নীলডানা পাতা বুলবুলি

পাখির প্রজাতি

নীলডানা পাতা বুলবুলি (বৈজ্ঞানিক নাম: Chloropsis cochinchinensis), নীলডানা হরবোলা বা সবুজ বুলবুলি Chloropseidae (ক্লোরোপসিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Chloropsis (ক্লোরোপসিস) গণের এক প্রজাতির সবুজ বৃক্ষচারী পাখি[][] নামে বুলবুলি হলেও এরা আসলে বুলবুল গোত্রের পাখি নয়।[] হরবোলা হওয়ার কারণ এরা বিভিন্ন পাখি ও প্রাণীর ডাক চমৎকার নকল করতে পারে। নীলডানা পাতা বুলবুলির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ কোচীন-চীনের সবুজ পাখি (গ্রিক: kholoros = সবুজ, opsis = চেহারা; লাতিন cochinchinensis = কোচীন-চীনের, ভিয়েতনামের পূর্ব নাম)।[] দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা পর্যন্ত এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের বিস্তৃতি।[] বিগত কয়েক বছরে এদের সংখ্যা কমছে, তবে আশঙ্কাজনক হারে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।[] বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[]

নীলডানা পাতা বুলবুলি
পুরুষ
স্ত্রী
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Passeriformes
পরিবার: Chloropseidae
গণ: Chloropsis
প্রজাতি: C. cochinchinensis
দ্বিপদী নাম
Chloropsis cochinchinensis
Gmelin, 1789

বিস্তৃতি

সম্পাদনা

নীলডানা পাতা বুলবুলির মূল আবাস দক্ষিণদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াভিয়েতনাম জুড়ে এদের বিস্তৃতি।[] বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেটের গহীন বনে এদের দেখা মেলে।[]

উপপ্রজাতি

সম্পাদনা

নীলডানা পাতা বুলবুলির মোট সাতটি উপপ্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।[] উপপ্রজাতিগুলো হচ্ছে:

  • C. c. chlorocephala (Walden, 1871) - পূর্ব বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারত (আসাম) থেকে মায়ানমার ও পশ্চিম থাইল্যান্ড পর্যন্ত এরা বিস্তৃত।
  • C. c. kinneari (B. P. Hall & Deignan, 1956) - দক্ষিণ চীন (দক্ষিণ ইউনান প্রদেশ), উত্তর ইন্দোচীন ও উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ড এদের বিচরণস্থল।
  • C. c. auropectus (Wells et al., 2003) - দক্ষিণ ইন্দোচীন ও দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র।
  • C. c. serithai (Deignan, 1946) - এদের বিচরণ উত্তর মালয় উপদ্বীপে সীমাবদ্ধ।
  • C. c. moluccensis (J. E. Gray, 1831) - এদের প্রধান আবাস দক্ষিণ মালয় উপদ্বীপ, সুমাত্রা ও তৎসংলগ্ন দ্বীপগুলোতে এবং উত্তর নাতুনা দ্বীপ। পূর্বে বর্ণিত তিনটি উপপ্রজাতি একত্রিত করে এই উপপ্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছে। পূর্ববর্তী উপপ্রজাতিগুলো হল: C. c. icterocephala, C. c. billitonis এবং C. c. natunensis
  • C. c. viridinucha (Sharpe, 1877) - উত্তর বোর্নিও ছাড়া সমগ্র বোর্নিওতে বিস্তৃত।
  • C. c. cochinchinensis (J. F. Gmelin, 1789) - মনোনিত উপপ্রজাতি, স্থানীয় আবাস জাভায়

C. c. nigricollis নামে আরও একটি উপপ্রজাতির সন্ধান নথিপত্রে পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালে তা মনোনিত উপপ্রজাতির সাথে একীভূত করা হয়। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় বসবাস করা জার্ডনের পাতাবুলবুলিকে (C. jerdoni) নীলডানা পাতা বুলবুলির একটি উপপ্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হত।

নীলডানা পাতা বুলবুলি পাতার মত সবুজ রঙের ও নীলচে ডানার ছোট বৃক্ষচারী পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৮ সেন্টিমিটার, ডানা ৮.৪ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.১ সেন্টিমিটার, পা ১.৮ সেন্টিমিটার ও লেজ ৬.৫ সেন্টিমিটার।[] প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ ও দেহতল কচি পাতার মত সবুজ। পুরুষ ও স্ত্রী পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির মুখ ও থুতনি কালো। মুখের চারিদিক ও গলা হলদে রঙের। মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছন দিক হলদে-সবুজ। কাঁধ, ডানার প্রান্ত-পালক ও লেজের পালকের পাশ অনুজ্বল নীল। স্ত্রী পাখির থুতনি ও গলা নীলচে-সবুজ। কাঁধ, ডানার প্রান্ত-পালক ও লেজের পালকের পাশ পুরুষ পাখির মত অনুজ্বল নীল। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি উভয়ের চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির চেহারা স্ত্রী পাখির মত। কেবল কপাল, মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছনের অংশ সবুজ।[]

 
নীলডানা পাতা বুলবুলি তার গায়ের রঙের জন্য প্রকৃতিতে খুব সহজে মিশে যেতে পারে। সে কারণে ঘন বনে এদের খুঁজে বের করা বেশ শক্ত

স্বভাব

সম্পাদনা
 
১৮৮১ সালে অঙ্কিত চিত্র

নীলডানা পাতা বুলবুলি চিরসবুজ বন, পত্রপতনশীল বৃক্ষের অরণ্য ও বড় বাগানে বিচরণ করে। সচরাচর একা, জোড়ায় বা পারিবারিক দলে থাকে। প্রধানত ফুলগাছে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। ফুলের মধু, ফল, শুঁয়োপোকা, পিঁপড়া ও পরাগায়নে সহায়তা করে এমন পোকা-মাকড় এদের প্রধান খাদ্য। প্রায়ই প্রতিযোগী পাখিকে নিজের এলাকা থেকে এরা তাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন ধরনের তীব্র শব্দ ও শিস দিয়ে ডাকতে পারে। অন্যসব পাতা বুলবুলির মত এরাও বনের পাখি ও কাঠবিড়ালীর ডাক অবিকল অনুকরণ করতে পারে। সে কারণে এদের আরেক নাম হরবোলা[]

প্রজনন

সম্পাদনা

মে থেকে সেপ্টেম্বর নীলডানা পাতা বুলবুলির প্রধান প্রজনন ঋতু। স্ত্রী ও পুরুষ দু'জনে মিলেই বাসা বানায়। গাছের সরু মূল, ঘাস ও আঁশের সঙ্গে মাকড়শার জাল জড়িয়ে বাসা সাজায়। সচরাচর ঘন বনে বাসা বাঁধে। বাসা প্রকৃতির সাথে এমনভাবে মিশে থাকে যে হঠাৎ শনাক্ত করা বেশ কষ্টকর। বাসা সাধারণত ভূমি থেকে ৬-১০ মিটার উঁচুতে হয়। বাসা বানানো হয়ে গেলে ২-৩ টি ডিম পাড়ে। ডিমের বর্ণ ফিকে পীত কিংবা পাটকিলে-সাদা। ডিমে বেগুনি বা লালচে-বাদামি দাগ থাকে। ডিমের মাপ ২.১ × ১.৫ সেন্টিমিটার।[]

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ৩১৫।
  2. রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ৮৪।
  3. শরীফ খান, বাংলাদেশের পাখি, (ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, ২০০৮), পৃ. ৫৩।
  4. Chloropsis cochinchinensis ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে, BirdLife International এ নীলডানা পাতা বুলবুলি বিষয়ক পাতা।
  5. Chloropsis cochinchinensis[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], The IUCN Red List of Threatened Species এ নীলডানা পাতা বুলবুলি বিষয়ক পাতা।
  6. Blue-winged Leafbird (Chloropsis cochinchinensis), The Internet Bird Collection এ নীলডানা পাতা বুলবুলি বিষয়ক পাতা।