নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ

নারীদের অধিকারের আন্তর্জাতিক বিল

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সংক্ষেপে সিডও,ইংরেজি CEDAW) নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সনদটি কার্যকর হতে শুরু করে। সিডও একমাত্র আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সনদ, যা শুধু নারী সংক্রান্ত। জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ৬০টির অধিক সনদ বা চুক্তির মধ্যে ৭টি সনদকে মৌলিক বা মানবাধিকার চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার মধ্যে সিডও সনদ অন্যতম। বিশ্বের ১৮৬টি সদস্য রাষ্ট্র সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে সিডও সনদে স্বাক্ষর করে।[১]

সিডও (CEDAW)
নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ
{{{image_alt}}}
  স্বাক্ষর ও সমর্থনের মাধ্যমে পক্ষপাতী
  সংযোজন বা উত্তরাধিকারবলে পক্ষপাতী
  স্বীকৃতিহীন রাষ্ট্র, কিন্তু চুক্তিটি মেনে চলছে
  কেবল স্বাক্ষর করেছে
  স্বাক্ষর করেনি
স্বাক্ষর১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯
স্থাননিউইয়র্ক
কার্যকর৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১
শর্ত২০ তম সংশোধন
স্বাক্ষরকারী৯৯
অংশগ্রহণকারী১৮৯
আমানতকারীজাতিসংঘ মহাসচিব
ভাষাসমূহআরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রুশ ও স্পেনীয়
উইকিসংকলনে Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women

ঘোষণাপত্র

সম্পাদনা

সারসংক্ষেপ

সম্পাদনা

সিডও সনদে ৩০টি ধারা আছে। ১ম ১৬টি ধারা নারীর প্রতি কত প্রকার বৈষম্য আছে তা নিশ্চিত করে। পরের ১৪টি ধারা ব্যক্ত করে কীভাবে এগুলো বিলোপ করা যায়। এর মূল বিষয় হচ্ছে, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ বা দূরীকরণ। যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এটি আইনগত ভিত্তি নিয়ে একটি নিয়মপত্র বা কনভেনশন আকারে রূপ লাভ করেছে। এ সনদটি মূলত তিনটি প্রেক্ষিত থেকে সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেয়। ক. নারীর নাগরিক অধিকার ও আইনি সমতা নিশ্চিতকরণ, যার মাধ্যমে নারী গণজীবনে ও সমাজে পুরুষের সমপর্যায়ে সব সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। খ. নারীর প্রজনন ভূমিকাকে সামাজিক ভূমিকা হিসেবে গণ্য করা, যাতে প্রজননের কারণে নারীকে কোণঠাসা না করে এ ক্ষেত্রে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। গ. আচার-প্রথা, সংস্কার ও বিধি যা নারীর জেন্ডার ভূমিকা নির্ধারণ করে, তা বাতিল করা। পরিবার ও সমাজে শুধু 'মানুষ' হিসেবে নারীকে গণ্য করা এবং পুরুষের ক্ষমতাভিত্তিতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

মূল বিধান

সম্পাদনা

ধারা ১ নিম্নলিখিত ধারাে নারীর প্রতি বৈষম্যকে সংজ্ঞায়িত করে:[২]

পুরুষ-নারী ভিত্তিতে যে কোনো পার্থক্য, বাধাদান বা বিধিনিষেধ যার মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, নাগরিক অথবা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়া, তা ভোগ করা, অথবা বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে, পুরুষ ও নারীর সমতার ভিত্তিতে নারীর দ্বারা তার ব্যবহার বা চর্চা, খর্ব বা রদ করার মত প্রভাব বা উদ্দেশ্য রয়েছে।

ধারা ২ আদেশ করে যে ঘোষণাপত্র অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্রগুলি তাদের দেশের আইনে লৈঙ্গিক সমতাকে অন্তর্ভুক্ত করার অভিপ্রায় ঘোষণা করে, তাদের আইনে সমস্ত বৈষম্যমূলক বিধান বাতিল করে এবং মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য নতুন বিধান প্রণয়ন করতে সম্মত হয়। ঘোষণাপত্র অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্রগুলিকে অবশ্যই বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীদের কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল এবং পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ব্যক্তি, সংস্থা এবং উদ্যোগের দ্বারা নারীর প্রতি চর্চা করা সমস্ত ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।[২]

ধারা ৩ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে "পুরুষের সাথে সমতার ভিত্তিতে" নারীদের মৌলিক মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে শরীক রাষ্ট্রসমূহ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।[২]

ধারা ৪ পুরুষ ও নারীর মধ্যে প্রকৃত প্রস্তাবে সমতা ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে কোনো অস্থায়ী বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা এই সনদে বর্ণিত সংজ্ঞা অনুযায়ী বৈষম্য হিসাবে বিবেচনা করা হবে না, তবে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ কোনোভাবেই অসম অথবা পৃথক মান বজায় রাখার ফল হিসাবে যুক্ত হবে না; সুযোগ ও আচরণের সমতার লক্ষ্য অর্জিত হলে এসব ব্যবস্থা রহিত করা হবে। তবে মাতৃত্ব রক্ষার লক্ষ্যে এই সনদে বর্ণিত ব্যবস্থাসহ কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা বৈষম্যমূলক বলে বিবেচিত হবে না।[২]

