প্রাগজ্যোতিষপুর

ভারতের আসামে বর্তমান গুয়াহাটির অন্তর্গত মধ্যযুগের বর্মন রাজবংশের ঐতিহাসিক নগর তথা কামরুপ রাজ

প্রাগজ্যোতিষপুর (উচ্চাৰণ: prāgˈʤjəʊtɪʃˌpʊərə), ভারতের আসামে বর্তমান গুয়াহাটির অন্তর্গত মধ্যযুগের বর্মন রাজবংশের ঐতিহাসিক নগর তথা কামরূপ রাজ্যর রাজধানী ছিল।[১] খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের পর প্রাগজ্যোতিষপুর নাম প্রচলন হয়েছিল।[২] তদুপরি প্রাগজ্যোতিষপুর, প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যর রাজধানী ছিল।

প্রাগজ্যোতিষপুরের ধ্বংসাবশেষ

নামর উৎপত্তি সম্পাদনা

রামায়ণে লেখা আছে যে, বিশ্বমিত্র মুনির পুত্র প্রপিতামহ (ছোট কাকা) কুশ রাজার পুত্র অমূর্তরাজ প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘প্রাগ’ শব্দের অর্থ হল ‘পূর্ব’, ‘জ্যোতিষ’ মানে চন্দ্র, সূর্য, ইত্যাদি গ্রহ-নক্ষত্রসমূহের অবস্থান থেকে মানুষের ভাগ্য গণনা করার বিদ্যা। প্রামন্দিরষ রাজ্যের রাজধানী ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর। কথিত আছে যে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা একবার এখানে একটা নক্ষত্র সৃষ্টি করেছিলেন এবং তখন থেকেই এই স্থানটির নাম প্রাগজ্যোতিষপুর হয়।[৩]

অতি প্রাচীনকালে প্রাগজ্যোতিষপুর জ্যোতিষ চর্চার কেন্দ্র ছিল। বর্তমান গুয়াহাটিই তখনকার প্রাগজ্যোতিষপুর। প্রাগজ্যোতিষপুর মানে পূর্ব দিকের জ্যোতিষ চর্চা করা নগর।

 
শ্রীকৃষ্ণের প্রাগজ্যোতিষপুরে পদার্পণ করার মুহূর্ত

অবস্থান সম্পাদনা

খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কামরূপ রাজ্যর পতন পর্যন্ত প্রাগজ্যোতিষপুরের সঠিক অবস্থান উল্লিখিত কোনো লিপি উপলব্ধ নেই।[৪] প্রাগজ্যোতিষপুরের সঠিক অবস্থান এখনও অজ্ঞাত। মধ্যযুগের পরবর্তীতে লাভ করা তিনটি লিপিতে প্রাগজ্যোতিষপুরের অবস্থানের সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। ১৪৯৭ সালের ধুনুনতরাইর লিপি মতে গণেশগুরি, ১৭৩২ সালের দিহিঙীয়া বরফুকনের লিপি মতে নীলাচল পাহাড়ের দক্ষিণ ঢাল এবং ১৭৫২ সালের তরুণ দুবরা বরফুকনের লিপি মতে নবগ্রহ মন্দির প্রাগজ্যোতিষপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৫] তদুপরি বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ প্রাগজ্যোতিষপুরের বিষয়ে নানা মত দেন।[৬]

গুয়াহাটির চিত্রাঞ্চল পাহাড়ে অবস্থিত নবগ্রহ মন্দির প্রাগজ্যোতিষপুর নামের উৎপত্তিকে গুরুত্ব প্রদান করে। এই মন্দির অত্যন্ত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যসম্পন্ন। নবগ্রহ মন্দিরের সঙ্গে অনেক কিংবদন্তি ও জনশ্রুতি জড়িত হয়ে আছে। এই মন্দির কে, কখন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। এই মন্দিরের প্রাঙ্গনে থাকা এক শিলালিপি অনুসারে ১৭৫২ সালে আহোম স্বর্গদেউ রাজেশ্বর সিংহ মন্দিরটি নতুনভাবে নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৮৯৭ সালে বড় ভূমিকম্পে এই মন্দিরটির বিস্তর ক্ষতি হয় এবং পরে ধর্মপ্রাণ মানুষদের সহযোগিতায় পুনরায় মেরামতি করে নতুন করা হয়। গ্রহ-নক্ষত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত হিসাবে প্রাগজ্যোতিষপুরের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ পাওয়া যায়।[৭]

