বর্ণপরিচয়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত একটি বাংলা বর্ণশিক্ষার বই

বর্ণপরিচয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত একটি বাংলা বর্ণশিক্ষার প্রাইমারি বা প্রাথমিক পুস্তিকা। দুই ভাগে প্রকাশিত এই পুস্তিকাটির দুটি ভাগই প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। দুই পয়সা মূল্যের এই ক্ষীণকায় পুস্তিকার প্রকাশ বাংলার শিক্ষাজগতে ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ভাষার অযৌক্তিক শাসনজাল থেকে মুক্ত করেন এবং যুক্তি ও বাস্তবতাবোধের প্রয়োগে এই বর্ণমালার সংস্কার-সাধনে প্রবৃত্ত হন। গ্রন্থটি যে শুধু বিদ্যাসাগরের জীবৎকালেই সমাদৃত হয়েছিল তাই নয়, আজ গ্রন্থপ্রকাশের সার্ধ-শতবর্ষ পরেও এর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই গ্রন্থটিকে একটি প্রধান প্রাইমার হিসাবে অনুমোদন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কলকাতা পৌরসংস্থার যৌথ প্রয়াসে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ভারতে বৃহত্তম যে বইবাসরটি (বই বিক্রয়ের শপিং মল) নির্মিত হচ্ছে, তার নামও এই গ্রন্থটির সম্মানে বর্ণপরিচয় রাখা হয়েছে।

বর্ণপরিচয়
বর্ণপরিচয় গ্রন্থ
লেখকঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
মূল শিরোনামবর্ণপরিচয়
দেশভারত
ভাষাবাংলা
প্রকাশনার তারিখ
১৮৫৫

রচনা ও প্রকাশনার ইতিহাস

সম্পাদনা

ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের পূর্বেও ছাপার অক্ষরে এই জাতীয় কিছু কিছু পুস্তিকা বাজারে চলত।” ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১), স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩ ?) ও বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৪), ক্ষেত্রমোহন দত্ত কর্তৃক তিন ভাগে রচিত শিশুসেবধি (১৮৫৪), মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত শিশুশিক্ষা গ্রন্থগুলির নাম করেছেন। [] তবে এই সব পুস্তিকা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বাংলা বর্ণমালায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতাও এগুলির রচয়িতাদের ছিল না।

ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “শোনা যায়, প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর একদা সিদ্ধান্ত করেন যে, দু’জনে ইংরেজি ও বাংলায় বর্ণশিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক পুস্তিকা লিখবেন। তদনুসারে প্যারীচরণ First Book of Reading এবং বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’ প্রকাশ করেন।” [] বিহারীলাল সরকারের রচনা থেকে জানা যায় মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পালকিতে বসে পথেই বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। [] ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে (১৩ এপ্রিল অর্থাৎ ১লা বৈশাখ,সংবৎ ১৯১২[] /১লা এপ্রিল,১৮৫৫ []) প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ এবং ওই বছরেই জুনে (১৪ ই জুন অর্থাৎ ১লা আষাঢ়,সংবৎ ১৯১২) প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ। বিহারীলাল আরও লিখেছেন, “প্রথম প্রকাশে বর্ণপরিচয়ের আদর হয় নাই। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিরাশ হন; কিন্তু ক্রমে ইহার আদর বাড়িতে থাকে।” [] প্যারীচরণের ইংরেজি গ্রন্থখানিও বাঙালি সমাজে দীর্ঘকালের আদরের বস্তু ছিল। তবে আজকের বিশ্বায়নের যুগে এই গ্রন্থটির শিক্ষামূল্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। অথচ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রন্থটি আজও বাঙালি সমাজে শিশুদের বাংলা শিক্ষার প্রথম সহায়ক হয়ে রয়ে গেছে।

বৈশিষ্ট্যসমূহ

সম্পাদনা

এরপর আবারও ১২৫ বছরে কেবল স্বরবর্ণমালা থেকে "ঌ" (লি) ও ব্যঞ্জনবর্ণমালা থেকে "অন্তস্থ ব" বাদ গিয়েছে। ফলে বলা যায়, আধুনিক বাংলা বর্ণমালার মূল রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

