বাঙাল

পূর্ববাংলার স্থানীয় বাঙালি সামাজিক জনগোষ্ঠী

বাঙাল (ঘটি জনগোষ্ঠীর বিপরীত) একটি বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং অঞ্চল যার দ্বারা পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মানুষদের বোঝায়। এই শব্দটি অখণ্ড বাংলার পূর্ব প্রান্তের বাঙালিদের বর্ণনার জন্য ব্যবহৃত হয়, যাদের ঘটিদের তুলনায় কিছুটা আলাদা বাংলা উচ্চারণ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত এটি ধারণা করা হয় যে হুগলি নদীর পূর্ব থেকে ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা নদী হল অখণ্ড বাংলার এলাকা। ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা নদীর পূর্বের অঞ্চলগুলি ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালদের আদিভূমি হিসাবে ধারণ করা হয়। যথাযথ সংজ্ঞা অনুসারে, বাঙালরা হলেন সেই লোকেরা যাদের পূর্ব পুরুষরা পূর্ববঙ্গের মাটির সাথে সম্পৃক্ত।[১][২] আরও কিছু মতামত রয়েছে যে, পূর্ববঙ্গের আদি মানুষদের মধ্যে কেবলমাত্র আর্থিক সমৃদ্ধশালি গোষ্ঠীর লোকদেরই বাঙাল হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা উচিত। এই মতামত অনুসারে, বাঙাল শব্দের একটি নৃতাত্ত্বিক-ভৌগোলিক এবং পাশাপাশি একটি সামাজিক অর্থও রয়েছে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে কিছু লোক প্রধানত হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের আদি জনগোষ্ঠী এই শরণার্থীদেরই মাঝে মাঝে বাঙাল বলে অভিহিত করত। এই হিসাবে, ঘটি ও বাঙাল শব্দটি পশ্চিমবঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যদিও বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত অভিবাসীদের তুলনামূলক বেশি সংখ্যক অঞ্চল ছাড়া এই শব্দের ব্যবহার বিরল। আধুনিক যুগে, উচ্চ বর্ণের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে, "বাঙাল" এবং "ঘটি" সামাজিক উপ-গোষ্ঠী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। দেশ বিভাগের সময় যাদের পরিবার পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল তারা হল বাঙাল এবং যাদের পরিবার সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছিলেন তারা হলেন ঘটি। একইভাবে, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে আগত লোকেরা ঘটি নামেও পরিচিত, যেহেতু তারা স্বাধীনতার সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছিল। এখানে ব্যবহৃত শব্দটির প্রকৃত ভূগোলের সাথে খুব কম সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু এই গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যই এখন ভারতে বাস করছেন। ঐতিহাসিকভাবে, তাদের বর্ণের মধ্যে বিবাহ করার পাশাপাশি, এই গোষ্ঠীর লোকেরাও বাঙাল বা ঘটি যাই হোক না কেন, এই গোষ্ঠীর মধ্যেই বিবাহ পছন্দ করত। ইস্টবেঙ্গল (বাঙালদের) এবং মোহনবাগান (ঘটিদের) এই দুটি ফুটবল ক্লাবকে তাদের নিজ নিজ সমর্থনের মাধ্যমে বাঙাল এবং ঘটিরা তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রেখেছে। এছাড়াও তারা স্ব স্ব রান্না এবং বিশেষত নদী-ভিত্তিক স্বাদযুক্ত খাবারের আধিপত্যের দাবির মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও লালন করে। যথা: চিংড়ি ঘটিদের জন্য এবং ইলিশ বাঙালদের জন্য।

ইতিহাস সম্পাদনা

বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে প্রমাণিত আছে যে দশম শতাব্দীর চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের আমলে, শ্রীহট্টের (সিলেটের পূর্বনাম) অধিবাসীদেরকে (স্থানীয় লোকদেরকে) "বাঙাল" নাম দিয়ে পরিচিতি দেওয়া হতো এবং ব্রাহ্মণ অভিবাসীদেরকে "দেশান্তরীয়" ডাকা হতো।[৩]

সুতরাং, ১৯৪৭'এ দেশভাগ জনিত কারনে বাঙ্গাল/বাঙাল শব্দের উৎপত্তি নয়। আজ থেকে হাজার বছরের বেশি আগেও পুর্ববঙ্গীয় তথা বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের বাঙালীদের পরিচিতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এই শব্দের ব্যবহারের কথা জানা গেছে।

আজকের ভৌগোলিক বাংলাদেশের মানুষ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার পূর্বাংশের জেলাগুলোর মানুষও বঙ্গাল/বাঙাল অভিহিত হতেন।

গঙ্গা পাড়ের ঘটি ও পদ্মা পাড়ের বাঙাল সম্পাদনা

হুগলি নদী পশ্চিম দক্ষিণে (ডান দিকে) যে বাঙালির বাস, তাঁরা হলেন ঘটি। পরিসংখ্যান বিচার করলে সেরকমই কিছু একটা দাঁড়ায়। তবে পশ্চিমবঙ্গে মূলত যাঁরা এখানকার আদি বাসিন্দা, তাঁদের বলা হয় ঘটি, যাঁরা ওপার বাংলা থেকে এসেছেন, তাঁরা হলেন বাঙাল।

রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালসভা সম্পাদনা

এছাড়াও তিনি মজা করে লেখা এক ছড়া্‌য় নিজ 'খাস দপ্তর' এ সহায়ক সুধীর চন্দ্র কর কে লেখেন "… … পশ্চিম বঙ্গের কবি দেখিলাম মোর/ বাঙালের মতো নাই জেদের অপ্রতিহত জোর।" (২রা ডিসেম্বর, ১৯৪০)। যশোর জেলার ওনার পূর্বপুরুষ রা সবাই বঙ্গাল প্রদেশ ছিলেন। এবং কিছু মুসলিম হই পড়ছিলেন।

নমঃশূদ্র সভাই ওনার ছিল নিত্য আনা গোনা। কলকাতাকে পূর্ব বঙ্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পশ্চিম বঙ্গে রাখা একটি লড়াই।

বাঙাল বনাম ঘটি সম্পাদনা

বৃহত্তর বাঙালি সমাজে বাঙাল এবং ঘটিদের মধ্যে কিছু সামাজিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

1. বিভাজনটা নদীর হিসেবে, সীমান্ত নয়।

ঘটি = পদ্মার পশ্চিম পাড়ের মানুষ, এবং তার মধ্যে খুলনা, যশোর ও আছে।

বাঙাল = পদ্মার পূর্ব পাড়ের মানুষ।

2. ঘটিরা দীপাবলির দিন লক্ষ্মী পুজো করে আর বাঙালরা কালী পুজো করে।

3. বাঙালরা সাধারণত খাবারে ঝাল পছন্দ করে আর বিপরীতে ঘটিরা খাবারে মিষ্টি বেশি পছন্দ করে।

আরও দেখুন সম্পাদনা


তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "East Bengal Vs Mohun Bagan: The 'Ghoti' – 'Bangal' Rivalry"News18 (ইংরেজি ভাষায়)। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। ৩ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  2. Ghoshal, Somak (২০২০-০২-১৫)। "The 'ghoti' versus 'bangal' rivalry in Bengali cinema"mint (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০১-০৩ 
  3. চৌধুরী, ইন্দ্রজীত (৪ আগস্ট ২০১৬)। "পুণ্ড্র, গৌড় পেরিয়ে সেই বঙ্গেই ফিরলাম?" (প্রবন্ধ)। আনন্দবাজার পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০২০ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা