নারীদের প্রতি তালেবানের আচরণ

২০০১ পর্যন্ত তালেবান ক্ষমতায় থাকাকালীন কর্মকাণ্ড

আফগানিস্তানে ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন, তালেবান তাদের কুসংস্কার এবং নারীর প্রতি সহিংসতার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত হয়ে ওঠেছিলো।[১] তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল "একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা যেখানে নারীদের সতীত্ব ও মর্যাদা আবার পবিত্র হতে পারে",[২]এখন যেহেতু তালেবান আবার আফগানিস্তান আবার দখল করেছে, সেখানে অনেক উদ্বেগ রয়েছে।[৩] তবে ১৭ আগস্ট ২০২১ এ তালেবানের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছে, তালেবান ইসলামিক কাঠামোতে মহিলাদের সম্মান করবে। একই দিন একজন নারী উপস্থাপক আফগান টিভিতে তালেবান সদস্যের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।[৪]

বোরকা পরা আফগান মহিলারা

আগে ক্ষমতা থাকাকালীন আফগানিস্তানের নারীরা বাইরে গেলে বোরকা পরতে বাধ্য হত, এর কারণ হিসাবে একজন[কে?] তালেবান মুখপাত্র বলেনঃ "অচেনা পুরুষের জন্য,একজন নারীর মুখ দুর্নীতির উৎস।"[৫] ততকালীন সময়ে ৮ বছর পর্যন্ত মেয়েদের শুধুমাত্র কুরআন পড়ালেখার অনুমতি ছিলো।[৬] তালেবান বাল্যবিবাহের অনুমতি দেয় এবং কিছু ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের জন্য উৎসাহিতও করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট মতে, ৮০% আফগান নারীর জোরপূর্বক বিয়ে হয়।[৭]

লিঙ্গ নীতি সম্পাদনা

পুর্বে ক্ষমতা থাকাকালীল তালেবানের নিয়মে আট বছর বয়স থেকে, আফগানিস্তানে মেয়েদের নিকটাত্মীয় "রক্তের আত্মীয়", স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের অনুমতি দেওয়া হয়নি (মাহরাম দেখুন)।[৮] মহিলাদের জন্য অন্যান্য আরও বিধিনিষেধ ছিল:

  • মহিলাদের বারান্দায় আসা নিষিদ্ধ।
  • মহিলাদের উঁচু হিলের জুতা পরা যাবে না কারণ হিসাবে বলা হয় মহিলাদের পায়ের আওয়াজে পুরুষ উত্তেজিত হয়।
  • মহিলাদের প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না যাতে অপরিচিত কেউ শুনতে না পারে। [৯]
  • নিচতলায় থাকা সব ঘরের জানালা এমন করে পর্দা বা বন্ধ করতে হবে যাতে মহিলা দেখা না যায়।
  • কোন সংবাদপত্র, বই বা বিজ্ঞাপনে মহিলার ছবি ব্যবহার করা যাবে না।
  • "নারী" শব্দটি আছে এমন সব স্থানের নামগুলির পরিবর্তন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, "মহিলাদের বাগান (women's gardens)" এর নামকরণ করা হয়েছিল "বসন্ত উদ্যান"। [১০]
  • টিভি, রেডিও ও যে কোন জনসভা বা অনুষ্ঠানে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। [১১]

চলাচল সম্পাদনা

তালেবান নারীর চলাফেরার স্বাধীনতার উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং যারা বোরকা কিনতে পারে না বা কোন মাহরাম নেই তাদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে। এই মহিলারা প্রায় গৃহবন্দী[১২] একা রাস্তায় হাঁটার জন্য তালেবানদের দ্বারা মারধরের শিকার হওয়া এক মহিলা বলেছিলেন "আমার বাবা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। আমার স্বামী নেই, ভাই নেই, ছেলে নেই। যদি আমি একা বাইরে যেতে না পারি তবে আমি কীভাবে বাঁচব? " [১৩]

ততকালীন নারীদের চলাচলে প্রভাবিত ফেলে এমন নিয়মগুলো ছিল:

  • মহিলাদের সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানো নিষিদ্ধ, এমনকি তাদের মহরমের সাথেও।
  • মহিলাদের মাহরাম ছাড়া ট্যাক্সিতে চড়তে নিষেধ।
  • একই বাসে ভ্রমণকারী পুরুষ ও মহিলাদের আটকাতে পৃথক বাস পরিষেবা চালু করা। [১৪]

কর্মসংস্থান সম্পাদনা

১৯৯৬ সালে তালেবান মহিলাদের কাজ করা বন্ধ করে দেওয়াতে হাজার হাজার সরকারি চাকরিজীবী মহিলা চাকরি হারায়। ধারণা করা হয়, ততকালীন আফগানিস্তানের ২৫% সরকারি চাকরিজীবী মহিলা ছিলো।[১৫]

শুধু মেয়েদের নয়, ছেলে মেয়ে সবার প্রাথমিক শিক্ষায় এর প্রভাব পড়। বেশিরভাগ নারীই শিক্ষিকার পেশায় কাজ করায় এবং মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞায় কাবুলের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়৷ হাজার হাজার শিক্ষিত পরিবার গুলো কাবুল ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে যায়।[১২][১৬]:১০৬

শাস্তি সম্পাদনা

ক্ষমা না থাকার কারণে নাগরিকরা কঠোর শাস্তির ভয়ে বসবাস করত; নিয়ম ভাঙা মহিলাদের প্রায়ই চরম সহিংসতামূলক আচরণ করা হতো।[৮] উদাহরণ:

  • ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে, রেডিও শরিয়া ঘোষণা করেছিল যে, "২২৫ কাবুল নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং পোষাকের শরিয়াহ আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে। একটি ট্রাইব্যুনাল এই সাজা প্রদান করে এবং অভিযুক্তদের পায়ে এবং পিঠে আঘাত করে শাস্তি দেওয়া হয়"।[১৭]
 
১ নভেম্বর ১৯৯৯, কাবুলের গাজী স্পোর্টস স্টেডিয়ামে তালেবানদের দ্বারা জরমিনা নামের এক মহিলার প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার একটি ছবি। স্বামীর মারধরের শিকার হওয়ার পর সাত সন্তানের মা জরমিনা তার স্বামীকে ঘুমানোর মধ্যে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলো।[১৮] [১৯]
  • তালেবানের একটি অভিযানে একজন মহিলাকে তার অ্যাপার্টমেন্টে একটি অনানুষ্ঠানিক স্কুল চালানোর অবস্থায় পাওয়া যায়, তখন তারা শিশুদের মারধর করে এবং মহিলাকে সিঁড়ির থেকে ফেলে দেয় (তার পা ভেঙে) তারপর তাকে বন্দী করে। তালেবান এবং তাদের আইনের প্রতি আনুগত্যের শিকার করে লিখিত দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার পরিবারকে প্রকাশ্যে পাথর মারার হুমকি দেওয়া হয়েছিলো।[১৩]
  • বিবি আয়েশা নামের এক আফগান মেয়েকে একটি নতুন পরিবারে দেওয়া হয়েছিলো বাদ পদ্ধতি মাধ্যমে। (বাদঃ আসামির পরিবারের কোন নারীকে স্ত্রী বা দাসী হিসাবে দিয়ে আপোষ করার একটি রীতি)। বাদের মাধ্যমের দেওয়া মেয়েদের উপর প্রায়ই নির্যাতন করা হত বলে যখন মেয়েটি পালিয়ে যায় তখন তার নতুন পরিবার (যাদের দেওয়া হয়েছিলো) তাকে খুঁজে পেয়ে যায়। একজন তালেবান কমান্ডার তাকে শাস্তি দেওয়ার আদেশ দেয় যাতে তা উদাহরণ হয়ে থাকে, "যাতে গ্রামের অন্য মেয়েরাও এমন পালানোর চেষ্টা না করে"।[২০] তার কান ও নাক কেটে ফেলা হয়েছিল এবং তাকে পাহাড়ে মৃত মনে করে ফেলে দেওহা হয়েছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সে বেঁচে যায়।[২০]
  • কর্মজীবী নারীদের চাকরি ছাড়ার হুমকি দেওয়া হয়। তালেবানদের হুমকি মেনে না চলার কারণে মহিলাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যেমনটা জুলাই ২০১০ সালে ২২ বছর বয়সী হোসাইয় সাথে করা হয়।[২১][২২]

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পাদনা

তালেবান আন্তর্জাতিক সব সংস্থার মতামত উপেক্ষা করে শরিয়া আইনের নিজেদের ব্যাখ্যা প্রনয়ণ করে। তবে আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধ না করতে সামান্য প্রতিবাদ করে।

  • আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার মেনে বাচ্ছা ছেলে মেয়েদের একত্রে পড়তে না দেওয়া ১৯৯৫ সালে ইউনিসেফ সকল প্রকার সাহায্য বন্ধ করে দেয়।[৮]
  • তালেবানের নিয়ম মেনে কাজ কঠিন হয়ে পড়ায় ১৯৯৬ সালে সেভ দ্য চিলড্রেন (UK) নারীদের সাথে যোগাযোগের ও শিশু সেবা বন্ধ করে দেয়।[৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "ভিডিও"। Revolutionary Association of the Women of Afghanistan (RAWA)। ২৫ মার্চ ২০০৯ তারিখে মূল (MPG) থেকে আর্কাইভ করা। 
  2. Marsden, Peter. (1998). The Taliban: War, religion and the new order in Afghanistan. London: Zed Books Ltd, আইএসবিএন ১-৮৫৬৪৯-৫২২-১ pp. 88–101.
  3. Trofimov, Yaroslav (আগস্ট ১৫, ২০২১)। "Afghanistan Government Collapses as Taliban Take Kabul" – www.wsj.com-এর মাধ্যমে। 
  4. "Taliban vow to respect women, despite history of oppression" 
  5. M. J. Gohari (2000). The Taliban: Ascent to Power. Oxford: Oxford University Press, আইএসবিএন ০-১৯-৫৭৯৫৬০-১ pp. 108–110.
  6. Hasan, Israr. (2011) THE CONFLICT WITHIN ISLAM: Expressing Religion Through Politics. iUniverse, আইএসবিএন ১-৪৬২০৮-৩০১-৩ pp165
  7. "A Woman Among Warlords: Women's Rights in the Taliban and Post-Taliban Eras"। PBS। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৪ অক্টোবর ২০১৪The Taliban’s policies also extended to matrimony, permitting and in some cases encouraging the marriages of girls under the age of 16. Amnesty International reported that 80 percent of Afghan marriages were considered to be by force. 
  8. Michael Griffin (2001). Reaping the Whirlwind: The Taliban movement in Afghanistan. London: Pluto Press, pp6-11/159-165.
  9. "some of the restrictions imposed by Taliban in Afghanistan"। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৫ 
  10. Rod Nordland (২০১০-০৬-২০)। "Women's gardens in Kabul"The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০১-০৯ 
  11. "AccountSupport"। ৮ অক্টোবর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৫ 
  12. Marsden, Peter. (1998). The Taliban: War, religion and the new order in Afghanistan. London: Zed Books Ltd, আইএসবিএন ১-৮৫৬৪৯-৫২২-১ISBN 1-85649-522-1 pp. 88–101.
  13. Latifa My forbidden face: Growing up under the Taliban. UK: Virago Press pp29-107.
  14. "some of the restrictions imposed by Taliban in Afghanistan"। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৫ 
  15. United Nations High Commissioner for Refugees। "UNHCR – Document Not Found"UNHCR। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৫ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  16. Rashid, Ahmed (২০০০)। Taliban: Islam, Oil and the New Great Game in Central Asia। I.B. Tauris। 
  17. "Women in Afghanistan: The violations continue"Amnesty International। ১ জুন ১৯৯৭। ১০ মে ২০০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০০৭ 
  18. "Filmed by RAWA: Taliban publicly execute an Afghan woman"। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৫ 
  19. Krikorian, Michael (ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০০৩)। "Documenting truth in dangerous places"Los Angeles Times 
  20. Anthony, Andrew (৫ ডিসেম্বর ২০১০)। "Afghanistan's propaganda war takes a new twist"The Guardian। London। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১০ 
  21. The Taliban War on Women Continues Human Rights Watch in the Wall Street Journal 14/7/2010
  22. Reid, Rachel (১৪ জুলাই ২০১০)। "The Taliban War on Women Continues"The Wall Street Journal (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0099-9660। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২১