প্রতিমা ঠাকুর (জন্ম: ৫ নভেম্বর ১৮৯৩ - মৃত্যু: ৯ জানুয়ারি ১৯৬৯) (ইংরেজি: Pratima Tagore) একজন লেখিকা, কবি, চিত্রশিল্পী এবং নৃত্যবিশারদ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলির নৃত্যনির্দেশনা ও পরিকল্পনায় তার ভূমিকা স্মরণীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর বিভিন্ন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। প্রতিমা ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ এবং রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী।[১]

প্রতিমা ঠাকুর

প্রথম জীবন সম্পাদনা

প্রতিমা ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ এবং রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী। তার পিতার নাম শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়। অবনীন্দ্রনাথের এবং গগনেন্দ্রনাথের বোন বিনয়িনী দেবী তার মা। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ছোট প্রতিমাকে দেখে তাকে নিজের পুত্রবধূ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মৃণালিনীর অকালমৃত্যুর ফলে তা সম্ভব হয় নি। এরপর মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রতিমার বিয়ে হয় গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবোন কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথের সাথে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে নীলানাথের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথের বিলেত থেকে ফিরলে তার সাথে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি সমাজ সংস্কারকে অগ্রাহ্য করে প্রতিমা এবং রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দেন। এই বিয়ে ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রথম বিধবা বিবাহ। [১][২]

কর্মজীবন সম্পাদনা

তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং তার স্বামীর সাথে বিশ্বভারতী এবং শান্তিনিকেতনের নানা কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি নানারকমের কারুশিল্প প্রবর্তনে এবং রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য পরিকল্পনায় সহযোগিতা করতেন। তিনি একজন ভালো চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তিনি কিছুদিন ইতালীয় শিক্ষক গিলহার্ডির কাছে ছবি আঁকা শিখেছিলেন।[১]

শেখাবার ব্যবস্থা করা। সেসময়ে বাঙালিদের ভিতরে নাচ শেখাবার খুব একটা ব্যবস্থা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের বাল্মিকীপ্রতিভা এবং মায়ার খেলায় যৎসামান্য নাচের অংশ ছিল। তিনি নিজে মঞ্চে উপস্থিত খুব কম হতেন। তার বিয়ের অল্প পরে শান্তিনিকেতনে মেয়েদের প্রথম অভিনয় লক্ষ্মীর পরীক্ষাতে তিনি ক্ষীরির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এরপর নিজে অভিনয় না করলেও রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের তিনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহী। রবীন্দ্রনাথ নিজেও চিত্রাঙ্গদা বা পরিশোধ নিয়ে নৃত্যনাট্য রচনার পরিকল্পনা করেন নি। কিন্তু প্রতিমা দেবী যখন নৃত্যনাট্যের খসড়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে যান তখন তিনি এই নতুন শিল্পরূপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। প্রতিমা দেবী কখনও নাচ শেখেননি এবং নিজে নৃত্যশিল্পী ছিলেন না। তিনি বর্ষামঙ্গলের দু একটি নাচে রূপ দেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকে পূজারিনী কবিতার নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করাবেন মনস্থ করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন নটীর পূজা। প্রতিমা দেবী অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করালেন। শ্রীমতীর ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করেছিলেন নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরী। [২]

প্রায় চোদ্দ বছর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিমা রাবীন্দ্রিক গীতিনাট্যের স্থায়ী রূপ তৈরি করলেন চিত্রাঙ্গদায়। এর আগে এসেছিল শাপমোচনচিত্রাঙ্গদার নাচের বৈশিষ্ট্যগুলি আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল চণ্ডালিকাতে। প্রতিমা অন্তরালে থেকে পোশাক পরিচ্ছদ সাজ প্রভৃতির দিকে নজর রাখতেন। মঞ্চ-সজ্জাতেও তিনি শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। তিনি শেষের দিকে মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনা ছবি এঁকে রাখতেন। তিনি কলাভবনের শিল্পীদের দিয়ে নাচের ভঙ্গি আঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। রবীন্দ্রনাথ রচিত নাটকগুলির শালীন সৌন্দর্যের দিকে তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। তিনি মায়ার খেলা নাটকেরও নতুন রূপ দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের ক্ষুধিত পাষাণদালিয়া, কথা ও কাহিনীর সামান্য ক্ষতি প্রভৃতি গল্পগুলিকে ট্যাবলো ধরনের মূকাভিনয় আকারে রূপায়িত করেছিলেন। [২]

প্রতিমার নির্দেশনায় শান্তিনিকেতনের নৃত্য কোন বিশেষ প্রকারের নৃত্যশৈলীর আঙ্গিককে গ্রহণ করেনি। মিশ্র তাল ও ভঙ্গির সংমিশ্রনে তিনি বৈচিত্র এনেছিলেন এবং তাকে সার্থক ভাবে সঙ্গীতের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিলেন। [২]

সাহিত্যপ্রতিভা সম্পাদনা

প্রতিমা কল্পিতাদেবী ছদ্মনামে প্রবাসী পত্রিকাতে অনেক কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার এই কল্পিতাদেবী ছদ্মনামটি ঠিক করে দিয়েছিলেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] রবীন্দ্রনাথ কখনো কখনো তার কবিতাগুলিকে সংশোধন করে দিতেন। তার গদ্য রচনাগুলিতে লিপিকার বিশিষ্ট ভঙ্গি চোখে পড়ে। তার রচিত স্বপ্নবিলাসী পড়ে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লেখেন মন্দিরার উক্তি[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

প্রতিমা দেবী রচিত নির্বাণ বইটিতে রবীন্দ্রজীবনের শেষ বছরের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। স্মৃতিচিত্র বইটিতে অবনীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের কথা আছে এছাড়া এতে বাড়ির মেয়েদের কথা এবং উৎসবের কথা। নৃত্য বইটিতে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার বিষয়ে লিখেছিলেন। চিত্রলেখা তার রচিত কবিতা এবং কথিকার সংকলন।

অন্যান্য সম্পাদনা

প্রতিমা শান্তিনিকেতনে নারীশিক্ষা এবং নারীকল্যাণের দিকেও নজর রাখতেন। তিনি মেয়েদের নিয়ে আলাপিনী সমিতি গঠন করেছিলেন। এই সমিতিতে অভিনয় এবং গান হত। তার ব্যবস্থাপনায় আশ্রম থেকে মেয়েরা গ্রামে গিয়ে গ্রামের অশিক্ষিতা মেয়েদের স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, শরীরের যত্ন, হাতের কাজ প্রভৃতি বিষয় শেখাতেন। [২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান - প্রথম খণ্ড - সাহিত্য সংসদ আইএসবিএন ৮১-৮৫৬২৬-৬৫-০
  2. ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল - চিত্রা দেব - আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড - প্রথম সংস্করণ