পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী উপজাতিদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য গঠিত একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি স্বায়ত্তশাসন ও জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতি এবং পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিদের অধিকারের জন্য লড়াই করে আসছে। ১৯৭৫ সালে দলটির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনীর যাত্রা শুরু হয় যারা সাধারনত সরকারি বাহিনী ও বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের সাথে লড়াই করে আসছে। শান্তি বাহিনীকে নিরস্ত্রীকরন ও পিসিজেএসএসকে মূলধারার রাজনীতিতে আনার জন্য ১৯৯৭ সালে সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[১][২][৩][৪]
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি | |
---|---|
সভাপতি | সন্তু লারমা |
মহাসচিব | ঊষাতন তালুকদার |
প্রতিষ্ঠাতা | |
প্রতিষ্ঠা | ১৯৭২ |
সদর দপ্তর | পার্বত্য চট্টগ্রাম |
ছাত্র শাখা | পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ |
যুব শাখা | পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি |
মহিলা শাখা | পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি |
সশস্ত্র শাখা | শান্তি বাহিনী (বিচ্ছিন্ন) |
মহিলা শাখা | পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি |
ভাবাদর্শ | পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য স্বায়ত্তশাসন |
রাজনৈতিক অবস্থান | বামপন্থী |
জাতীয় সংসদের আসন | ০ / ৩৫০ |
দলীয় পতাকা | |
ওয়েবসাইট | |
https://www.pcjss.org/ | |
বাংলাদেশের রাজনীতি রাজনৈতিক দল নির্বাচন |
পটভূমি
সম্পাদনাজেএসএস সৃষ্টির পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের অদিবাসিরা ছাত্রদের সংগঠন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি যা ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান-এ সংগঠিত হয়েছিল।[৫] কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের ফলে অনেক অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যাদের পক্ষে সেসময় সংগঠনটি প্রায় ১০০০০০ মানুষের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিরা যেমন, চাকমা রাজনীতিবীদ চারু বিকাশ চাকমা ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এ অঞ্চলের মানুষের স্বায়ত্তশাসন এবং স্বীকৃতির অধিকার দাবি করেন।[৫] লারমা ও অন্যান্য প্রতিবাদকারীরা বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়ার প্রতিবাদ করে যদিও সংবিধানে জাতিগত পরিচয় স্বীকৃত ছিল কিন্তু তারা বাংলাদেশ থেকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন।[৬][৭] বাংলাদেশ সরকারের নীতি অনুযায়ী, বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা একমাত্র স্বীকৃত এবং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সকলেই বাঙালি। জেএসএস এর প্রথম জাতীয় সম্মেলন ১৯৭২ সালের ২৪শে জুন রাঙামাটি শহরের ইন্দ্রপুরী সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়। বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা সভাপতি ও এম এন লারমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬০ সদস্যের পিসিজেএসএস’র কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। [৮]
৪ দফা দাবি ও গঠন
সম্পাদনাবাংলাদেশের জন্মের পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ২৪ এপ্রিল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণেতাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ মোট চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো ছিল:[৫]
- (ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন
- (খ) সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অনুরূপ সংবিধির অন্তর্ভুক্তি
- (গ) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ
- (ঘ) ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
দাবিগুলি সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল, এতে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি ও কর্মীরা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) প্রতিষ্ঠা করেন। দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অধিকার, সংস্কৃতি এবং জাতিগত পরিচয় রক্ষা এবং পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতির স্বায়ত্তশাসন চালু। দলটি পার্বত্য অঞ্চলের সমস্ত উপজাতিদের একত্রিত ও প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করে এবং একটি গ্রাম কমিটি, একটি ছাত্র ও যুব শাখা এবং দলের মহিলা শাখা গঠন করে।
বিদ্রোহ
সম্পাদনাসরকার তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে অসন্তোষ ও ক্রোধে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শান্তি বাহিনীনামে একটি সামরিক বাহিনী গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। অনেক বিদ্রোহী প্রতিবেশী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রশিক্ষিত, সজ্জিত এবং আশ্রয় পেয়ে আসছে। বিদ্রোহ চলাকালীন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য অঞ্চলে সরকার-পরিচালিত বাঙালিদের আবাস গঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় পরিষদের জন্য সরকারের অন্যান্য পরিকল্পনাও প্রত্যাখ্যান করে। প্রায় দুই দশক ধরে চলমান বিদ্রোহের পর, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় বসে। তবে জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরোত্তমের স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সাথে সামান্য অগ্রগতি অর্জিত হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ মুজিবের কন্যা আওয়ামী লীগের নেত্রী ও নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে নতুন দফায় আবার আলোচনার সূচনা হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি চূড়ান্ত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়। শান্তি চুক্তি বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন, বাস্তুচ্যুত অদিবাসিদের (চাকমা,মারমা,ত্রিপুরাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির) জমি প্রত্যাবর্তন এবং জাতিগত গোষ্ঠী ও উপজাতির জন্য বিশেষ মর্যাদার ব্যবস্থা করেছিল। এই চুক্তি অনুযায়ি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং একটি আঞ্চলিক পরিষদ তৈরি করা হয়েছিল, যা পার্বত্য অঞ্চল পরিচালনা এবং স্থানীয় উপজাতি পরিষদ তদারকি করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। এই চুক্তির ফলে জাতিগত গোষ্ঠী এবং উপজাতিরা সরকারী স্বীকৃতি পায়।
এই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পরে শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহীরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অস্ত্র জমা দেয়(বর্তমানে শান্তি বাহিনির কয়েকটি উপদল পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনরায় অপততপরতা চালাচ্ছে) এবং ৫০,০০০-এরও বেশি বাস্তুচ্যুত অদিবাসী তাদের ঘরে ফিরে যেতে সক্ষম হয়। কিছুপরে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি একটি মূলধারার রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।[৫]
সাম্প্রতিক ক্রিয়াকলাপ
সম্পাদনাশান্তিচুক্তির পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মূলধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং বর্তমানে দলটির প্রধান হলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি একই সাথে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শান্তি চুক্তির পূর্ণ ও যথাযথ প্রয়োগের জন্য আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে এবং সরকার চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করছে না বলে অভিযোগ করছে।
আরো দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Rashiduzzaman, M. (১৯৯৮)। "Bangladesh's Chittagong Hill Tracts Peace Accord: Institutional Features and Strategic Concerns"। এশিয়ান সার্ভে (ইংরেজি ভাষায়)। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। ৩৮ (7): ৬৫৩–৭০। জেস্টোর 2645754। ডিওআই:10.1525/as.1998.38.7.01p0370e।
- ↑ "Bangladesh peace treaty signed" (ইংরেজি ভাষায়)। বিবিসি নিউজ। ১৯৯৭-১২-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৬-১১।
- ↑ আমেনা মোহসিন (২০১২)। "পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, ১৯৯৭"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ "পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়"। ৮ জুলাই ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০১৩।
- ↑ ক খ গ ঘ ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর, সম্পাদকগণ (২০১২)। "পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি"। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ নগেন্দ্র কে. সিং (২০০৩)। Encyclopaedia of Bangladesh (ইংরেজি ভাষায়)। আনমোল পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ২২২–২২৩। আইএসবিএন 81-261-1390-1।
- ↑ বুশরা হাসিনা চৌধুরী (২০০২)। Building Lasting Peace: Issues of the Implementation of the Chittagong Hill Tracts Accord (ইংরেজি ভাষায়)। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইন। ১ সেপ্টেম্বর ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০১৩।
- ↑ https://www.pcjss.org/about-pcjss/ }}
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে (ইংরেজি)
- অফিসিয়াল ইউপিডিএফ ওয়েবসাইট (ইংরেজি)