প্রেমের বিয়ে

বিবাহের ধরন

প্রেমের বিয়ে বা প্রেম করে বিয়ে (ভারতীয় উপমহাদেশীয় ইংরেজি উপভাষাতে লাভ ম্যারেজ) হচ্ছে প্রধানত ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে ব্যবহৃত একটি পরিভাষা। এটি দ্বারা এমন একটি বিয়েকে বোঝায় যেখানে স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই ভালোবাসার মাধ্যমে তাদের একে অপরের পিতামাতার অনুমতি ছাড়া বা অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছে।[১][২][৩] 'প্রেমের বিয়ে'র কোনো পরিষ্কার সংজ্ঞা নেই, তবে এটি মূলত এমন একটি বিয়ে যেখানে দম্পতিরা নিজেদের একক সিদ্ধান্তেই পরস্পরকে নির্বাচন করে।[১]

ইউরোপে সম্পাদনা

 
" অ্যাবেলার্ডাস অ্যান্ড হ্যালোইজ সারপ্রাইসড বাই মাস্টার ফুলবার্ট " - জ্যাঁ ভিনগার্ড (১৮১৯)

মার্কিন ইতিহাসবিদ স্টিফানি কুন্টয তার ২০০৫ সালের বই ম্যারেজ, এ হিস্ট্রিঃ ফ্রম ওবেডিয়েন্স টু ইন্টিমেসি, অর হাউ লাভ কনকুআর্ড ম্যারেজ বইতে প্রেম করে বিয়ে করার ইতিহাস লিখেছেন। তার বইয়ে তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক ভাবে না হলেও প্রেম এবং ব্যক্তিগত পছন্দের উপর ভিত্তি করে বিয়েটা শুরু হয় ১৪তম শতকে এবং ১৭০০ এর শতকে এটা বৃদ্ধি পায়।[৪]

১৭৬১ সালে ফরাসী দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো " জুলি অর দ্যা নিউ হ্যালোইজ " নামের একটি বই লেখেন। এই বইটি ১২ শতকের এক দার্শনিক পিটার এবেলার্ড এর জীবন থেকে অনুপ্রানিত যিনি তার এক ছাত্রী হ্যালোইজ ডি'আর্জেন্টিউইল এর প্রেমে পড়েছিলেন। তাদের একটি সন্তান হয়েছিলো এবং তারা গোপনে বিয়ে করেছিলেন। হ্যালোইজের অভিভাবকেরা এইটা জানতে পারলে পিটারের অণ্ডকোষ কেটে ফেলা হয়। রুশোর সময় পিটার আর হ্যালোইজের প্রেমপত্র প্রকাশ হবার পর এই কাহিনীটি বেশ পরিচিতি লাভ করে। রুশোর বই ঠিক এরকমই একজন ছাত্রী জুলি আর তার শিক্ষক সেন্ট প্রক্স এর কাহিনী নিয়ে। বইটা চিঠির আকারে লেখা। জুলির পিতা তাদের প্রেমের বিরোধিতা করেন এবং জুলিকে অন্য একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন যাকে তিনি উপযুক্ত মনে করেছিলেন।

কুন্টয এর মতে অ্যাংলো-স্যাক্সন দের মধ্যে বিয়ে জিনিসটা চালু হয়েছিলো সমাজে শান্তি এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। ১১ শতকে বিয়ে সংঘটিত হত মূলত আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। এক্ষেত্রে যাদের বিয়ে তাদের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হতনা। বিশেষত মেয়েদের তাদের পিতার ইচ্ছানুযায়ীই বিয়ে করতে হত। ১১৪০ সালে গ্র্যাটিয়ান 'ডেকরেটাম গ্র্যাটয়ানি' রচনা করেন। এখানে তিনি যাদের মধ্যে বিয়ে হবে তাদের সম্মতি থাকা বাধ্যতামূলক করেন। এই বইটি খ্রিস্টান চার্চ এর বিয়ে করার মূলনীতি হয়ে ওঠে।[৫]

১৮৪০ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া এবং প্রিন্স এ্যালবার্ট এর প্রেম করে বিয়ে করা ভিক্টোরিয়ার শাসনামলে ইংল্যান্ডে সাধারণ জনগণের মধ্যে এ ধরনের বিয়েকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলে।[৫]

ভারতে সম্পাদনা

ভারতে লাভ ম্যারেজ বলতে বোঝায় সেই বিয়ে যেটা স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের সিদ্ধান্তে হয়েছে, এক্ষেত্রে তারা তাদের বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের অনুমতি নিতেও পারে আবার নাও পারে। সাধারণত এই বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্ম, গোত্র বা জাতিভেদ মানা হয় না।

ভারতের প্রধান শহরগুলোতে প্রেম করে বিয়ে করাটা সত্তরের দশকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে এ ধরনের বিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই হতো। তবে আজকাল ভিন্ন জাতির মধ্যে ভেদাভেদ কমে এসেছে।[১] ভারতে আবার শহুরে সমাজে "লাভ-এ্যারেঞ্জড ম্যারেজ" নামের একটি নিয়ম প্রচলিত আছে যেটা হচ্ছে পিতামাতা একটা ছেলেকে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলবে ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে, এরপর একে অপরকে পছন্দ হলে তারা বিয়ে করবে।[৬] এখনো ভারতের বহু গ্রামে প্রেম করে বিয়ে করাটা একটা 'ট্যাবু' অর্থাৎ প্রেম নিষিদ্ধ এবং গোপন একটি বিষয়।[১][৭]

২০১২ সালে ভারতের টিভি চ্যানেল এনডিটিভি'তে ইপসস একটি প্রতিবেদন বের করে প্রেম করে বিয়ে করা নিয়ে, ওখানে শতকরা ৭৪ জন মানুষ অভিভাবক দ্বারা বিয়ে করানোটাকে ভালো মনে করে।[৮] ২০১০ সালে ন্যাশনাল কমিশন ফর ওমেন এর তদন্ত অনুযায়ী ভারতে প্রেম করে বিয়ে করার কারণে অনেক সম্মান রক্ষার্থে হত্যা এর ঘটনা ঘটে, ঐ বছর ৩২৬ টা সম্মান রক্ষার্থে হত্যা-এর খবর পাওয়া গিয়েছিলো, এই সব হত্যার অন্যতম কারণ ছিলো অন্য ধর্মের ছেলে বা মেয়েকে ভালোবাসা।[৯]

২০১৪ সালে ইউনাইটেড ন্যাশন্স পোপুলেশন ফান্ড এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন ওমেন এর একটি জরিপে দেখা যায়, দিল্লী শহরের ১১.৭ শতাংশ ছেলে বলছে তারা প্রেম করে বিয়ে করেছে এবং সাড়ে আট শতাংশ মেয়ে বলছে তারা প্রেম করে বিয়ে করেছে।[১০]

পাকিস্তানে সম্পাদনা

পাকিস্তানের সমাজে প্রেম করে বিয়ে করাটা এখনো ট্যাবু[১১] পাকিস্তানের সমাজে বিয়ে বলতে অভিভাবক দ্বারাই হয় আর প্রেম করে হয় খুবই কম।[১২] প্রতি বছরই সম্মান রক্ষার্থে হত্যা এর খবর আসে।[১৩] অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েটাকে মেরে ফেলা হয় কিন্তু আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে দুজনকেই মারা হয়।[১৪] পাকিস্তানের হিউম্যান রাইটস কমিশন অনুযায়ী অনেক মেয়ে প্রেম করার অপরাধে খুন হয়েছে, মিডিয়া অনেক সময় এই ধরনের ঘটনা এড়িয়ে যায়।[১৫]

বাংলাদেশে সম্পাদনা

বাংলাদেশে প্রেম-ভালোবাসা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে অনেক কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ[১৬]; প্রায়ঃশ ক্ষেত্রেই ছেলেদের একতরফা প্রেমের ঘটনা দেখা যায়, যদি কোনো মেয়ে কোনো ছেলেকে পাত্তা দেয় এবং ভালোবাসে অর্থাৎ যদি দ্বিতরফা প্রেম হয় তখন পালিয়ে বিয়ের মত ঘটনা দেখা যেতে পারে যদি মেয়ের বাবামা ছেলেটাকে পছন্দ না করে।[১৭][১৮][১৯][২০] বাংলাদেশের সমাজ যেহেতু অনেক রক্ষণশীল, সেহেতু মেয়েদেরকে ছেলেদের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করা হয় পরিবার থেকে, বাংলাদেশের সমাজে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যকার বন্ধুত্ব একেবারেই সমর্থিত নয়। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী একজনের পক্ষে জীবনসঙ্গী অর্জন করাটা অনেক দুষ্কর একটা কাজ এবং এটা ছেলেদের জন্য আরো বেশি কঠিন, ছেলেরা আয়-রোজগার না করলে তাদের পক্ষে প্রেম করে বিয়ে বা অভিভাবক দ্বারা বিয়ে কোনোটাই করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের সমাজে মূলত আনুষ্ঠানিক বিয়েই হয়ে থাকে।[২১][২২]

সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বাংলাদেশের সমাজে প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে একেবারেই হয়না, তবে মেয়েদের অভিভাবকদের ছেলেদের সঙ্গে দূর্ব্যবহার এবং তিরস্কার করা অনেক সাধারণ ঘটনা, অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের বাবামারা প্রেমিক ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে।[২৩] আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের আইনেও প্রেমে-ভালোবাসার বৈধতা দেওয়া নেই যেখানে প্রেমিক ছেলেরা তাদের স্বপক্ষে লড়তে পারে।[২৪][২৫] বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮৭২ সালের একটি বিশেষ বিবাহ আইন (ব্রিটিশ আমলে বানানো মূলত আন্তঃধর্মের মানুষের মধ্যকার বিয়ে সম্পর্কিত আইন, যেমনঃ হিন্দুর সঙ্গে মুসলিমের বিয়ে, এটাও অভিভাবক দ্বারা বিয়ে) রয়েছে কিন্তু ওখানেও প্রেম-ভালোবাসার কোনো বৈধতা দেওয়া হয়নি।[২৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Mr Henrike Donner (২৮ ডিসেম্বর ২০১২)। Domestic Goddesses: Maternity, Globalization and Middle-class Identity in Contemporary India। Ashgate Publishing, Ltd.। পৃষ্ঠা 80, 86। আইএসবিএন 978-1-4094-9145-3। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ 
  2. "Glitz and tradition at Sri Lanka society wedding"BBC News। ১৩ এপ্রিল ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫Society is becoming more Westernised, too: this is a love marriage, not one arranged by the family. 
  3. "Pakistan police to protect Afghan runaway couple"BBC News। ২৩ জুলাই ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫The couple say that they entered Pakistan illegally about three weeks ago and had a secret love marriage. 
  4. "The Malleable Estate: Is marriage more joyful than ever?"Slate। ১৭ মে ২০০৫। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ 
  5. "Ten key moments in the history of marriage"BBC News। ১৪ মার্চ ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ 
  6. Katherine Twamley (১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। Love, Marriage and Intimacy Among Gujarati Indians: A Suitable Match। Palgrave Macmillan। পৃষ্ঠা 68। আইএসবিএন 978-1-137-29430-2। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ 
  7. "Arranged marriages losing respect"Times of India 
  8. "NDTV mid-term poll: Does India still want arranged marriages?"NDTV। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  9. "Inter-caste ties behind most honour crimes. Just 3% cases due to same gotra marriages, says new survey"The Tribune (India)। ৫ জুলাই ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  10. "Masculinity, Intimate Partner Violence and Son Preference in India"। International Center for Research on Women। 
  11. https://blogs.arynews.tv/yes-or-no-a-confused-concept-of-love-marriages-in-pakistan/[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  12. https://www.dawn.com/news/1388758
  13. "Pakistan stoning victim's husband condemns police"BBC News। ২৯ মে ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ 
  14. "Pakistan 'love marriage' couple murdered by girl's family"The National (Abu Dhabi)। ২৯ জুন ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ 
  15. "Dark tale of love and murder in Pakistan's rural heartland"Reuters। ৩০ মে ২০১৪। ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ 
  16. "ছেলে-মেয়েতে বন্ধুত্ব"bdnews24.com। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ 
  17. Towheed Feroze (৩০ মার্চ ২০১৪)। "Love, elopement, and an unopened prophylactic"Dhaka Tribune। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  18. Nasrin Siraj (২৮ মার্চ ২০১৭)। "The Freedom of (not) being married in Bangladesh"newagebd.net। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  19. "Love, elopement, and all that"dhakatribune.comDhaka Tribune। ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ২৯, ২০১৮ 
  20. "Couple, student commit 'suicide' in Dhaka"bdnews24.comBdnews24.com। জুলাই ১৯, ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ৫, ২০১৮ 
  21. "To Love In Bangladesh"HuffPost 
  22. "6 Places In The World Where Arranged Marriages Is Traditional & Historically Practiced"Elite Daily 
  23. "Jailed for love"The Daily Star। ৩ আগস্ট ২০১৯। 
  24. "বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও ধর্ম"dw.com 
  25. তানজিম আল ইসলাম (১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। "আইন অধিকারঃ পালিয়ে বিয়ে?"প্রথম আলো 
  26. "The Special Marriage Act, 1872 (ACT NO. III of 1872)"bdlaws.minlaw.gov.bd