দ্বিতীয়

সম্পাদনা

প্রকাশক:- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সয়ং গুরুত্ব:-তার বর্ণপরিচয় এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি প্রথম শিশুদের উপযোগী সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে পাঠ রচনা করা হয়েছে। এখানে প্রথমে শিশু বর্ণক্রমিক পদ্ধতিতে বর্ণ শিখবে, বর্ণের সঙ্গে মুখে মুখে ছোট ছোট শব্দ শিখবে, এরপর বর্ণপরিচয়-এর পরীক্ষা, তারপর বর্ণযোজনা ও ফলা সংযোগে বানান শেখার সূচনা। এরপর রয়েছে সহজবোধ্য ছোট বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা।

তৃতীয়

সম্পাদনা

এভাবে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে যাই। এখানে আমরা দেখি আগেকার অবোধ্য-দুর্বোধ্য শব্দকদম্ব মুখস্থ করার পরিবর্তে শিশু পরিচিত শব্দ শিখছে ও স্বচ্ছন্দ বাংলা গদ্য রচনার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এভাবে সহজ সাবলীল ও আধুনিক বাংলা গদ্যের পথ প্রশস্ত করে দিলেন বিদ্যাসাগর সব শিক্ষিত বাঙালির জন্য।

চতুর্থ

সম্পাদনা

চতুর্থ গুরুত্ববহ বিষয়টি হলো যতিচিহ্ন। ইতিপূর্বে বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের বিষয়ে সচেতনতা ও প্রয়োগ নৈপুণ্য দেখা যায়নি। বিদ্যাসাগরের এসব সাবলীল স্বচ্ছন্দ গদ্যে যতিচিহ্নের ব্যবহার লক্ষণীয়। বর্ণপরিচয়-এর ১৯ সংখ্যক পাঠ থেকে উদাহরণ টানা যায়-‘গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না; সকলের আগে পাঠশালায় যায়; পাঠশালায় গিয়া আপনার জায়গায় বসে; আপনার জায়গায় বসিয়া, বই খুলিয়া পড়িতে থাকে; যখন গুরু মহাশয় নূতন পড়া দেন, মন দিয়া শুনে।’ যতিচিহ্নের বিষয়ে তার বিশেষ সচেতনতার কথা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দৃষ্টান্তসহকারে উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন- ‘তাঁহার এই সংস্কারকামী মনের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় তাঁহার বিরাম-চিহ্নের প্রয়োগের ক্রমবাহূল্য দেখিয়া।’ (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-মনীষী স্মরণে, ২ : ১৩)

পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো, এর গদ্যাংশের মৌলিক সাহিত্য গুণ। যে ২০টি পাঠ রয়েছে তাকে বাংলা শিশুসাহিত্যের সূচনাপর্ব বলা যায়। ছোট ছোট বাক্য, তাতে ছবি যেমন তেমনি ছন্দও ফুটে ওঠে। যেমন-

  • ২ পাঠ

পথ ছাড়। জল খাও। হাত ধর। বাড়ী যাও।

  • ৩ পাঠ

কথা কয়। জল পড়ে। মেঘ ডাকে। হাত নাড়ে। খেলা করে।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে সুনীতিকুমারের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। তিনি লিখেছেন
"বাঙ্গালা গদ্য-সার্থক বাঙ্গালা গদ্য-অনেকে লিখিয়াছেন এবং আজও অনেকে লিখিতেছে। বাঙ্গালা গদ্যের অন্তর্নিহিত ঝংকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এখনকার দিনে অসম্ভব নয়। কিন্তু যখন ভালো গদ্যের নমুনা কদাচিৎ দেখা যাইত, সেইকালে বিদ্যাসাগর যে কী অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে বাঙ্গালা গদ্যের সেই অন্তর্নিহিত ঝংকারের সম্ভাবনা বা অস্তিত্ব আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়াবিষ্ট হইতে হয়।---অর্থাৎ গদ্য রচনার ছন্দবিষয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম দ্রষ্টা ও স্রষ্টা; গদ্যপাঠের ধ্বনি-সামঞ্জস্যে যে পাঠক ও শ্রোতা আনন্দ পাইতে পারে, এই সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁহার ছিল।"
তার গদ্যের এই গুণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
"গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটা ধ্বনি-সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া তাহার গতির মধ্যে একটি অনতি লক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং সবল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া, বিদ্যাসাগর বাংলাকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন।"

এভাবে ধাপে ধাপে বাক্য দীর্ঘ হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে বাক্য রচিত হয়ে অনুচ্ছেদ হয়ে উঠে শেষে কাহিনীর দিকে গেছে। সবই সহজ স্বচ্ছন্দ প্রাঞ্জল গদ্যে তিনি রচনা করেছেন।

এ বইয়ের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, সেই ১৫০ বছর আগেও বিদ্যাসাগর তার শিশুতোষ রচনায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানেননি। কাহিনীর সঙ্গে ধর্মের ও ধর্ম সংস্কারে সংস্রব নেই, জোর দিয়েছেন তিনি নীতিশিক্ষার ওপর, ভালোমন্দ বুঝে সচ্চরিত্র গঠনের ওপর। সদাসৎ বোঝানোর জন্য হয়তো একটু বেশিই ব্যগ্রতা প্রকাশ পেয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যা নিয়ে মৃদু আপত্তিও করেছেন। সেকালের ধর্মসংস্কারের বাহূল্য, আড়ম্বর ও জবরদস্তির কথা ভাবলে শিশুপাঠ্য গ্রন্থে তার এই ধর্মনিরপেক্ষ মানসের প্রতিফলন দেখে বিস্মিত ও আপ্লুত হতে হয়।

সপ্তম বিষয়টি হলো, বিদ্যাসাগর আধুনিক শিক্ষক-শিক্ষণেরও যেন পথিকৃৎ। তিনি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য বেশ কিছু পরামর্শও লিখে গেছেন। বর্ণপরিচয়-এর দুটি ভাগেই বর্ণযোজনার নির্দেশিকা দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের ষষ্টিতম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তিনি শিক্ষকদের জন্যই লেখেন, ‘প্রায় সর্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা, অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা সেরূপ না বলিয়া কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’

একটা সমালোচনা ওঠে বর্ণপরিচয় সম্পর্কে, তাহলো শিশুরা স্বভাবত ছন্দের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হলেও এ বইয়ে সরাসরি ছন্দোবদ্ধ ছড়া বা কবিতা নেই। আমরা আগেই বলেছি, তার গদ্যে ছন্দের আভাস পাওয়া যায়, যা শিশুমনকে আকৃষ্ট করবে। তবুও বলতে হয়, শিশুর জন্য ছড়া ও কবিতার স্বাদ এতে নিশ্চয়ই মিলবে না।

প্রচার ও কার্যকারিতা

সম্পাদনা

বর্ণপরিচয় যে অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল তা এর কাটতি ও জনপ্রিয়তা দেখেই বোঝা যায়। ১৮৫৫ থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৮৯১) মোট ৩৫ বছরে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ-এর ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম তিন বছরে ১১টি সংস্করণে ৮৮ হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল। পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য বলা যায়, এ বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ৩ হাজার কপি। সেকালের হিসাবে যথেষ্ট বলতে হবে এ সংখ্যাকে। ১৮৬৭ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ১২৭টি সংস্করণে এ বই মুদ্রিত হয়েছে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার কপি। অর্থাৎ এ সময় বছরে গড়ে বর্ণপরিচয় মুদ্রিত হয় ১ লাখ ৪০ হাজার কপি। বলাবাহূল্য, এ কাটতি বা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারেরও একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৫, পৃ.৮৪-৫
  2. বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৫, পৃ.৮৫
  3. বিহারীলাল সরকারের বিদ্যাসাগর গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত তথ্য : বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৫, পৃ.৮৫
  4. বিদ্যাসাগর রচনাবলী বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য
  5. প্রাত্যহিকী ১ লা এপ্রিল, ২০২১,গীতাঞ্জলি প্রচার তরঙ্গ, আকাশবাণী,কলকাতা
  6. বিহারীলাল সরকারের বিদ্যাসাগর গ্রন্থ (পৃষ্ঠা ৩৩৪, চতুর্থ সংস্করণ) থেকে উদ্ধৃত : বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৫, পৃ.৮৫