পুকুইয়ো হল সেচের জন্য মাটির নীচ দিয়ে একধরনের জলপরিবহন ব্যবস্থা। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন রিও গ্রন্দে নদী উপত্যকা অঞ্চলে বিকশিত প্রাচীন নাজকা সংস্কৃতিতে (সময়কাল ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দ) কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলপরিবহনের লক্ষ্যে এই ধরনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। অঞ্চলটি ছিল ভৌগোলিক দিক থেকে অত্যন্ত শুষ্ক একটি অঞ্চল। তাই কৃষিকাজের জন্য সেচের জলের ব্যবস্থা করা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই প্রয়োজন থেকেই সেখানকার আমেরিন্ডীয় মানুষ জলপরিবহনের এইধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এগুলি এতই ভালোভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে দেখা গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত মোট ৩৬টি পুকুইয়োর মধ্যে বেশিরভাগই এখনও কার্যকরী।[১][২]

একটি পুকুইয়োর প্রবেশপথ - পেরুর নাজকা শহরের কাছে

বিবরণ সম্পাদনা

সমগ্র পুকুইয়ো ব্যবস্থাটি যথেষ্ট জটিল। এর অনেকগুলি অংশ আছে, তার মধ্যে প্রধান হল - মাটির নীচ দিয়ে কিছু সমান্তরাল সুড়ঙ্গপথ, জল তোলার জন্য জায়গায় জায়গায় খোলা কিছু অঞ্চল ও ফ্লানেলাকৃতি কিছু প্রবেশপথ বা ওখো (উপরের ছবি দ্রষ্টব্য)। মাটির নীচ দিয়ে খোঁড়া এই সুড়ঙ্গপথগুলি সাধারণত মাটির নীচ দিয়ে যাওয়া জলস্রোতকে আড়াআড়ি ছেদ করে ও সেখান থেকে সেগুলিতে জল প্রবেশ করে। এই সুড়ঙ্গের দেওয়াল সাধারণত বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি হয় ও জল তার মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে সুড়ঙ্গে ঢোকার সময় তা অনেকটাই পরিস্রুত হয়ে যায়। পাহাড়ি অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নিচু ঢাল অংশগুলিতে যেখানে এই সুড়ঙ্গগুলি মাটির কাছাকাছি উঠে আসে, সেখানে বড় বড় পাথরে তৈরি দেওয়াল ও মেঝে সংবলিত কিছু চেম্বার তৈরি করা হয়, যেখানে পুনরায় সুড়ঙ্গের জল চুঁইয়ে ঢোকে, অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিস্রুত হয়। এই চেম্বার গুলি হয় সাধারণত বেশ সরু, বড়জোর একজন মানুষের নামার মতো চওড়া, কিন্তু বেশ গভীর, কোথাও কোথাও এমনকী ২ মিটার পর্যন্ত। এর ছাদ কখনও কখনও থাকে খোলা, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাথর বা কাঠ দিয়ে ঢাকা। যেখানে সেগুলি কাঠের, সময়ে সময়ে সেখানে সেগুলি পাল্টানোর প্রয়োজন হয়। এই চেম্বার গুলি লম্বায় নানা দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। সাধারণত এগুলির দৈর্ঘ্য কয়েক মিটার হলেও ৩৭২ মিটার লম্বা চেম্বারও পাওয়া গেছে।

পুকুইয়ো ব্যবস্থার আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তার ফ্লানেলাকৃতি প্রবেশদ্বার বা ওখোগুলি। এগুলি মাটির কাছাকাছি বেশ চওড়া, যার ব্যাস এমনকী কোথাও কোথাও ১৫ মিটার। কিন্তু নিচের দিকে তা ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হতে হতে ১ - ২ মিটারে নেমে আসে। প্রতিটি পুকুইয়োর পাহাড়ের উপরের দিকের অংশে কিছুটা দূরে দূরে এমন অসংখ্য ওখো রয়েছে। এদের কাজ নানাবিধ। কখনও বৃষ্টি হলে সেই জল এই ওখোগুলি দিয়ে পুকুইয়োর মাটির নিচের সুড়ঙ্গে নেমে যেতে পারে। এই অংশগুলি দিয়ে সুড়ঙ্গে নেমে তা সময় সময় পরিষ্কার করা যায়, যা পরিস্রুত জলের জোগানের জন্য খুবই দরকারী। তারউপর যে কর্মীরা সুড়ঙ্গগুলিকে পরিষ্কার করার জন্য নিচে নামে, তাদের জন্য পর্যাপ্ত আলো-হাওয়ার জোগানও এগুলির দ্বারাই বজায় থাকে।

বিতর্ক সম্পাদনা

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় সাধারণভাবে দাবি করা হয় ৫৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দুটি দীর্ঘকালীন খরার সময়ে তার হাত থেকে বাঁচতে নাজকারাই এই পুকুইয়োগুলি তৈরি করে। কিন্তু এই অঞ্চলে স্পেনীয় বিজয়ের আগে বা পরে কোনও নথিতেই এগুলির তেমন কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। ১৬০৫ সালে রেজিনাল্ডো দে লিজারাখা'র লেখায় প্রথম তাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর থেকে অনেকে দাবি করেন, এগুলি আসলে স্পেনীয়দেরই হাতে তৈরি।[৩] যাইহোক, পুকুইয়ো নির্মাণের কোনও প্রকল্পের উল্লেখ রয়েছে, এমন কোনও স্পেনীয় নথি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।[৪] অন্যদিকে ক্যাটারিনা শ্রাইবার, হোসুয়ে লাঞ্চো রোখাস, প্রমুখ আধুনিক গবেষকরা আবার এগুলি স্পেনীয়-পূর্ব যুগের নির্মাণ বলেই মতপ্রকাশ করেছেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. কোলকাতা, পিপলস বুক সোসাইটি, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৮৪ - ৮৫।
  2. . Proulx, Donald A. "Nasca Puquios and Aqueducts". Originally published in German in: Nasca: Geheimnisvolle Zeichen im Alten Peru. Ed. Judith Rickenbach. Zürich: Museum Rietberg Zürich, 1999. পৃঃ - ৬; সংগৃহীত ২১ জুলাই, ২০১৫।
  3. . Proulx, 1999. পৃঃ - ৭ সংগৃহীত ২১ জুলাই, ২০১৫।
  4. . Proulx, 1999. পৃঃ - ৮ সংগৃহীত ২১ জুলাই, ২০১৫।

আরও দেখুন সম্পাদনা