
দীক্ষা সর্বকার্যে শুদ্ধিকারক। তাই প্রত্যেকের দীক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
[[বিষয়শ্রেণী:হিন্দুধর্মে_দীক্ষা]]
|