ধারা ৫ হীনমন্যতা বা এক লিঙ্গের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার উপর ভিত্তি করে বা পুরুষ ও নারীর মধ্যে বাঁধাধরা ধারণা উপর ভিত্তি করে কুসংস্কার এবং প্রথা দূর করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষগুলিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। মাতৃত্বকে একটি সামাজিক কাজ হিসাবে যথাযথভাবে বিবেচনা এবং সকল ক্ষেত্রে শিশুদের স্বার্থই মূল বিবেচ্য বিষয় এ কথা স্মরণ রেখে সন্তান-সন্ততির লালন-পালন ও উন্নয়ণে পুরুষ ও নারীর অভিন্ন দায়িত্বের স্বীকৃতির বিষয় যাতে পারিবারিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।[২]

সম্মেলন

সম্পাদনা

সারসংক্ষেপ

সম্পাদনা

এই সম্মেলনের সকল প্রকার বর্ণবৈষম্য নির্মূলের জন্য প্রয়োজনীয় সম্মেলনের অনুরূপ বিন্যাস রয়েছে, "দুটির ক্ষেত্রেই এর প্রকৃত বাধ্যবাধকতার এবং এর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে"।[৩] সম্মেলনটি মোট ৩০টি নিবন্ধ সহ ছয়টি অংশে গঠিত।[৪]

  • বিভাগ ১ (প্রবন্ধ ১-৬) অ-বৈষম্য, যৌন গতানুগতিকতা এবং যৌন পাচারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
  • বিভাগ ২ (প্রবন্ধ ৭-৯) রাজনৈতিক জীবন, প্রতিনিধিত্ব, এবং জাতীয়তার অধিকারের উপর জোর দিয়ে জনজীবনের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের রূপরেখা দেয়।
  • বিভাগ ৩ (প্রবন্ধ ১০-১৪) মহিলাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকারগুলি বর্ণনা করে, বিশেষ করে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তৃতীয় বিভাগে গ্রামীণ মহিলাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা এবং তারা যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তাও অন্তর্ভুক্ত করে।
  • বিভাগ ৪ (অনুচ্ছেদ ১৫ এবং ১৬) আইনের সামনে সমতার অধিকারের সাথে বিবাহ এবং পারিবারিক জীবনেও নারীদের সমতার অধিকারের রূপরেখা দেয়।
  • বিভাগ ৫ (আর্টিকেল ১৭-২২) মহিলাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত কমিটি এবং সেইসাথে রাষ্ট্রের পক্ষগুলির প্রতিবেদন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে।
  • বিভাগ ৬ (আর্টিকেল ২৩-৩০) অন্যান্য চুক্তির উপর সম্মেলনের প্রভাব, রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিশ্রুতি এবং সম্মেলনের প্রশাসনকে বর্ণনা করে।

মূল বিধান

সম্পাদনা

অনুচ্ছেদ ১ নিম্নলিখিত শর্তগুলি মহিলাদের প্রতি বৈষম্যকে সংজ্ঞায়িত করে:[৪]

লিঙ্গের ভিত্তিতে প্রণীত কোনো পার্থক্য, বর্জন বা বিধিনিষেধ যা লিঙ্গের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, যার প্রভাব বা উদ্দেশ্য রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা, মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার ভিত্তিতে, বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে মহিলাদের স্বীকৃতি, তাদের উপভোগ বা অনুশীলনকে দুর্বল বা বাতিল করার।

ধারা ২ জনাদেশ দেয় যে সম্মেলন অনুমোদনকারী রাষ্ট্র পক্ষগুলি তাদের অভ্যন্তরীণ আইনে লিঙ্গ সমতা রক্ষিত করার অভিপ্রায় ঘোষণা করে, তাদের আইনের সমস্ত বৈষম্যমূলক বিধান বাতিল করে এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্যের বিপক্ষে সুরক্ষার জন্য নতুন বিধান প্রণয়ন করে।[৪] এই সম্মেলন অনুমোদনকারী রাষ্ট্রগুলিকে অবশ্যই বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহিলাদের কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ন্যায়পীঠ এবং সরকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ব্যক্তি, সংস্থা ও উদ্যোগের দ্বারা মহিলাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত সমস্ত ধরণের বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।[৪]

৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষগুলি "রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের" মাধ্যমে "পুরুষদের সাথে সমতার ভিত্তিতে" নারীদের মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেবে।[৪]

৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, "পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে কার্যত প্রকৃত সমতা ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণকে বৈষম্য হিসাবে বিবেচনা করা হবে না।" এটি যোগ করে যে মাতৃত্বের জন্য বিশেষ সুরক্ষা লিঙ্গ বৈষম্য হিসাবে বিবেচিত হয় না।[৪]

অনুচ্ছেদ ৫ চায় রাষ্ট্র পক্ষগুলি যেন একটি লিঙ্গের ন্যূনতা বা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা অথবা পুরুষ ও মহিলাদের গতানুগতিক ভূমিকার উপর ভিত্তি করে তৈরি কুসংস্কার এবং প্রথা দূর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে।[৪]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০৯ 
  2. "Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women New York, 18 December 1979"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০৯ 
  3. Henkin, Louis (২০০৯)। Human Rights। Foundation Press। পৃষ্ঠা 221। 
  4. "Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women"ohchr.org। ৭ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৫-০৮ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা