প্রজাপতি লেপিডোপ্টেরা বর্গের অন্তর্গত এক ধরনের কীট। এদের শরীর উজ্জ্বল রঙের এবং এরা দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রজাপতির বেশিরভাগ প্রজাতিই দিবাচর বলে এরা সহজেই নজর কাড়ে। এদের মাথায় গোলাকার পুঞ্জাক্ষী রয়েছে। প্রজাপতির ১০ খণ্ডে গঠিত দেহ আকৃতিতে অনেকটা বেলনের মত, শেষের ২-৩টি খন্ড যৌনাঙ্গে পরিণত হয়েছে []।এছাড়াও প্রজাপতির জন্ম ডিম থেকেই হয়। তবে ডিম থেকে সরাসরি প্রজাপতি বের হয় না। প্রথমে শুঁয়োপোকা বের হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর শুঁয়োপোকা প্রজাপতিতে রুপান্তরিত হয়। আজ থেকে প্রায় ১০ কোটি বছর আগে উত্তর আমেরিকার আকাশে প্রজাপতি প্রথম উড়েছিল বলে জানা যায়।[] এরা পা দিয়ে ভেজা মাটি থেকে পানি শোষণ করতে পারে।

প্রজাপতি
কেয়ার্নস বার্ডউইং- অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম প্রজাপতি.
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণীজগৎ
পর্ব: সন্ধিপদী
শ্রেণী: পতঙ্গ
বর্গ: লেপিডোপ্টেরা
শ্রেণীবিহীন: Rhopalocera
Subgroups

উৎপত্তি

সম্পাদনা
 
সম্ভবত আসল বাটার-ফ্লাই যার থেকে নাম এসেছে বলে ধারণা করা হয়।[]

প্রজা ও পতি মিলে গঠিত প্রজাপতি একটি তৎসম শব্দপ্রজা অর্থ রাষ্ট্রের অন্তর্গত জনগণ, সন্তান-সন্ততি, জীবসমূহ; জমিদারির রায়ত। তবে প্রজাপতি শব্দে বর্ণিত প্রজা অর্থ জীবসমূহ এবং পতি শব্দের অর্থ পালক, প্রভু। বাংলা অভিধান মতে তৎসম শব্দ প্রজাপতি অর্থ জীবসমূহের পালক। তবে বাংলা বিশেষ্য শব্দ প্রজাপতি অর্থ বিচিত্র ডানাবিশিষ্ট পতঙ্গবিশেষ।[]

প্রজাপতি শব্দের ইংরেজি butterfly শব্দটি অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের মতে পুরাতন ইংরেজি শব্দ butorflēoge, butter-fly; থেকে সোজাসাপ্টা চলে এসেছে। নামের একটি সম্ভাব্য উৎস হল গন্ধকের উজ্জ্বল হলুদ পুরুষ (Gonepteryx rhamni); আরেকটি হল বসন্ত ও গ্রীষ্মের ‘মাখন’ বা 'butter' মৌসুমে ঘাসের বৃদ্ধির সময় প্রজাপতিরা তৃণভূমিতে ডানা মেলে ওড়া। [][]

প্রজাপতির জীবনচক্র

সম্পাদনা

প্রজাপতি সন্ধিপদী পর্বের অন্তর্ভুক্ত পতঙ্গ শ্রেণীর প্রাণী। প্রজাপতি বিভিন্ন রকমের হয়। পশ্চিমবঙ্গে যে প্রজাপতি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তার বিজ্ঞান সম্মত নাম: প্যাপিলিয়ো ডেমোলিয়াস (Papilio demoleus)।

প্রজাপতির জীবনচক্র অন্যান্য পতঙ্গের মতো চারটি দশার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়।

দশাগুলি হল, ডিম (Egg), লার্ভা (Larva), পিউপা (Pupa) এবং পূর্ণাঙ্গ (Imago)।

ডিম: স্ত্রী প্রজাপতি দিনের বেলায় গাছের পাতার নিচের তলে ডিম পাড়ে। আকন্দ, মূলো, সরষে ইত্যাদি গাছের পাতার তলপিঠে সাধারণত ডিম পাড়তে দেখা যায়।

  • স্ত্রী-প্রজাপতি এক সময়ে প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০টি ডিম পাড়ে।
  • ডিমগুলি কাছাকাছি কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে থাকে।
  • ডিম দেখতে পোস্ত দানার মতো ছোট। প্রতিটি ডিম এক মিলিমিটার লম্বা এবং প্রায় ০.৫ মিলিমিটার চওড়া হয়।
  • ডিমের রঙ প্রথমে হলুদ থাকে, পরে ধূসর হয়।
  • ডিমের গায়ে লম্বা লম্বা রেখা ও আড়াআড়ি খাঁজ দেখা যায়।

লার্ভা:চার-পাঁচ দিন পর ডিম থেকে লার্ভা বেরিয়ে আসে।

  • লার্ভা জন্মানোর পর সে ডিমের খোলস খেয়ে ফেলে।
  • প্রজাপতির লার্ভার গায়ে প্রচুর শুয়ো থাকে। তাই এদের শুঁয়োপোকা বা ক্যাটারপিলার (Caterpillar) বলা হয়।
  • লার্ভা প্রচুর পরিমাণে পাতা খেয়ে ক্রমশ বড় হয়।
  • মোট পাঁচবার খোলস ত্যাগ করে পরিণত লার্ভা হয়। খোলস ত্যাগের সময় এরা খায় না। পরিণত লার্ভা লম্বায় প্রায় ৪৫ মিলিমিটারের মতো হয়।
  • প্রজাপতির লার্ভার দেহে ১৪ টি দেহখন্ডক থাকে। প্রথম দেহখন্ডক নিয়ে মাথা, পরের তিনটি দেহখন্ডক নিয়ে বুক ও শেষ দশটি দেহখন্ডক নিয়ে উদর গঠিত।
  • বুকে তিনজোড়া পা (Legs) থাকে।
  • সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম এবং শেষ দেহখন্ডের প্রতিটিতে একজোড়া করে উপপদ বা চোষকপদ (Prolegs or Sucker-legs) দেখা যায়।
  • শেষ জোড়া উপপদগুলি বেশ বড় ও শক্তিশালী। একে ক্লাসপার (Clasper) বলা হয়।
  • দ্বিতীয় এবং পঞ্চম থেকে দ্বাদশ দেহখণ্ডকের প্রতিটির দুপাশে ছোট ছোট শ্বাসছিদ্র (Spiracles) দেখা যায়।
  • উপযুক্ত পরিবেশে ঠিকমতো খাবার পেলে লার্ভা পরিণত হতে প্রায় ১৬ দিন সময় লাগে।

পিউপা: শেষ খোলস ত্যাগের পর লার্ভা পিউপায় রূপান্তরিত হয়। এই অবস্থায় এরা খাবার খায় না। এরা মুখ থেকে একরকম লালা নিঃসরণ করে। এই লালা শুকিয়ে গেলে রেশমী দড়ি বা ক্রিম্যাস্টার (Cremaster) গঠিত হয়। এটির সাহায্যে প্রাণীটি পিছন দিক আটকে ঝুলতে থাকে। তারপর কয়েকদিনের মধ্যে দেহের চারপাশে একটি অর্ধস্বচ্ছ আবরণ তৈরি করে। এই আবরণকে বলা হয় পিউপেরিয়াম (Puparium)। পিউপেরিয়ামের ভেতরের প্রাণীটির নামই পিউপা (Pupa)। পিউপা দশা প্রায় সাতদিন থাকে।

  • পিউপা দেখতে সামান্য লম্বা, দুপ্রান্ত সরু, মাঝখানে মোটা।
  • লার্ভার তুলনায় পিউপা আকারে অনেক ছোট হয়।
  • পিউপার রঙ প্রথমে হলুদ ও পরে ধূসর হয়।
  • প্রজাপতির পিউপাকে ক্রিসালিস (Crysalis) বলে।

পূর্ণাঙ্গ বা সমঙ্গ: পিউপা রূপান্তরিত হয়ে প্রজাপতিতে পরিণত হয়। পরিণত প্রজাপতি পিউপেরিয়াম ভেদ করে বাইরে আসে। এরা উড়তে পারে। প্রজাপতির বৈশিষ্ট্য:

  • প্রজাপতির দেহ মাথা, বুক ও উদর নিয়ে গঠিত।
  • মাথায় একজোড়া পুঞ্জাক্ষি (Compound Eye) ও শুঙ্গ (Antenna) থাকে। মুখের উপাঙ্গ নলাকার। একে শুঁড় (Proboscis) বলে।
  • বুকে তিনজোড়া পা এবং একজোড়া ডানা থাকে। ডানার রঙ চিত্রবিচিত্র ও খুবই আকর্ষণীয়। ডানায় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আঁশ থাকে। এগুলি বিভিন্ন রঙের হয় বলেই ডানায় এতো রঙের বৈচিত্র্য দেখা যায়।[]

জীবাশ্মবিজ্ঞান

সম্পাদনা

প্রাচীনতম লেপিডোপ্টেরার জীবাশ্মগুলি প্রায় ২০ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক-জুরাসিক যুগের মাঝামাঝি সময়ের।[] প্রজাপতি মথ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রাচীনতম পরিচিত প্রজাপতির জীবাশ্ম পাওয়া গেছে ডেনমার্কে, নাম Protocoeliades kristenseni এবং এটি প্যালিওসিন যুগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে বসবাস করতো।[] যদিও বিজ্ঞানীরা প্রজাপতির জিন বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছেন প্রাচীনতম প্রজাপতি প্রায় ১০ কোটি বছর আগে বিবর্তিত হয়েছিল আমেরিকতে।[] তবে প্রাচীনতম আমেরিকান প্রজাপতি হল Prodryas persephone,[][১০] প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর আগের।[১১]

চিত্রশালা

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "বাংলাপিডিয়া প্রজাপতি নিবন্ধ"। ১৪ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 
  2. ঐশী, নুজহাত সুবাহ (২০২৩-০৫-২৬)। "প্রজাপতির প্রথম বিবর্তন ঘটেছিলো উত্তর আমেরিকায়"বিজ্ঞানবার্তা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৩ 
  3. Marren, Peter; Mabey, Richard (২০১০)। Bugs Britannica। Chatto and Windus। পৃষ্ঠা 196–205। আইএসবিএন 978-0-7011-8180-2 
  4. আধুনিক বাংলা অভিধান। ঢাকা: বাংলা একাডেমিআইএসবিএন 9840757962 
  5. Donald A. Ringe, A Linguistic History of English: From Proto-Indo-European to Proto-Germanic (Oxford: Oxford, 2003), 232.
  6. মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞান: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী,শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর: ১৯৮৬, পৃ. ১৭৭,১৭৮
  7. Eldijk, Timo J. B. van; Wappler, Torsten; Strother, Paul K.; Weijst, Carolien M. H. van der; Rajaei, Hossein; Visscher, Henk; Schootbrugge, Bas van de (২০১৮-০১-০১)। "A Triassic-Jurassic window into the evolution of Lepidoptera"Science Advances (ইংরেজি ভাষায়)। 4 (1): e1701568। আইএসএসএন 2375-2548ডিওআই:10.1126/sciadv.1701568পিএমআইডি 29349295পিএমসি 5770165 বিবকোড:2018SciA....4.1568V 
  8. De Jong, Rienk (২০১৬-০৮-০৯)। "Reconstructing a 55-million-year-old butterfly (Lepidoptera: Hesperiidae)"। European Journal of Entomology113: 423–428। ডিওআই:10.14411/eje.2016.055  
  9. Meyer, Herbert William; Smith, Dena M . (২০০৮)। Paleontology of the Upper Eocene Florissant Formation, Colorado। Geological Society of America। পৃষ্ঠা 6। আইএসবিএন 978-0-8137-2435-5। ২৪ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ জানুয়ারি ২০১৬ 
  10. "Lepidoptera – Latest Classification"Discoveries in Natural History & Exploration। University of California। ৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুলাই ২০১১ 
  11. McIntosh, W. C.; ও অন্যান্য (১৯৯২)। "Calibration of the Latest Eocene-Oligocene geomagnetic Polarity Time Scale Using 40Ar/39Ar Dated Ignimbrites"Geology20 (5): 459–463। ডিওআই:10.1130/0091-7613(1992)020<0459:cotleo>2.3.co;2বিবকোড:1992Geo....20..459M 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা