পাঞ্জু শাহ
পাঞ্জু শাহ ফকির (১৮৫১- ১৯১৪)[১] বাঙালি মরমি কবি যাকে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে মরমিকবি লালন ফকিরের পরেই বিবেচনা করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তবে লালন ফকির পাঞ্জুশাহের গুরু নন, তবে যুবক পাঞ্জুশাহ বৃদ্ধ লালন ফকিরের সাথে পাল্লায় গান গেয়েছেন। পাঞ্জু শাহ ১৮৫১ (বাংলা ১২৫৮) শালে শৈলকূপা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খাদেম আলী খন্দকার।
পাঞ্জু শাহের সপ্তম উর্ধ্বতন পুরুষ ছিলেন মৌলভী মোহাম্মদ নোয়াবেশ খাঁ। সম্রাট শাহজাহান যখন দিল্লীর শাহী তখতে সমাসীন, তখন নেয়াবেশ খাঁ আফগান থেকে এদেশে এসিছিলেন। বঙ্গ-সুবেদারের সুপারিশ ও বাদশাহের ফরমানে নোয়াবেশ খাঁ বৃহত্তর যশোরের অধীন শৈলকুপা এলাকার জমিদারী লাভ করেন। নোয়াবেশ খাঁ’র একমাত্র ছেলে ছিলেন দুদ্দু খাঁ। পাঞ্জু শাহ তাঁর আত্ম পরিচয়ে এই নামটি ব্যবহার করেছেন। দুদ্দু খা বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করেন। পিতার জমিদারী পরিচালনার পাশাপাশি তিনি (দুদ্দু খা) ইসলামের মর্মবাণী প্রচার করতেন। বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ (১৭০৫-১৭২৭) দুদ্দু খাঁর জমিদারী বজায় রাখার পক্ষে সমর্থন দান করেন।
দুদ্দু খাঁর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এলেচ খাঁ’র নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। পাঞ্জু শাহ তাঁর বংশ বিবরণীতে এলেচ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এলেচ শব্দটি ইলিয়াস শব্দের সংক্ষিপ্ত রুপ। এলেচ খাঁ জমিদারীর শাসন ভার গ্রহন করেন। তিনি শৈলকুপা এলাকার পরাক্রমশালী জমিদার ছিলেন।দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এই নীতি অনুসরণ করে তিনি জামিদারী পরিচালনা করতেন। শৈলকুপার বিত্তিদেবী রাজনগর এলাকার গ্রাম্য কবি বানু মোল্লা তার একটি শায়েরীতে এলেচ খাঁর নাম উল্লেখ করে লিখিছেন
“এলেচ খাঁ জমিদার,
তার বেড়ে দাপট তার,
বানু মোল্লা ভয়ে মলো
ছাগল বাঘে মিতে হলো”
বানু মোল্লার শায়েরীতে অনেক প্রচীন তথ্য সন্নিবেশিত আছে।
এলেচ খাঁ’র মৃত্যুর পর তার ছেলে আফজাল খাঁ শৈলকুপার জমিদার নিযুক্ত হন। আফজাল খাঁ পিতার মতোই শক্তিশালী ও ন্যায় পরায়ন শাসক ছিলেন। তার সময় জমিদারীর আকার-আয়তন বৃদ্ধিপায়। শৈলকুপার কবিরপুর ও হরিহরা গ্রাম পর্যন্ত জমিদারী অর্ন্তভুক্ত হয়। আফজাল খা কখনো কবি আবার কখনো বীর বলে পরিচিতি লাভ করেন। তার সময়ে শৈলকুপায় পাঠান দিঘী নামে একটি বিরাট জলাশয় খনন করা হয়, যা আজো বিদ্যমান।
জমিদার আফজাল খাঁ’র একমাত্র ছেলে আব্দুস সোবাহান খোন্দকার পিতার ইন্তেকালের পর জমিদারী লাভ করেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পরে আফজাল খাঁ পর্যন্ত এঁরা সবাই খাঁ উপাধী ধারী ছিলেন। আব্দুস সোবাহানের আমল থেকে এই উপাধী পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন থেকে এঁদের নামের সঙ্গে খোন্দকার উপাধী যুক্ত হয়।
খাঁ ছেড়ে খোন্দকার উপাধী কেন যুক্ত হলো তা নিয়ে মরমী কবি পাঞ্জু শাহঃ জীবন ও কাব্যে গ্রন্থে ডক্টর খোন্দকার রিয়াজুল হক উল্লেখ করেছেন, ‘খোন্দকা ‘ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘অধ্যাপক’ বা ‘শিক্ষক’। বাদশা অর্থেও খোন্দকার শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষক বোঝাতে খোন্দকার শব্দের প্রয়োগ বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়। মুসলিম সমাজে যারা পীর বা মুর্শিদরুপে পরিচিত তাঁরাই খোন্দকার বা খনকার নামে অভিহিত। এখানে আব্দুস সোবাহান পীরগিরি করেই খোন্দকার উপাধী লাভ করেন। পাঞ্জু শাহের লেখা থেকে এমন প্রমান পাওয়া যায়।
পাঞ্জু শাহ লেখেন
“আফজাল খাঁর বেটা সোবহান খোন্দকার
তিনি হতেখোন্দকারী দাদাজী আমার”
শৈলকুপায় সোবাহান খোন্দকার পীর জমিদার হিসেবে কিংবদন্তির নায়ক হিসেবে পরিচিত। শৈলকুপার গাড়াগঞ্জের বাজারের কাছে সোবাহান খোলা নামক স্থানে আজো মানুষ পীরের নামে শিরনী দেয়।
আব্দুস সোবাহানের একমাত্র ছেলে ছিলেন খাদেম আলী খোন্দকার। তিনি ছিলেন এই বংশের সবশেষ জমিদার। পিতার অবর্তমানে তিনিই জমিদারী পরিচালনার দায়িতাব গ্রহন করেন। তবে তাঁর মধ্যে ধর্মীয় চেতনা প্রবল থাকায় বৈষয়িক উদাসিনতা দেখা দেয়। জমিদারী গোমস্তা এই সুযোগটি গ্রহন করে। বহু খাজনা বাকী পড়ে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে অনেক জমি নিলামে ওঠে। গোমস্তা ওই সব জমি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে নিলামে কিনে নেন। ফলে খাদেম আলী খোন্দকার গোমস্তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। খাদেম আলী খন্দকার গোমস্তার চক্রান্ত বুঝতে পেরে আইনগত উদ্যোগ নিয়ে গোমস্তা দুর্বৃত্তদের নিয়ে তার প্রাননাশের চেষ্টা করেন। তখন খাদেম আলী খন্দকার দুই ছেলে পাঞ্জু শাহ ও ওছিমউদ্দীনকে নিয়ে বর্তমান হরিণাকুণ্ড থানার হরিশপুর গ্রামে চলে আসেন। হরিশপুর গ্রামের পরাণ কাজী ছিলেন খাদেম আলী খোন্দকারের বড় জামাই। এই সুত্রে তিনি হরিশপুরে যাতায়াত করতেন। হরিশপুরে যাতায়াত কালে খাদেম আলী খোন্দকারের সঙ্গে ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে। ফলে চরম বিপদের দিনে ফকির মাহমুদ তাঁকে পরম আদরে জায়গা করে দেন। হরিশপুরের বাটিকামারা বিলের ধারে ঘরবাড়ি তৈরী করে দেন ফকির মাহমুদ। জমিদার খাদেম আলী খোন্দকার সেই থেকে হরিশপুরে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করতে থাকেন। এ ভাবে বাকী জীবন খাদেম আলী খোন্দকারের দারিদ্রতার মধ্যে কাটে। বিশাল ভু-সম্পত্তি হারানোর ক্ষোভ বা এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোন দাম্ভিকতা ছিল না। বরং তিনি মসজিদের ইমাম, সমাজের মোল্লা ও ইসলাম প্রচারক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১২৮৫ বঙ্গাব্দের ২০ ভাদ্র খাদেম আলী খোন্দকার ইন্তেকাল করেন। তার মাজার হরিশপুরে হলেও তা চিহ্নিত নয়।
লালন-পরবর্তী মরমী কবিগণের মধ্যে পাঞ্জু শাহের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। লালন শাহের আশীর্বাণী ও স্বীকৃতি পাঞ্জকে মরমী সাধক-সমাজে পরিচিত করে তোলে এবং দীর্ঘদিন এ দেশের সাধকমণ্ডলীর পরিচালকরূপে নিয়োজিত রাখে। এ সম্পর্কে খোন্দকার রফি- উদ্দীনের মন্তব্য বিশেষ মূল্যবান। তিনি বলেন-'বাংলার সূফী ফকিরদের মধ্যে লালনের স্থান সর্বোচ্চ। কিন্তু লালনের তিরোধানের পর যিনি সারা বাংলার ফকির মহলে লালনের মতই উচ্চচ স্থান লাভ করেছিলেন, তিনি ফকির পাঞ্জ শাহ। লালনের পরলোক-গমনের অব্যবহিত পর থেকে প্রায় পঁচিশ বছর যাবত কবি পাঞ্জু শাহ অনেকটা লালনের শূন্যস্থান পূরণ করে রেখেছিলেন।' অসাধারণ প্রতিভা- ধর লালন শাহের তিরোভাব-জনিত শূন্যতা পূরণের ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন পাঞ্জ শাহ। সেজন্যে তিনিও লালনের ভাবশিষ্য হয়েই কাব্য-চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। 'লালন শাহের অত্যন্ত বয়ঃকনিষ্ঠ সমসাময়িক' এই সাধক একটি স্বতন্ত্র ঘরানা ও বিশেষ 'কাব্য-সঙ্গীত' গোষ্ঠীর উদ্যোক্তা হিসেবে উনিশ শতকের শেষার্ধে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে এদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্রে বিরাজমান। এসব দিক বিবেচনা করলে পাঞ্জু শাহের জীবনেতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মরমী কবি পাঞ্জু শাহ: জীবন ও কাব্য
কবি পাঞ্জু শাহ ১২৫৮ বঙ্গাব্দের (১৮৫১ খ্রীঃ) ২৮ শে শ্রাবণ ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা গ্রামে জন্য গ্রহণ করেন। ঐ সময় কবির পিতা খাদেমালী খোন্দকার এবং কবি মাতা জোহরা বেগম শৈলকুপাতেই তাঁদের নিজস্ব জমিদারভবনে বাস করতেন।
খাদেমালী খোন্দকার ছিলেন পাঁচ সন্তানের জনক। এরা যথাক্রমে-শাহারণ নেছা, তহিরণ নেছা, পাঞ্জু খোন্দকার, ওয়াসীম উদ্দীন খোন্দকার ও আইমানী নেছা।
খাদেমালী খোন্দকার যখন শৈলকুপা ত্যাগ করে হরিশপুর অভিমুখে যাত্রা করেন, তখন তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্বশুরালয়ে, মধ্যমা কন্যা পরলোকে এবং কনিষ্ঠ কন্যার জন্মই হয়নি। সুতরাং ভাগ্য-বিড়ম্বনার সেই অমানিশায় বালক পাঞ্জু এবং শিশু ওয়াসীম পিতার সহযাত্রী ছিলেন।
পাঞ্জু শাহের জীবন প্রকৃতপক্ষে হরিশপুর থেকেই শুরু। 'বসতি মোকাম মের। হরিশপুর গ্রাম'-একথা বলে কবি এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেন। বস্তুত বিলাসী জমিদার-নন্দন রূপে নন, কঠোর সংগ্রামী মোল্লার সন্তান রূপেই তিনি বর্ধিত হতে থাকেন। কোন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখার সুযোগ তাঁর হয় না। গৃহ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আরবী-ফারসী শিক্ষার মধ্যদিয়ে তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। পাঞ্জু শাহের পিতা ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলমান। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর ছিল অসাধারণ শ্রদ্ধাবোধ। খোন্দকার রফিউদ্দীন বলেন-'ফকির পাঞ্জু শাহের পিতা একজন গোড়া মুসলমান ছিলেন। শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে ইনি বাংলা ভাষা শিক্ষারই বিরোধী হন।' পিতৃপ্রভাবে পাঞ্জু শাহ বাল্যকালে আরবী-ফারসী ভাষায় দক্ব্যষতা লাভ করেন। তিনি বাংলা ভালো বলতে পারতেন না। তাই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি উপলব্ধি করেন যে, মাতৃভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করতে না পারলে চিন্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। ফলে 'ষোল বছর বয়সে তিনি হরিশপুর নিবাসী মহর আলী বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে অতি সংগোপনে বাংলা ভাষা শিখেন। চব্বিশ বছর বয়সে চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্তর্গত আইলহাস-লক্ষ্মীপুর গ্রামের আবদুর রহমান খোন্দকারের কন্যা ছন্দন নেছার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। পুণ্যবতী গুণবতী এ জীবন-সঙ্গিনী পাঞ্জু শাহকে নানাভাবে অনেক প্রেরণা জুগিয়েছেন। বিয়ের দু'-বছর পর তাঁর প্রথম সন্তান শামসউদ্দীনের জন্ম হয়। এর পর কয়েক বছরের ব্যবধানে কলিমন নেছা ও ছালেহা খাতুন নামে তাঁর দুই কন্যা জন্মে সাতাশ বছর বয়সে পাঞ্জু শাহ তাঁর পিতাকে হারান। তখন থেকে সংসারের ষোল আনা দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত হয়। কৈশোরকাল থেকেই পাঞ্জু শাহ মরমীবাদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু পিতার ভয়ে তাঁর জীবিতকাল পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে কোন ফকিরী মজলিশে তিনি যোগ দিতেন না। পিতার অন্তর্ধানের পর ফকিরী মাহফিলে স্বাধীনভাবে তাঁর যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। এ সময় হিবাজতুল্লাহ খোন্দকার নামে জনৈক তত্ত্বজ্ঞ সাধকের নিকট তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেন।
শিক্ষা
সম্পাদনাপাঞ্জু শাহ বাল্যকাল থেকে আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা চর্চার পর নিজের চেষ্টায় বাংলা ভাষা আয়ত্ত্ব করেন। পাঞ্জুশাহ সাধক হিরাজতুল্লাহ খন্দকারের কাছে সুফি ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি সুফি তত্ত্বের অনুসারী বহু ভাব সংগীতের রচয়িতা। ২০০-এর বেশি গান তিনি রচনা করেছেন।[২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ রামদুলাল রায় (২০১২)। "শাহ্, পাঞ্জু"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৯০, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |