পরভা নাচ হল পশ্চিমবঙ্গের একটি লোকনৃত্য। এর উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের চিল্কিগড়ে। এই নাচ প্রথমে চিল্কিগড়ের রাজপরিবারে সীমাবদ্ধ ছিল। এই নাচে ব্যবহৃত মুখোশ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। পরভা ( মুখোশ) মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ইতিহাস সম্পাদনা

১৮৩১-১৮৬০ ছিল ধবল রাজবংশের স্বর্ণ কাল। ১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি সে সময় রাজা মানগোবিন্দ ধবলদেবের শাসন ছিল ।তিনি প্রজাপ্রিয় রাজা ছিলেন।তার শিল্প সংস্কৃতিতে রুচি ছিল। তিনি একজন মিস্ত্রি দিয়ে কাঠ থেকে মুখোশ বানান।[১]

ঊনবিংশ শতকে পরভা নাচ ছিল মানুষের বিনোদনের মাধ্যম।চিল্কিগড়ের রাজবাড়িতে গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যাবেলায় রাজার বাগদি পাইক বা লেঠেলরা নাচত ।বৈশাখে শেষে বা জ্যৈষ্ঠে শুরুতে শনি মঙ্গলবার শিবের গাজনে সন্ধ্যাতে পরভা নাচ হত। সোহাগী, বাবু , ভূত , বাঘ , সিংহ ইত্যাদি বিষয়ে নাচ হত। শেষ দিন হত সতীর দেহত্যাগ।সানাইয়ের করুণ সুরে নৃত্যরত সতী মঞ্চে আসত। পাইকরা গোঁফ কামিয়ে লালপেড়ে শাড়ি পড়ে সিঁদুর দিয়ে সতী সাজত। গান ধরত—

‘আমি কি করিব কোথায় যাব বল না গো দ্যুতি
পরানে মারিয়া শেল বড়ালে পিরিতি।।
শিশুকালে ছিলাম ভাল কুসুম শয়ানে।
এবে তনু ঝর ঝর মদনের বাণে’।

এছাড়া মহিষাসুর বধ,সিপাহী বিদ্রোহ, দশাননের নাচ ও হত। পরভাতে গণেশ চতুর্ভুজা, ষড়ানন, সরস্বতী, লক্ষ্মী, অরুণ, বরুণ, কাক, কুমির, গোরুর মাথা, দশভুজা, যমরাজ, রাবণ, শিব, কার্তিক প্রভৃতি মুখোশ কাঠ থেকে বানানো হত। তখন এরকম প্রায় ১৬ মুখোশ তৈরি করা হত। ঝাড়গ্রামের লোকসংস্কৃতি সংগ্রহশালাতে চিল্কিগড়ের রাজ পরিবারের ১২টি মুখোশ এখনো আছে। নাচে মুখোশ বাঁশের বাতার বৃত্তে রাখা হত। বাঁশের বৃত্তে ঢুকে মুখোশ পরতে হত। ঢোল-সানাই সহকারে এই নাচ হত। নাচের প্রথমে ধুনুচি হাতে করে নাচতে নাচতে বুড়ো,বুড়ি ও গণক ঠাকুর ঢুকত। রাজবাড়ির সামে মানুষের ঢল নামত। রাজা মানগোবিন্দ তামাক সেবন করতে করতে নাচ দেখতেন। রাজপরিবারের অনেকে ও এই নাচ রপ্ত করেছিল।[২]

ক্রমে রাজত্ব চলে গেলে রাজপ্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়। অনেক শিল্পী ও বাদ্যকার মারা যায়। এরকম নানা কারণে পরভা নাচ বিশ শতাব্দির নয়ের দশকে হারিয়ে যায়।[৩]

পুনরুজ্জীবন সম্পাদনা

রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের আর্থিক সহায়তা এবং ব্যক্তিগত উদ্যমে শিল্পী ও বাদ্যকার নিয়ে ২০১৭ সালের শেষদিন কলকাতার রবীন্দ্র সদনে নবরূপে পরভা নাচ আবার ফিরে আসে। [৪]এতে মাথা থেকে কোমর অব্দি শোলার মুখোশ পড়া হয়। যা তৈরি করে পুরুলিয়ার মুখোশ গ্রামের চড়িদার কারিগর।পরভা নাচ দাঁতনের রবীন্দ্রভবনে ও কিছু লোক উৎসবে পরিবেশন করা হয়েছে। এই নাচকে তার পূর্বের রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।[৫]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "বিলুপ্ত ছৌ নাচের দেখা মিলবে তথ্যচিত্র উৎসবে"EI Samay। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৫ 
  2. aparjan (২০২০-০১-৩১)। "চিলকিগড়ের দেও ধবলদেব রাজবংশের মুখোশ নৃত্য পরভা ছো বা পরভা ছৌ : মৌ মুখার্জী"অপরজন (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৭-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৫ 
  3. গুপ্ত, কিংশুক। "লুপ্তপ্রায় পরভা নাচ বাঁচিয়ে রাখতে কর্মশালা"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৫ 
  4. "পাইক নাচের রণবাদ্যে এখন রাধাকৃষ্ণের মিলনের সুর"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৫ 
  5. "বিলুপ্ত পরভা নাচ রাজ দরবার ছেড়ে আম আঙিনায়"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৫