হিউয়েন সাঙের লেখায় সম্পাদনা

পুষ্য বর্মা (রাজত্বকাল ৩৫০-৩৭৪ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করা বর্মা বংশের ত্রয়োদশ রাজা কুমার ভাস্কর বর্মার (রাজত্বকাল ৬০০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্বকালে হিউয়েন সাঙ কামরূপে (পুরাতন আসাম) এসেছিলেন। পুষ্য বর্মা শ্রীকৃষ্ণ যুগের ভগদত্তের বংশধর বলা হয়। কারণ তাদের বংশের তথ্যসমূহের নরক বংশের নরকাসুর, ভগদত্ত এবং ব্রজদত্তর সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায়। ভাস্কর বর্মা, বর্মা বংশের একজন সুপ্রসিদ্ধ রাজা নামে পরিচিত। তিনি চিরকুমার ছিলেন বলে উত্তরাধিকারী না থাকায় মৃত্যুর পর শালস্তম্ভ শালস্তম্ভ বা ম্লেচ্ছরাজ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। উত্তর ভারতের রাজা হর্ষবর্দ্ধন বা শীলাদিত্য, কুমার ভাস্কর বর্মার সমসাময়িক ছিলেন।

তখন কামরূপের রাজধানী প্রাগজ্যোতিষপুর ছিল যে অংশে বর্তমান গুয়াহাটি অবস্থিত। রাজধানীটি প্রায় ৫ মাইল বিস্তৃত ছিল। কিন্তু শহরটি কিসের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, উন্নত গ্রাম হিসাবে না অন্য কোনো রূপে ইত্যাদি কথা বর্ণনা করা হয়নি। জনসাধারণের জীবিকা ঘরোয়া কৃষির ওপর নির্ভর ছিল। কৃষিকাজ নিয়মিতভাবে করা হত। সেগুলির ভিতর কাঁঠাল এবং নারিকেল অধিকরূপে উৎপাদিত হত বলে উল্লেখ করছে। যদিও স্থানটি পাহাড়ে আবৃত ছিল তথাপি এটি নিম্নে অবস্থিত ছিল এবং এর জলবায়ু মনোরম ছিল। স্থানটির কৃষিক্ষেত্র সারিবদ্ধভাবে ছিল এবং জলসিঞ্চনের ব্যবস্থাও উন্নত ছিল। রাজা ভাস্কর বর্মা চীন পর্যন্ত উভয় সময় তীর্থযাত্রীদের রোদ-বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জীব-জন্তুর ছাল দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। পরিব্রাজক পণ্ডিত হিউয়েন সাঙ কামরূপের জনসাধারণের বিষয়ে এইমত উল্লেখ করেছেন যে স্থানটির জনসাধারণের আচরণ সহজ এবং সরল। মানুষেরা ছাপের এবং ছালের বর্ণের কৃষ্ণ-পীত বর্ণের। মানুষদের কিছু উগ্র এবং কিছু বর্বরতার ছাপ ছিল। তারা কিছু কাজ তলিয়ে না ভেবেই করত। তাদের স্মরণ শক্তি সক্রিয় ছিল। তাদের অধ্যয়নের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। বামুনদের বসবাস এবং আর্যদের সাহায্যে কামরূপে শিক্ষার পরিবেশের উন্নতি ঘটেছিল। এবং এখানকার ছাত্ররা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে যেত। তখন গবেষণা, তর্ক ইত্যাদি ছাত্রদের মধ্যে প্রাধান্য পেত। কিছু তথ্য যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সত্য-অসত্য নিরূপণের উপস্হাপন করা হত।

কামরূপের মানুষ দেব-দেবীকে পূজা-অর্চনা করত। পূজাস্থল হিসাবে একশোরো অধিক দেব-দেবীর মঠ-মন্দির ছিল। বামুনদের পূজা-অর্চনার পদ্ধতি বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য ছিল। হয়তো হিন্দু হয়েও অন্য ধর্মের মিশ্রিত রূপের প্রবাহ ধাবমান ছিল।[৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Chaudhury, P. D.। Directorate of Archaeology, Assam। পৃষ্ঠা 17।  অজানা প্যারামিটার |বছৰ= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); অজানা প্যারামিটার |শিৰোনাম= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  2. (Boruah 2003:339)
  3. পৌরণিকা, অমল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা - ১০২
  4. (Boruah 2003:342)
  5. (Boruah 2003:342–343)
  6. , যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো প্রমাণ দিতে আসামর্থতা প্রকাশ করেন।(Borauh 2003:343)
  7. Sonalker, Manoher V. (২০০৭)। India: The Giant Awakens!। Atlantic Publishers & Dist। পৃষ্ঠা 159। 
  8. রাজেশ্বর রাভা,হিউয়েন চাঙর আসাম ভ্রমণ, বর্হমথুরি (এন আই টি শিলচরের বসন্ত পত্রিকা)

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা